এবারের নোবেল পুরষ্কার (পদার্থবিজ্ঞান ২০১৭):
————————————— ড. রমিত আজাদ
ছোট্ট একটি ছেলে ভর দুপুরে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুকুর পারে। কোন এক কারণে সেই সময় বাতাসের বেগও তেমন ছিলনা ঐ তল্লাটে। শুনশান দুপুর, চারিদিকে কেউ নেই। শুধু ছোট্ট ছেলেটি আর একটি শান্ত নির্জন পুকুর। আক্ষরিক অর্থেই শান্ত, বিন্দুমাত্র আন্দোলন ছিলনা পুকুরের উদক বুকে। ছোট্ট ছেলেটির দুষ্টু মাথায় খেলে গেলো একটি খেয়াল, সে পুকুর পাড় থেকে তুলে নিলো একটি ঢিল, তারপর সজোরে নিক্ষেপ করলো পুকুরের বুকে। ঢিলটি টুপ করে একটি শব্দ তুলে ঝুপ করে পড়ে গেলো পুকুরের শান্ত নির্জন জলে, আর সাথে সাথেই তাকে অশান্ত করে তুললো। কি একটা প্যাটার্ন যেনো তৈরী হলো সেখানে, যেটি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারপাশে, তারপর এগুতে এগুতে একসময় স্পর্শ করলো পুকুরের পাড়। শিশুটি পরে জেনেছিলো, একে বলে ঢেউ; আরো পরে স্কুল জীবনে সে যখন বিজ্ঞান পড়তে শুরু করলো তখন সে জানলো একে বলে তরঙ্গ (ঢেউয়ের কাব্যিক প্রতিশব্দটিই বিজ্ঞানীরা বেছে নিয়েছেন পরিভাষা হিসাবে)। এই তরঙ্গ নিয়ে ইতিপূর্বে সে কবিতা পড়েছে অনেক, কিন্তু তরঙ্গ যে কবিতার পাশাপাশি কঠিন বিজ্ঞানেরও পরম কৌতুহলের বিষয় সেটা সে আগে জানতো না। ছেলেটি আরো জেনেছিলো যে তরঙ্গ নিয়ে রয়েছে জটিল গাণিতিক হিসাব। আমিই সেই শিশুটি, যে ডানপিটুনি করে ভর দুপুরে ঘুমন্ত মায়ের চোখ এড়িয়ে চলে গিয়েছিলো পুকুর আর তরঙ্গ দেখতে। আমিই সেই ছেলেটি যে স্কুল জীবনের পদার্থবিজ্ঞান পাঠে বাধ্য হয়ে কসরৎ করে মুখস্থ করেছিলো তরঙ্গের গণিত – ফ্রিকোয়েন্সি, ক্রেস্ট, ট্র, প্রোপেগেশন, এমপ্লিচিউড, ইত্যাদি। তবে আমার মনে একটা প্রশ্ন রয়েই গিয়েছিলো যে, ‘কি এই তরঙ্গ?’
ছোটবেলায় টমাস এডিসন ও আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনী পাঠে প্রভাবিত হয়ে মনে হয়েছিলো, অপার প্রহেলিকার এই প্রকৃতি জগতের সব রহস্যের সমাধান দিতে পারবে কেবল একটি সাবজেক্ট, নাম তার ‘ফিজিক্স’। তাই অভিভাবক ও দরিদ্র দেশের আর্থ-সামাজিক বাধা উপেক্ষা করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম পদার্থবিজ্ঞান-কে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঠে জেনেছিলাম তরঙ্গ আর কিছুই না কেবল একটি ডিসটার্বেন্স যা এগিয়ে চলে আর সাথে করে নিয়ে যায় এনার্জী। ও আচ্ছা! ঐ যে আমি শিশুকালে পুকুরের পানিকে ডিসটার্ব করেছিলাম, আমার সেই ডিসটার্বেন্সটিই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। হু হু ডিসটার্ব না করলে তো আর এমনটি হতো না।
আমি একটি রক্ত-মাংসের মানুষ যার ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে কোন কিছুকে ডিসটার্ব করার। কিন্তু ইচ্ছার স্বাধীনতা নাই এমন অনেক কিছুও প্রাকৃতিক কারণে তার চারপাশটাকে ডিসটার্ব করতে পারে। আর ফল হবে সেই একই, ডিসটার্বেন্সটি ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। এরকম ধারণা থেকেই জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ-এর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কোন চার্জের চতুর্দিকে রয়েছে তার প্রভাব মানে ফিল্ড। ঐ যেমন পুকুর একটি পানির ফিল্ড। তেমনি চার্জের চতুর্দিকে রয়েছে ইলেকট্রিক ফিল্ড। এখন কোনভাবে যদি ঐ ইলেকট্রিক ফিল্ড-টিকে ডিসটার্ব করা যায়, তাহলেই তা তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে, ঐ তরঙ্গের নাম ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। সেটা করার একটি উপায় হলো চার্জটিকে একটু নাড়া দেয়া, ব্যাস ইলেকট্রিক ফিল্ডেও নাড়া পরবে আর তৈরী হবে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। পরবর্তিতে আবিষ্কৃত হয়েছিলো হয়েছিলো সেই ওয়েভ। প্রথম বারের মত মানবজাতি দেখেছিলো যে সাউন্ড ওয়েভ বা ওয়াটার ওয়েভের মত, এর সঞ্চারণের জন্যে প্রয়োজন হয় না কোন মাধ্যমের। যেমনি কয়েক লক্ষ কিলোমিটার দূরের সূর্য মামা থেকে আলো এসে পৌঁছায় আমাদের মর্তের মাটিতে কোনরূপ মাধ্যম ছাড়াই। অবশ্য তারপর আমরা জেনেছি যে আলোও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ।
তাই যদি হয়ে, থাকে তাহলে কোন একটি বডি যার কিনা আছে ভর তার চারদিকে আছে মহাকর্ষ ফিল্ড। ঐ ফিল্ডটিকে যদি কোনভাবে ডিসটার্ব করা যায়, নিশ্চয়ই তা তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। হ্যাঁ, এমন আইডিয়াটিই মাথায় এসেছিলো জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের। বিজ্ঞান দুনিয়ায় পা রাখার পর থেকেই তিনি একের পর এক বলে চলছিলেন সব বৈপ্লবিক ধারণা ও তত্ত্ব। আজ থেকে শতবর্ষ আগে তিনি ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন মহাকর্ষ তরঙ্গ-এর অস্তিত্বের। তবে ধারণা অনুযায়ী ঐ তরঙ্গ এতই দুর্বল যে, কয়েক বছর আগেও বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিলো যে, এমন তরঙ্গ থাকলেও তা ডিটেক্ট করা সম্ভব হবে না।
কিন্তু ঐ যে কথা আছে, ‘থাকলে আবার পাওয়া যাবে না কেন?’ আর সেটাই ঘটলো সম্প্রতি। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) সনাক্ত করলেন তিন বিজ্ঞানী রাইনার উইস, কিপ এস থর্ন, ব্যারি সি ব্যারিশ। কাজটি তারা করেছিলেন ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, এবং ঘটা করে ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দেন। সূর্যের থেকে অনেক গুণ ভারী দুটি কৃষ্ণ গহবরের গতি থেকে থেকে উৎপন্ন এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) শনাক্ত করা হয়। পৃথিবী থেকে এক শত ত্রিশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ওই দুটি ব্ল্যাক হোল একে অন্যের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে একীভূত হয়ে যায়। তাদের এই গতিতে গ্রাভিটিশনাল ফিল্ডে হয় আন্দোলন বা ডিসটার্বেন্স, আর সেটিই তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আলোর গতিতে ধাবমান এই তরঙ্গ পৃথিবীতে আসতে সময় নিয়েছে এতগুলো বছর। এতবড় একটি আবিষ্কার কি পুরষ্কার ছাড়া হতে পারে? তাই গতকাল ৩রা অক্টোবর ২০১৭ সালে নোবেল কমিটি তাদের দিলেন বিরল সম্মাননা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার।
একসময় যেই মহাকর্ষ তরঙ্গ-কে সনাক্ত করা অসম্ভব বলা হয়েছিলো, এখন সেটাই সম্ভব হলো, লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি (লিগো)-তে। ‘লিগো’ কেবল শুরু, ভবিষ্যতে এই জাতীয় অবজারভেটরি মহাশূণ্যে স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে। এভাবে প্রযুক্তি ও মানবজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে আমরা শুনতে পাবো সৃষ্টির আদি বিগ-ব্যাং থেকে শুরু করে মহাজগতের বিবর্তন কোটি কোটি নক্ষত্র-গ্যালাক্সি হয়ে আজ পর্যন্ত গেয়ে যাওয়া সব মহাকাশের দুর্দান্ত সঙ্গীত।
তারিখ: ৪ঠা অক্টোবর, ২০১৭
সময়: গভীর রাত ৩টা ১৯ মিনিট।