কৃষ্ণবিবর ও ২০২০ সালের নোবেল পুরষ্কার – পর্ব ১৭
——————————————————- রমিত আজাদ
মহাকর্ষ বল দুর্বল, নাকি সবল?
আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, সবকিছুরই কোন না কোন সীমাবদ্ধতা থাকে। অন্যকথায়, সবকিছুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইটা দিক আছে। আমি একজন খুব দীর্ঘকায় শক্তিশালী ব্যাক্তিকে চিনতাম। দেখে মনে হত এইরকম মাসলম্যান-কে দিয়ে বড়সড় মাস্তানী করা যাবে, অথচ সে ছিলো ভীষণ ভীতু! আবার আরেকজন পুরুষ ছিলো বিশাল-লম্বা চওড়া! কিন্তু বদনাম ছিলো যে, তার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি খুবই ছোট, এবং তিনি ক্রীড়ায় পারঙ্গমও নন, এইরকম নানাবিধ উদাহরণ টানা যায়। এবার পদার্থবিজ্ঞানের কথাই বলি এই যে চারটি মৌলিক বল-এর মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী/সবল যে বল-টা তার নাম সবল পারমানবিক বল (Strong nuclear force)। অথচ তার ‘রেঞ্জ অব এ্যাকশন’ খুবই কম। এতই কম যে সে অতি ক্ষুদ্র পরমাণুর ব্যাস-এর বাইরে আর প্রভাব ফেলতে পারে না। এমনকি বৃহৎ পরমাণুর সীমানারেখায়-ও সে খুব টালমাটাল অবস্থায় থাকে; বিষয়টা এমন যে ওটাকে একটু টোকা দিলেই ভেঙে যাবে। ইউরেনিয়াম পরমাণু এমন একটি। এদিকে বিদ্যুৎ-চুম্বক বল সবলতার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও, সে নিজে দুই প্রকারের, পজেটিভ ও নেগেটিভ; মানে হলো তারা আকৃষ্ট-বিকৃষ্ট দুটাই করতে পারে তাই অনেকগুলো চার্জ একত্রিত হলে একে অপরকে কাটাকাটি করে নিজেদের মোট বল (Net force) খুব কম, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শূণ্যও হয়ে যায়; যেমন আপনার-আমার শরীরে অগণিত ইলেকট্রন ও প্রোটন থাকলেও, তাদের সংখ্যা সমান বা প্রায় সমান হওয়ার দরুণ আমরা কিন্তু মোটেও চার্জড নই, বরং চার্জ নিউট্রাল বা শূণ্য চার্জ । আবার মহাকর্ষ বল সবচাইতে দুর্বল কিন্তু তার ‘রেঞ্জ অব এ্যাকশন’ অসীম! এবং তার কোন পজেটিভ ও নেগেটিভ নাই। তার আছে কেবলই আকর্ষণ, মানে হলো ভরযুক্ত অনেকগুলো বডি একত্রিত হলে তাদের সন্মিলিত (summation) বল শুধু যোগই হবে (বিয়োগ নয়)। এভাবে যেখানে বিপুল পরিমানে ভরযুক্ত কণিকা/পদার্থ আছে তাদের সন্মিলিত বল এতটাই বেশি যে তা আর সব প্রকার বলকে ছাড়িয়ে যাবে! আর এটাই ঘটে থাকে মৃত তারকাদের ক্ষেত্রে। আর এই কারণেই মহাকর্ষ বল মহাবিশ্বের বিবর্তন-কে নিয়ন্ত্রণ করে। পাঠকরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পারছেন যে, কেন এত শত বিজ্ঞানী গবেষণারত আছেন মহাকর্ষ বল নিয়ে।
আমার মাস্টার্স-এর থিসিস পেপার ছিলো ‘কসমোলজি’-র উপর। ঐ পেপার লিখতে গিয়ে প্রথম শুনেছিলাম, পেইনরৌজ ও হকিং-এর নাম, আমার সুপারভাইজার ড. ভ. ম. পিঝ-এর মুখে। ড. পিঝ-ই আমাদেরকে ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ এবং ‘গ্রাভিটেশন ও কসমোলজি’ পড়িয়েছিলেন। পরবর্তিতে জেনেছিলাম যে, ১৯৭০ সালে স্টিফেন হকিং গবেষণা করেছিলেন কৃষ্ণবিবর ও তার চারপাশের বিপুল রাক্ষুসে মহাকর্ষ ক্ষেত্র নিয়ে। এই করতে গিয়ে তিনি কোয়ান্টাম ফিজিক্সের তত্ত্ব ও সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব (মহাকর্ষ তত্ত্ব) দুটাকেই টেনেছিলেন। যা ছিলো ভবিষ্যতের ‘কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব’-এর ছায়া।
আলোকের গতি যদি অসীম হতো:
এই নিয়ে আগেও আলোচনা করেছি। আলোকের গতি যদি অসীম হতো তাহলে আমাদের চোখের বিভিন্ন ঘটনা দেখার যেমন কোন আগে-পরে মানে ধারাবাহিকতা থাকতো না, সবকিছুই ভীষণ এলোমেলো দেখা যেত; তেমনি মহাবিশ্বের কোন বলই তাকে প্রভাবিত করতে পারতো না! কিন্তু আল হাইয়াম যখন বলেই ফেললেন যে আলোর গতিবেগ সসীম এবং বিজ্ঞানী রোমার যখন পরীক্ষার দ্বারাই প্রমাণ করলেন যে আলোর গতিবেগের সুনির্দিষ্ট সীমারেখে রয়েছে, তখন আর সন্দেহ রইলো না যে, আলোকের গতিবেগ প্রভাবিত হতে পারবে। কোন বলের কি রকম প্রভাব আলোর উপর থাকবে সেটা অবশ্য পরবর্তী গবেষণার বিষয়।
মহাকর্ষ কি সত্যিই আলোকে আকর্ষণ করে?
ফোটন নামক কণিকাটির কোন ভর নাই। না থাকারই কথা, কারণ সে পিস্তলের গুলি বা মোটর দানা-র মত মোটেও নয়। আসলে সে ‘প্যাকেট অব এনার্জি’; এনার্জি বা শক্তির কি আর ভর থাকে? আর তাই যদি হবে তাহলে নিউটনীয় মহাকর্ষ ক্ষেত্র তো তাকে টেনে ধরে রাখতে পারবে না! ধরুন, আমরা যদি উপর দিকে একটা গুলি ছুঁড়ে মারি সে কি গতিবেগ কমে কমে একসময় শূণ্য বেগ হয়ে তারপর আবার নীচের দিকে নামতে শুরু করবে না? কিন্তু আমরা যখন কোন শক্তিশালী টর্চ থেকে আলো ছুঁড়ে মারি, কই সে তো আর নীচের দিকে নামে না? নামে না তার কারণই হলো যে, টর্চ থেকে ছোড়া জিনিসটি গুলির মত ভরসম্পন্ন নয়, বরং একটা ভরবিহীন জিনিস।
পরবর্তি প্রশ্নটা হলো, তাহলে এই যে বারবার বলা হচ্ছে যে কৃষ্ণবিবর আলো-কে টেনে তার ভিতর এমনভাবে নিয়ে যায় যে সে আর ওখান থেকে বের হতে পারে না; এই কথার মানে কি? আলো তো মোটরদানা নয়, সে তো ‘ভরবিহীন’ তাহলে কৃষ্ণবিবর তাকে টানবে কি করে? বিষয়টি হলো যে, মহাকর্ষ যদি নিউটনীয় মহাকর্ষ হয়, তাহলে কিন্তু তার আলোকে আকর্ষণ করার কথা না মোটেও। কারণ নিউটনীয় মহাকর্ষ শুধু ভরযুক্ত বডিকেই আকর্ষণ করতে পারে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই বলেছি যে, মহাকর্ষ বিজ্ঞান নিউনীয় বিজ্ঞানের গন্ডি পেরিয়ে আরো উন্নত বা অধিকতর ব্যাপক বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত হয়েছে, যা আলবার্ট আইনস্টাইনের অবদান। তিনি মহাকর্ষ আরো উন্নত বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করেছেন যার নাম general relativity। আর এই নতুন বিজ্ঞান অনুযায়ী মহাকর্ষের কারণ হলো ‘স্থান-কালের বক্রতা’। আলো চলে সোজা পথে কথাটা পুরোপুরি ঠিক না, বরং বলতে হবে যে আলো চলে তার সামনে থাকা সব চাইতে সরল পথটি ধরে। যেমন ধরেন, আপনি মোটর গাড়ী চালিয়ে ঢাকা থেকে পূবাইল যেতে চান, ঢাকা থেকে পূবাইল যদি কোন নাক বরাবর সোজা পথ থাকে, আপনি সময়, শ্রম ও জ্বালানী বাঁচানোর জন্য ঐ পথেই যাবেন। কিন্তু পথ যদি থাকে একটিই এবং সেটি ধনুকের মত বাঁকা, তখন আপনি ঐ পথে যেতেই বাধ্য হবেন। আলোও তেমনি যখন সূর্য বা অন্য কোন মহাকাশীয় ম্যাসিভ বডির পাশ দিয়ে যেতে চায়, ঐ পথটিই বাঁকা। তাই আলো-কে বাধ্য হয়েই ঐ বাঁকা পথটি ধরেই যেতে হবে ( অনেকটা কবি জসীমউদ্দীনের সেই রাখাল ছেলের মত, যে বাঁকা গাঁয়ের পথটি ধরে যায়)। এবার আসুন কৃষ্ণবিবর-এর মত ম্যাসিভ বডির আলোর উপর প্রভাব বিষয়ে। এই দুনিয়ায় কিছু প্যাঁচালো ব্যাক্তি আছে যারা সোজা সমাজটাকে ভীষণ বাঁকা বানিয়ে ফেলে। একবার তাদের পাল্লায় পড়লে আর ঐ বাঁকা পথ থেকে বের হওয়া যায় না! একটি কৃষ্ণবিবর-ও তেমনি তার চারদিকের স্থান-কাল-কে এমনভাবে বাঁকা বানায় যে কৃষ্ণবিবর-এর আওতায় থাকা কোন আলোক রশ্মি আর ঐ বাঁকা পথ পেরিয়ে বাইরে আসতে পারে না! মানে কি? মানে হলো যদি কোন আলো কৃষ্ণবিবর থেকে বাইরে আসতে চায়ও তাহলে স্থান-কাল-এর প্রচন্ড বক্রতার কারণে, সে আবার ঐ কৃষ্ণবিবর-এই ফিরে যায়। ছোট বেলায় বাগাডুলি খেলতাম; দেখতাম কোন কোন মার্বেল কাঠি দিয়ে ছুঁড়ে মারার পর সে নানা পথ ঘুরে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসতো! কৃষ্ণবিবর-এ আলো ফিরে আসার ঘটনাটা এর সাথে উপমেয়। আবার বাইরের কোন উৎস থেকে যদি আলো গিয়ে কৃষ্ণবিবর-এ পড়ে সেও ওখানে ট্র্যাপড হয়ে যায়! আর এই অর্থেই বলা হয় যে, কৃষ্ণবিবর সত্যিকার অর্থেই কৃষ্ণ!
কৃষ্ণবিবর কতটুকু কৃষ্ণ?
“আপনার দেশী ছাতাটির রঙ কি?” “কালো”। কালো মানে তো রঙের অনুপস্থিতি তার মানে সেখানে কোন রঙ নাই! তবে কি ঐ ছাতাটিকে দেখা যাবে না? উত্তর: ছাতাটিকে দেখা যাবে, আবার দেখা যাবে না। হেয়ালী হয়ে গেলো তাই না? আমাদের কলেজে একজন বড় ভাই ছিলেন, উনার গায়ের রঙ ছিলো মিচমিচে কালো। ভালোমানুষ বড় ভাইটিকে আমরা বলতাম, “ভাইজান, আপনি যে কালার কালা, আপনারে তো মশাও খুইজা পাইবো না! আপনের বাপের কিছু টাকা সাশ্রয় হইলো।” বিনয়ী মানুষটি আমাদের কথা শুনে হাসতেন। এখন কথা হলো, উনাকে কি আসলেই দেখা যায় না? দেখা না গেলে আমরা উনাকে চিনতাম কিভাবে? দিনের আলোয় উনাকে ভালো-ই দেখা যেত। তবে রাতের ঘুটুঘুটে অন্ধকারে তিনি একরকম বিলিনই থাকতেন! উনাকে কি মশা আসলেই খুঁজে পেত না? জ্বিনা, মশা উনাকে ঠিকই খুঁজে পেত; কারণ উনাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য মশার আরো অনেক মেকানিজমই ছিলো। রাতের অন্ধকারে উনাকে দেখা না গেলেও, উনার গায়ের ঘ্রাণ, উনার নাসিকার ধ্বনি এবং আরো অনেক বৈশিষ্ট্যই উনার আছে যার সাহায্যে উনাকে ডিটেক্ট করা যাবে। কৃষ্ণবিবর-এর ব্যাপারটাও ঐরকমই। কৃষ্ণবিবর রাতের অন্ধকারে বিলিন হলেও, তার এমন কিছু ভৌত বৈশিষ্ট্য আছে যার সাহায্যে তাকে ডিটেক্ট করা যাবে। আপাতত: তার কিছুই বলছি।
একটি কৃষ্ণবিবর-এর ভিতরের আলো তার বাঁকা পথ পেরিয়ে আর কিছুতেই বাইরে আসতে পারবে না, একথা সত্য তবে, কৃষ্ণবিবর-এর কাছাকাছি চলে আসা কিছু আলো যারা ট্র্যাপড হয়নি, তারা কিন্তু পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। আর সেই পাশ কাটানোটা বিশেষ রকমের হবে। যেমন, ঐ মিচমিচে কালো বড় ভাই রাতের অন্ধকারে মাঠের কোথাও দাঁড়িয়ে আছেন, আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না; হঠাৎ কেউ একটা টেনিস বল ছুঁড়ে মারলো, এবং বলটি সোজা না গিয়ে ঐ ভাইয়ের গায়ে লেগে ডিরেকশন চেইঞ্জ করে আরেকদিকে চলে গেলো; এবার আপনি কি সুস্পষ্টই বুঝতে পারবেন না যে, ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে? এভাবেই কৃষ্ণবিবর-এর পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া আলোকরশ্মিগুলোকে স্টাডি করে বোঝা যায় যে, ওখানে একটি কৃষ্ণবিবর আছে।
আরো একটি বিষয়: মনে করেন যে কোন এক অমাবশ্যার রাতে ঐ মিচমিচে কালো বড়ভাইটি, আপনার গ্রামের মাঠের মাঝখানে বসে আছেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে উনাকে দেখা না গেলেও, কোন এক কারণে যদি উনাকে ঘিরে একদিল জ্বোনাকী উড়তে ও ঘুরতে থাকে, আপনি নির্ঘাৎ টের পাবেন যে ওখানে কেউ আছে। আবার তিনিই যদি একটা জ্বলন্ত সিগারেট টানতে থাকেন, তাহলে সিগারেটের আগুনের নড়াচড়া দেখেও উনার উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে। একইভাবে, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা কৃষ্ণবিবর আছে, যার দিকে সবচাইতে শক্তিশালী টেলিস্কোপ-টি তাক করলেও কালো রঙের কৃষ্ণবিবরটি দেখা যাবে না। কিন্তু বিবরটি এতটাই ম্যাসিভ ও মহাকর্ষ সম্পন্ন যে তাকে ঘিরে অনেকগুলি তারকাই ঘূর্ণায়মান। ঐ ভাস্বর তারকাগুলির ঘূর্ণন দেখেই বাস্তবিক প্রমাণিত হয়েছে যে, কৃষ্ণবিবরের উপস্থিতি ওখানে রয়েছে।
(চলবে)
রচনাতারিখ: ০৭ই নভেম্বর, ২০২০ সাল
সময়: রাত ১১টা ০৭মিনিট
পূর্ববর্তি পর্বগুলো:
https://www.bdeasy.com/