আমার ফুপু (‘একজন মহাসমুদ্র’ ও ‘মেঘে ঢাকা তারা’) – ১
———————————————————————- রমিত আজাদ
গত ৯ই মার্চ শুক্রবার ইন্তেকাল করেছেন আমার মাতৃতুল্য ফুপু ‘ফজিলাতুন্নিসা সানিয়া হক’। এরপর আমাকে অনেকেই বলেছেন উনাকে নিয়ে লিখতে। আমি এতকাল অনেক লেখাই লিখেছি, অনেক-কে নিয়েই লিখেছি। আমার অন্য এক ফুপু, এবং কয়েকজন শিক্ষক ইন্তেকাল করার পর এক রাতেই উনাদের-কে নিয়ে লেখা লিখছিলাম। আমার ফুপুই আমাকে লেখালেখি শিখিয়েছিলেন। কিন্তু ফুপু ‘সানিয়া হক’ ইন্তেকাল করার পর কয়েকবার লেখার চেষ্টা করেও হাত নড়েনি। অধিক শোকে মানুষ যে পাথর হয়ে যায়, এটার উদাহরণ নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি। তাছাড়া বার বার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কি দিয়ে শুরু করবো আর কিভাবে শেষ করবো তাই গুছাতে পারছি না। আমার কাছে তিনি ছিলেন একদিকে একজন ‘মহাসমুদ্র’ আর একদিকে একজন ‘মেঘে ঢাকা তারা’। আমার পুরো জীবনটা জুড়েই তিনি, শুধু আমি নই আমাদের বৃহত্তর পরিবারে এমন কেউ নেই যার জীবনে উনার অবদান নেই, তাই তিনি একজন ‘মহাসমুদ্র’। আরেকদিকে তিনি চিরকালটাই বৃহত্তর সমাজের কাছে অজানাই রয়ে গিয়েছেন, তাই তিনি একজন ‘মেঘে ঢাকা তারা’। তিনি ছিলেন অসামান্য একজন চিত্রকর, একজন লেখিকা, একজন শিক্ষিকা, একজন অতি আধুনিক, উচ্চ সংস্কৃতিমনা ও স্কলার ব্যাক্তি। উনার বিশাল বড় প্রতিভা-কে তিনি বৃহত্তর সমাজে বিকশিত বা প্রদর্শিত করার সুযোগ পাননি কেবল অন্য মানুষদের মঙ্গল সাধনায় ব্যস্ত থাকার জন্য। তাই তিনি ছিলেন একজন ‘মেঘে ঢাকা তারা’।
১৯৩৫ সালের ৬ই জুন মরহুমা সানিয়া হক-এর জন্ম পটুয়াখালীর বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ (সংসদ সদস্য) ও আইনজীবি এমদাদ আলী-র ঘরে। উনার মাতার নাম ছিলো সাজেদা বেগম। মরহুমা সাজেদা বেগম-ও শিক্ষিতা ছিলেন। সানিয়া হক ছিলেন পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান। পটুয়াখালী-তে শুরু হয় উনার শিক্ষাজীবন। পরবর্তিতে ‘ঢাকা আর্ট কলেজ’ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন-এর সরাসরি ছাত্রী ছিলেন।
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন খ্যাতিমান সাংবাদিক মোজাম্মেল হকের সাথে। মরহুম মোজাম্মেল হক ছিলেন ‘দৈনিক বাংলা’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ‘প্রেস ট্রাস্ট’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাকেরগঞ্জের অধিবাসী ছিলেন। মরহুম মোজাম্মেল হক-ও একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে কলিকাতা তথা বাংলার ছাত্র রাজনীতিবিদ ও নেতা হিসাবে উনার অনেক অবদান রয়েছে। একজন মুক্তিসংগ্রামী হিসাবে তিনি একাধিকবার কারাবন্দী হয়েছিলেন। প্রথিতযশা সাংবাদিক নির্মল সেন সহ অনেকেই মোজাম্মেল হক-কে গুরু মানতেন। ১৯৬৫ সালে মিশরের কায়রো-তে পিআইএ-র একটি বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হয়েছিলেন। সেই থেকে আমার ফুপু-র শুরু হয়েছিলো একলা পথ চলা। তবে সেই পথ চলতে গিয়ে তিনি কখনো-ই হোচট খাননি, বরং আরো অনেককেই দেখিয়েছিলেন পথের দিশা।
(চলবে)