নরেন্দ্র নারায়ণ যে জমিদার ছিলেন….
-হ্যাঁ তোমাকেই বলছি হে পথিক
আমি একজন বটগাছ
একটি বটগাছ নই, আমারও যে প্রাণ আছে
আছে ভালোবাসার অধিকার
শুধু আমি চলতে পারি না
আর সব কিছুই করতে পারি
তাই আমি একজন বটবৃক্ষ, “একটি নয়” ।
তুমি পথিক, কোথাও যাচ্ছ বুঝি ?
খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে তোমাকে
একটু জিরিয়ে নিতে পার
আমার সুশীতল ছায়ায়
এসো, কাছে এসে উঁচু শিকড়টায় হেলান দিয়ে বসো
আমি তোমাকে হাজারো পাতার
পাখায় বাতাস দিয়ে জুড়িয়ে দেব
যদি কিঞ্চিৎ সময় থাকে তাহলে
দু-তিনটে কথা বলতে চাই তোমার সাথে
জানি তুমি ব্যস্ত,
গাছেদের কথা শোনার সময় কোথায় তোমার
মানুষ বড়ই ব্যস্ত, তার জাতি ভাইদের
কথা শোনবার সময় নেই এক বিরাম ।
একি ঘুমিয়ে পড়লে দেখি
ঠিক আছে, তুমি ঘুমিয়ে থাক
আমি নিরবিচ্ছিন্ন পাতার পাখায়
তোমাকে সুশীতল বাতাসে শীতল করে তুলি আর
তোমার স্বপ্ন ঘোরে এসে
দু-চারটে কথা বলে মনের ভিতরের কষ্টগুলো ভাগ করে নিবো,
হ্যাঁ যা বলছিলাম
নরেন্দ্র নারায়ণ, তিনি ছিলেন একজন জমিদার
এ অঞ্চলের সবচাইতে প্রভাবশালী
ইতিহাসে পাবে কিনা জানি না
তা প্রায় ৫০০ বছর তো হবেই
ঠিক ৫০০ বছর পূর্বেকার কথা
আমার ঠিক মনে আছে
গাছেরা কোন কিছু ভুলতে পারে না
এই তো সেদিন
সকালে জমিদার বাবু এ পথ দিয়ে হেঁটে যেতেন আর
হাত বুলিয়ে দিতেন আমার গায়ে পরম আদরে
আমার তখন শৈশব,
হা……হা…..
কি বললে ? আমার বয়স কত ?
আমার বয়স আসলে কত হবে
সঠিক বলতে পারবো না
তবে আমার মগডালে বসে থাকা শুকুনীর চাইতেও ঢের বেশি
তোমার দাদার দাদাও আমাকে ঠিক এরকমই দেখেছে
ঠিক এখন যেমন আছি,
মহাকালের সাক্ষী বলতে পারো
তবে অনুমান করে বলতে পারি
আমার বয়স ৬০০ বছর পেরিয়েছে অনেক আগেই ।
পথিক, তুমি বিরক্ত হচ্ছ না তো ?
