কিছু গল্প লেখা যায় না – ১ (ইউক্রেণের ইন্না (পর্ব -ঙ))
কিছু গল্প লেখা যায় না – ১
———————– রমিত আজাদ
ইউক্রেণের ইন্না (পর্ব -ঙ)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পরদিন ইউনিভার্সিটিতে যাইনি। কেন যাইনি সেটা আর মনে নেই। হতে পারে পরীক্ষার সেশন শুরু হয়ে গিয়েছিলো, এবং সেদিন কোন পরীক্ষা, ক্লাস টেস্ট, কনসালটেশন ক্লাস কিছুই ছিলো না। হঠাৎ করে এরকম এক একটা দিন পাওয়া যায়। ঘুমকাতুরে আমি সেদিন একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। হতে পারে সেটা দুপুর বারোটা অথবা একটা। এই শীতের মরশুমে ঘড়ি না দেখে সময় বোঝা মুশকিল! উত্তরের দেশগুলোতে শীতকালে রাত-দিনে আকাশে আলোর তেমন কোন ফারাক থাকে না। রাতের আকাশ বেশী কালো আর দিনের আকাশ কম কালো। দিনের বেলায় সূর্যের মুখ দেখা যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, আকাশ সর্বক্ষণ-ই কালো মেঘে ঢাকা থাকে। প্রকৃতির এই এক খেয়াল! একবার দিল্লী গিয়ে দেখলাম, রাস্তার পাশে পিলারে টেমপারেচার লেখা ৪৫ ডিগ্রী। মনে মনে বললাম, “ওরে বাব্বা!” পরক্ষণেই খেয়াল করলাম যে, একদম গরম লাগছে না! অথবা, যেমনটা ভেবেছিলাম অমনটা গরম না। আমি সেদিন ‘ভাসান্ত বিহার’-এর পার্কে একঝাঁক চেরিফুল গাছের পাশে দুপুরটা কাটিয়েছিলাম, গরমে গা মোটেও পুড়ে যায়নি। অথচ ঢাকাতে এর চাইমে কম তাপমাত্রায় হাঁসফাঁস করি। এটা হয়ে থাকে হিউমিডিটি বেশি হওয়ার কারণে। স্রষ্টা একটা বাড়িয়ে দিলে, আরেকটা কমিয়ে দেন। তাপমাত্রা বেশী তো আর্দ্রতা কম, আবার আর্দ্রতা বেশি তো তাপামাত্রা কম। একইভাবে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে তাপামাত্রা মাত্রাতিরিক্ত কম হওয়াতে, স্রষ্টা সেখানকার আকাশটা ঢেকে দিয়েছেন কালো পুরু মেঘে, যাতে ব্যাক রেডিয়েশন কম হয়, ব্যাক রেডিয়েশন ট্র্যাপড হয়ে গেলে, ঠান্ডা লাগবে কম! কি চমৎকার সুবিচার! বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমি এরকম আরো অনেক কনসিসটেন্সি দেখি, আমাদের এই সুপরিকল্পিত মহাবিশ্বে!
সেদিন ঘুম থেকে উঠে, হালকা নাস্তা সেরে কেবল একটু বসেছি, হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ পেলাম। ভাবলাম কে হতে পারে? তানিয়াদের দল বিকেল বা সন্ধ্যায় আসে ইউজুয়ালী। ছাশা এসময় আসে না। আমার দেশী কেউ? নাহ্, তারাতো এখন যে যার কাজে ব্যাস্ত! তাহলে কে? ইন্না? হ্যাঁ, হতেও পারে ইন্না। কারণ একমাত্র ইন্না-ই এখন ফ্রী আছে। বেড়াতে এসেছে, ওর তো আর কোন কাজ নেই। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে যাকে দেখতে পেলাম, সে ইন্না নয়। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে স্ভেতা। আমি একটু অবাক-ই হলাম! স্ভেতা, এসময় এলো! তাও একা!
আমি: এসো ভিতরে এসো।
স্ভেতা: ধন্যবাদ।
আমি: বসো।
স্ভেতা: (সোফায় বসে) ধন্যবাদ।
আমি একটা চেয়ারে বসে, কয়েক মিনিট চুপ করে রইলাম। স্ভেতাও চুপ করে রইলো।
আমিওকে বোঝার চেষ্টা করলাম। ওর পড়নে ঘরের কাপড় নয়, বাইরের কাপড়। কাধে ব্যাগ। খুব সম্ভবত ও ক্লাস থেকে এসেছে।
আমি: ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলে?
স্ভেতা: হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।
আমি: ক্লাস ছিলো?
স্ভেতা: না। পরীক্ষা ছিলো।
আমি: কেমন হলো?