অবশ্য বিরক্ত হওয়ারই কথা
তুমি শান্তিতে ঘুমুচ্ছো আর
আমি বকবক করে তোমার ঘুমকে হালকা করে দিচ্ছি
কি? সমস্যা নেই , শুনতে চাচ্ছ আমার ইতিহাস
তাহলে শোন, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই
তোমাকে ডেকে দেব আমি, ভেবো না ।
শত শত বছরে আমি শুধু মানুষকে দিয়েছি
আর কত কি যে দেখেছি এ পোড়া চোখে,
অভাব আর অত্যাচারিত হয়ে
আÍহত্যা করেছিল জয়নাব
তাও দেখতে হয়েছিল আর
না দেখে কি উপায় ছিল বল
আমারই ডালে দড়ি ঝুলিয়ে
আÍহত্যা করেছিল
স্বামীটা তার এত পাষণ্ড ছিল যে
সরলা রূপবতী মেয়েটাকে
যৌতুকের জন্য বেধড়ক মারধর করতো
চোখের সামনে ছটফট করতে করতে
শেষ নিশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে গেল
আমি তার পাশে থেকেও বাঁচাতে পারলাম না,
(দীর্ঘশ্বাস……)
শুধুমাত্র কালের সাক্ষী হয়ে থাকলাম ।
এই তো সেদিন, ৭১ এর সময়
মুক্তিযোদ্ধা কিছু তরুণ
আমার এ গুড়ির পেছনে আশ্রয় নিয়েছিল
পাক সেনাদের সাথে তাদের সামনাসামনি যুদ্ধ হয়
রমিজ উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়
তার বুকে এসে গুলি লাগে,
পাক বাহিনী পরাজিত হয় ঠিকই
কিন্তু রমিজ শহীদ হয়
তার কলকল করে রক্ত পরা আমি
বন্ধ করতে পারিনি
শুধু পাতার আর গুড়ির আশ্রয় দিয়েছি মাত্র
পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা আরজ আলীর পা আর ফেরত দিতে পারিনি
কি পেয়েছে এই মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের কাছে ?
এখনও মাঝে মাঝে আরজ আলী আমার শরীরে
পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে
অতীত স্মরণ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে
তার সেই দীর্ঘ নিশ্বাস আমার হৃদয়কে
ক্ষতবিক্ষত করে..
বিশ্বাস করছো না ?
এই দেখ আমার শরীরে এখনও বুলেটের চিহ্ন বর্তমান
কি, এখন বিশ্বাস হল তো
আমরা গাছ, গাছেরা কখনও মিথ্যা বলে না ।
কত রাখাল এসে এখানে গরু চড়ায়
কত পাখি এসে গান গায়
কত শিশুরা এসে খেলা করে
আমি শুধু তাদের আশ্রয় দেই
দেই ছায়া আর ভালোবাসা
মানুষের দুঃখ দেখে ব্যথিত হই
মানুষের সুখ দেখে আনন্দিত হই
কালবৈশাখীর ঝড়ে সে বছর অনেক মানুষ মারা গেল
তোমরা তার নাম দিলে সিডর
হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হল
অনেক মানুষ মারা গেল
অনেক গাছও মারা গেল
আমি কোনরকমে বেঁচে ছিলাম
কিন্তু আমার দুটি ডাল ভেঙ্গে গেল
এই যে দেখ এখনও তার ক্ষত আছে
মানুষদের আমার খুব ভালো লাগে
কারণ এত ঝড়ের পরেও
তারা আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখে
নতুন করে ঘর বাঁধে ।
কিন্তু মানুষ অনেক স্বার্থপর
তোমাদের এত উপকার করেও
কোন প্রতিদান পাইনি
বরং এখন আমাকে আগুনে পোড়ানো বাকি
হ্যাঁ সত্যিই বলছি
সামনের সপ্তাহে হয়ত আমাকে কেটে ফেলা হবে
কেটে টুকরো টুকরো করে ইটের ভাটায় পোড়ানো হবে
আমিও সেদিনের অপেক্ষায় আছি, ভাবলাম
তোমাদের মাঝে বেঁচে কি লাভ ?
এত উপকার করেও যখন তোমাদের মন যোগাতে পারলাম না
তখন আর হিংস্র স্বার্থপর পৃথিবীতে বেঁচে থেকে লাভ কি, বল ?
একি উঠে পড়লে যে,
ঘুম ভেঙ্গে গেল সন্ধ্যার আযানে
আজ চলে গেলেও আরেক দিন এসো
বাকি গল্পটুকু শোনাবো
যদি ততদিনে আমাকে কেটে ইটের ভাটায় পোড়ানো না হয়
শীঘ্রই এসো, ৬০০ বছরের ইতিহাস তো আর
ঘন্টা খানেকে শেষ হবে না
একদিন সময় নিয়ে এসো
তবে শীঘ্রই,
ঐ শানিত কুঠার আমার বুক চিরে ফেলার আগেই।
বিদায় পথিক, বিদায় ।।