স্ভেতা: নট ব্যাড।
মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো, মানে ইন্টেলিজেন্ট! কিন্তু মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে না। পড়ালেখায় ওর মনযোগ কম, কিছুটা এলোমেলো। মাঝে মাঝে দেখেছি যে, খুব অস্থির হয়ে পড়ে! ওর কোথায় যেন একটা খটকা আছে! ও একবার আমাকে সামান্য বলেছিলো, কিন্তু তা শোনার আমার তেমন আগ্রহ ছিলো না। স্ভেতা মেয়েটিও বেশ ফুটফুটে, ভরাট শরীর। সেদিক থেকে ইন্না আবার বেশ কিউট এবং ভীষণ স্লিম! স্ভেতার সাথে আমার পরিচয় তো ইন্নার কয়েকমাস আগে। বেসিকালী এই ব্যাচের স্টুডেন্টদের মধ্যে স্ভেতার সাথেই পরিচয় প্রথম। ওকে নিয়ে একবার আইসক্রীম ক্যাফেতেও গিয়েছিলাম। এই দেশের খাঁটি ও পুস্টিকর দুধের আইসক্রীম হয় খুব মজাদার। উপরে সুস্বাদু ভাজা বাদাম ছিটানো আইসক্রীম দু’জনে মিলে বেশ মজা করে খেয়েছিলাম। ‘টুয়েন্টিথার্ড অগাস্ট স্ট্রীট’-এর মলে ও গার্ডেনে বেড়িয়েছিলাম দু’জনে মিলে। সেই গল্প হবে আরেকদিন। আপাতত: আজ ওর দিকে তাকিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এই অবেলায় ও হঠাৎ একা এলো কেন? ওকে কিছুটা বিমর্ষও লাগছিলো!
আমি: চা খাবে?
স্ভেতা: (একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো) না।
আমার মনে হলো, পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে এসে ও এখন ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। আমি বললাম, “পাঁচটা মিনিট সময় দাও আমাকে।”
তারপর উঠে দাঁড়ালাম। ফ্রীজে রান্না করা নুডুলস আছে। আমি ওটা নামিয়ে গরম করলাম। তারপর দুটা বাটিতে বেড়ে পরিবেশন করলাম। একটা বাটি ওকে দিলাম, আরেকটা বাটি আমি নিলাম। এবার আর ও ‘না’ বললো না।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর আমি দুই কাপ চা বানালাম। স্ভেতা চায়ের কাপটা হাতে নিলো।
আমি: নিউ ইয়ার কোথায় করবে? এখানে নাকি, তোমাদের শহরে?
স্ভেতা: এখানেই। ডরমিটরিতে। আমাদের শহরে গিয়ে কি হবে?
আমি: কেনো এতকাল তো ওখানেই নিউ ইয়ার করেছিলে। ওখানে তোমার বন্ধু-বান্ধব আছে না?
স্ভেতা: আছে, তবে তাদের অনেকেও এখন এই শহরে অথবা রাজধানী কিয়েভে আছে। সবাই-ই তো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
আমি: বাড়ীতে নিউ-ইয়ার করতে পারো? তোমার বাবা-মায়ের সাথে?
স্ভেতা: আমি তোমাকে একবার তো বলেছি যে, আমার বাবা থেকেও নেই। আমার মা, সিঙ্গল মাদার। আর আছেন নানা ও নানী। উনাদের সাথে কি আর এখন আমার মিলে?
আমি: সরি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
স্ভেতা: ইটস ওকে। এই ডরমিটরিতে এখন আমার নতুন বন্ধু-বান্ধব হয়েছে। এখানে আমার একটা নতুন জগৎ গড়ে উঠেছে। আমি এবারের নিউ ইয়ার-টা এখানেই পালন করবো।
আমি: ঠিকআছে। জাস্ট জানতে চাইলাম।
স্ভেতা: তুমি তো এখানেই থাকবে।
আমি: হ্যাঁ। এখানেই।
স্ভেতা: কি করবে ঠিক করেছ?
আমি: নাহ্। এখনো কিছুই ঠিক করি নাই।
আমি আসলেই কিছু ঠিক করি নাই। আমি বাংলাদেশী মানুষ, উৎসব বলতে বুঝি ‘ঈদ’। ভোরে উঠে ঈদের নামাজ পড়া, সারাদিন বন্ধুদের সাথে বেড়ানো, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করা, রাতে টিভি প্রোগ্রাম দেখা। এইতো আমাদের উৎসব। আর এদের নিউ-ওয়ার পালন হয় ভিন্ন ধাঁচে। এই ধাঁচের সাথে আমি এখনো ধাতস্থ হতে পারি নাই। কেউ সারারাত নাচে, কেউ মদ খেয়ে বুদ হয়! আর যাদের বান্ধবী আছে, তারা বান্ধবী নিয়ে মধুর রাত্রী যাপন করে! আমি কোন দলেই পড়ি না।
চা শেষ হওয়ার পর স্ভেতা বললো, “এখন উঠি তাহলে?”
আমি: ঠিকআছে, যাও। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি কিছু বলতে এসেছিলে?
স্ভেতা তার সবুজাভ দুটি মায়াবী আঁখি তুলে আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। তবে সেই দৃষ্টির অর্থ আমি ভেদ করতে পারলাম না। এর চাইতে কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ করাও সহজ বোধহয়!
তারপর স্ভেতা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমাকে বললো, “নাহ্! কিছু বলতে আসিনি। এম্নিই এসেছিলাম।”
(চলবে)
রচনাতারিখ: ২৮শে জুলাই (সোমবার), ২০২২ সাল
রচনাসময়: বিকাল ০৩টা ০৪ মিনিট
Some Stories Cannot be Written – 1
————————————– Ramit Azad
পূর্বের পর্বের লিংক: