কৃষ্ণবিবর ও ২০২০ সালের নোবেল পুরষ্কার – পর্ব ৫
———————————————– রমিত আজাদ
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ব্ল্যাক হোল-এর ভিতরে কি আছে ও কি ঘটছে, কোন পর্যবেক্ষক তা দেখতে পাবে না। প্রকৃতি সতর্কভাবে এমনই এক আইন বানিয়েছে যে, পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে তা লুকিয়ে রাখা হয়।
এবার প্রশ্ন হলো, পর্যবেক্ষক কেন তা দেখতে পাবে না? এটা ব্যাখ্যা করার আগে কয়েকটি জিনিস ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, এর মধ্যে একটা হলো দেখা বিষয়টি কি? অনেককাল আগে মনে করা হতো যে, মানুষের চোখ থেকে কিছু একটা নির্গত হয়ে কোন বডি-কে আলোকিত করলে তখন তাকে দেখা যায়। কিন্তু আল হাইয়াম ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, মানুষের চোখ থেকে কোন রশ্মি নির্গত হয় না, বরং অন্য কোন উৎস থেকে নির্গত আলোকই কোন বডিকে আলোকিত করে, আর সেই আলো বডিতে প্রতিফলিত হয়ে মানুষের চোখে প্রবেশ করলেই মানব মস্তিষ্কে দর্শনের অনুভূতি জন্মায়।
তার মানে দেখা কর্মটির সাথে আলোর সম্পর্ক গভীর। আলো আছে তাই দেখি, আলো না থাকলে দেখা যাচ্ছে না। আবার কোন একটা বডি আছে, কিন্তু সেখান থেকে আলো এখনও আমাদের চোখে এসে পৌছায় নাই, তাহলেও আমরা তাকে দেখতে পাবো না। আর এই বিষয়ে একটা প্যারাডক্স আছে, যার নাম ‘অলবার্স প্যারাডক্স’। আমার মাস্টার্স-এর থিসিস ছিলো ‘কসমোলজি’-র উপরে। সেখানে যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমি গবেষণা করেছিলাম তার মধ্যে একটি হলো, এই ‘অলবার্স প্যারাডক্স’। এর আরেক নাম হলো “dark night sky paradox”। প্যারাডক্সের বাংলা হলো কূটাভাস – মানে, যা হবে না বলে মনে হয়, তাই বাস্তবে ঘটছে। প্যারাডক্স-টি কি রকম তা আমি সংক্ষেপে বোঝানোর চেষ্টা করছি। দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন যে, এই মহাবিশ্ব অনাদি, মানে এর কোন শুরু নেই, ও শেষও নেই। আমাদের মহাবিশ্বটি অনন্তকাল ধরেই ছিলো। এবার ভাবুন তো, অনন্তকাল ধরে আছে, এই বিশালাকৃতির মহাবিশ্ব। কেবল আমাদের গ্যালাক্সিতেই রয়েছে দশ হাজার কোটি তারকা। আবার পুরো মহাবিশ্বে রয়েছে দুই শত বিলিয়ন গ্যালাক্সি! এবার ভাবুন যে, পুরো মহাবিশ্বে তারকার পপুলেশন কত? আচ্ছা মহাবিশ্ব যদি অনাদিকাল থেকে বিরাজ করতো, তাহলে এই বিলিয়ন বিলিয়ন তারকাদের উৎসারিত সব আলো কি এতদিনে আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌছাতো না? আর তাই যদি হতো, তাহলে রাতের আকাশ কি আর রাতের আকাশ থাকতো? দিনের বেলায় সূর্য নামক একটি মাত্র তারকার আলোতেই কত উজ্জ্বল চারিপাশ! আর রাতের পুরো আকাশটাই যদি তারায় তারায় ভরে যেত, আর তাদের সন্মিলিত আলোকের পরিমানটা কেমন হতো? আজ আমরা রাতের যে কালো আকাশটা দেখছি, ওটা না হয়ে হতো ঘনসন্নিবিষ্ট তারকারাজীর অত্যুজ্জ্বল এক আকাশ। কিন্তু যত্য হলো এই যে, রাতের আকাশ কালো, আর এর একমাত্র ব্যাখ্যা হলো যে, মহাবিশ্ব অনাদি নয়। যা ইমাম গাজ্জ্বালী উনার ‘তাহফুত আল ফালসিফা’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবেই লিখেছেন যে মহাবিশ্ব অনাদি নয়, এর যেমন একটা শুরু আছে, তেমনি একটা শেষও আছে।
এই আলোচনা থেকে আরেকটি বিষয় উত্থাপন করতে চাই। তা হলো কোন উৎস থেকে আমাদের চোখ পর্যন্ত আলো পৌছানোর জন্য আলোর গতিবেগের বিষয়টিও বিবেচনার মধ্যে নিতে হবে। ধরুন যে, কোন উৎস থেকে আলো উৎসারিত হচ্ছে কিন্তু সেটা আমাদের চোখ পর্যন্ত পৌছাতে পারছে না, এটা হতে পারে এভাবে যে, উৎসটা এতই দূরে যে সেখান থেকে আলো এখনো আমাদের চোখে এসে পৌছায় নাই। মনে রাখতে হবে যে এককালে অনেক দার্শনিকই মনে করতেন যে আলোকের বেগ অসীম। তাই যদি হতো তাহলে যে কোন উৎস থেকেই মুহূর্তের মধ্যেই আলো আমাদের চোখে এসে পৌছাত, এবং সাথে সাথে তা আমরা দেখতে পেতাম। এতে কিন্তু মানবজগতে একটা বিশাল বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো। কিন্তু আল হাইয়াম বলেছিলেন যে, আলোকের গতিবেগ যদিও অতি উচ্চ তারপরেও সসীম। তিনি আরো বলেছিলেন যে আলোর সঞ্চালিত হতে সময়-এর প্রয়োজন হয়। এছাড়া এগারো শতকে পলিম্যাথ আল-বিরুণী ও আলোকের গতিকে সসীম বলেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, শব্দের গতিবেগ-এর চাইতে আলোকের গতিবেগ কয়েকগুণ বেশি। প্রসঙ্গত বলছি যে, খুব ছোটবেলায় আমি একবার নদীর ধারে গিয়েছিলাম, সেখানে খুব সম্ভবত কোন এক ধোপা কাপড় ধৌত করছিলো। সে কোন একটি তক্তার উপর কাপড়টি জোরে জোরে মারছিলো। আমি দূর থেকে লক্ষ্য করলাম যে, তক্তার উপর কাপড়ের বাড়ি পড়ার বেশ পরে আমি শব্দটি শুনতে পাচ্ছি! অথচ আমার মন বলছে যে, বাড়ি পড়ার দৃশ্য দেখা ও শব্দ শোনা দুটো-ই একইসাথে হওয়ার কথা। আমার তখন নিজের উপর নিজেরই সন্দেহ হচ্ছিলো! আমার সমস্যা কি কানে, নাকি চোখে? আমি ভেবেছিলাম যে, আমার চোখ ঠিক থাকলে, কান ঠিক নাই; আর কান ঠিক থাকলে, চোখ ঠিক নাই। যাহোক, কয়েক বৎসর পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার চোখ ও কান দুটাই ঠিক আছে। আমি যা পর্যবেক্ষণ করেছি তাও ঠিক আছে। ঘটনাটা শুধু আলোর বেগ আর শব্দের বেগের তফাৎের কারণেই ঘটছে।
যাহোক, আলোর বেগের বৈশিস্ট্য বিষয়টি মুসলিম বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই সমাধান করলেও, সেই জ্ঞান হয়তো ইউরোপ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় নাই। তাই বিষয়টি নিয়ে কয়েক শতাব্দী পরে ইউরোপে আবারও বিতর্কের সুত্রপাত হয়। গ্যালিলিও এবং কেপলার ভেবেছিলেন যে, আলোকের বেগ অসীম; কিন্তু পরবর্তিকালে ১৬৭৬ সালে বিজ্ঞানী রোমার আলোকের বেগের সসীমতা প্রমাণ ও নির্ণয় করেছিলেন।
আলোকের বেগ সসীম বলেই এই মহাবিশ্বে এমন অনেক উৎস আছে যার দূরত্ব মাত্রাতিরিক্ত বেশী হওয়ার কারণে ও সময়ের অপর্যাপ্ততার কারণে সেইসব উৎস থেকে আলো এখনো আমাদের চোখে এসে পৌছায় নাই। আবার হতে পারে যে উৎসটি আমাদের থেকে (অথবা আমরা উৎসটি থেকে) ক্রমশঃই এমনভাবে দূরে সরে যাচ্ছে যে আলো আর আমাদের চোখ পর্যন্ত পৌছাতে পারছে না। এইখানেই চলে আসে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব। অতিরিক্ত গতির কারণে যেমন হয় টাইম ডাইলেশন বা সময় প্রসারণ, তেমনি হয় লেংথ কনট্রাকশন বা দূরত্ব সংকোচন। আর হ্যাঁ, মাত্রাতিরিক্ত মহাকর্ষ বল আলো-কে টেনেও ধরে রাখতে পারে, এবং সময়কেও প্রসারিত করে দিতে পারে; উভয় ক্ষেত্রেই আমরা ঐ দিগন্তরেখার ওপাশে কি হচ্ছে বা কি আছে তা দেখতে পারবো না!
আলোর ডুয়ালিটি
আল হাইয়াম ও নিউটনের মতে আলো হলো এক ধরনের কণিকা। কণিকা হিসাবে তা যদি কামানের গোলা বা মোটর দানার মত হয়, তাহলে মহাকর্ষ দ্বারা তার তো প্রভাবিত হওয়ারই কথা। কিন্তু কই, সূর্য বা নক্ষত্ররা তো আলোকে ধরে রাখতে পারে না! পৃথিবীর দিকে আসার সময় আলো তো আর সব বডির মত ত্বরান্বিত হয় না! পৃথিবী বলি আর নক্ষত্রই বলি কোন কিছুই আলোর গতিবেগকে প্রভাবিত করতে পারে না। তাই আলোর কণিকা ধর্ম নিয়ে সন্দেহ শুরু হলো।
এদিকে ইবনে সাহিল থেকে শুরু করে হুইগেন পর্যন্ত বেশ কিছু বিজ্ঞানী আলোর তরঙ্গ ধর্মকে বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। তাই একসময় আলোকে শুধুই তরঙ্গ (ভরহীন) বলে ধরে নেয়া হলো। ছাইচাপা পড়ে গেলো আলোর কণিকাতত্ত্ব।
এদিকে আইনস্টাইন-এর জীবদ্দশায় ঘটলো একটা ঘটনা। দেখা গেলো যে কোন মেটাল-এর উপর আলো পড়লে সেখানে চল-বিদ্যুৎের (current) জন্ম হয়। এর আগে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের দুইটা পথ জানতাম কেমিকেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চুম্বক ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এবার আরো একটি প্রাকটিকাল মেথড অবজার্ভড হলো। কিন্তু এর ব্যাখ্যাটা কি হবে? তাহলে আগে বুঝতে হবে যে, বিদ্যুৎ কি? এক কথায় বিদ্যুৎ হলো ‘ইলেকট্রনের প্রবাহ’। আগেই বলেছি, ইলেকট্রনের কিন্তু ভর আছে, মানে তার বডি আছে। বডি যদি থাকে তাহলে তাকে ধাক্কা না দিলে তো, সে চলতে শুরু করবে না! তাহলে কি আলো কোন না কোনভাবে মেটালে অবস্থিত ইলেকট্রনগুলোকে ধাক্কা দিচ্ছে? আর ধাক্কাই যদি দিয়ে থাকে তাহলে আলোরও বডি আছে, আলো একপ্রকার ‘কণিকা’। ওরকমই হওয়ার কথা লজিক তো তাই বলে।
এদিকে পরীক্ষার দ্বারাই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে, আলো একপ্রকার তরঙ্গ। এখন তাকে আবার ‘কণিকা’ বলি কি করে? মনে পড়লো আল হাইয়ামের কথা। পরবর্তিকালে স্যার আইজাক নিউটন-ও আলোকের কণিকাতত্ত্বেই বিশ্বাস করতেন। এতকাল পরে আবার সেই কণিকাতত্ত্বের কথা ওঠা মানে, ছাই থেকে ফিনিক্স জেগে ওঠার মত। যাহোক চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রতিভাসটির একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। প্রতিভাবান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন (অথবা উনার স্ত্রী মিলেভা) সেই ব্যাখ্যা সফলভাবে দিতে পেরেছিলেন।
এবার হয়ে গেলো দ্বৈততা। যেমন থিওরেটিকালি, তেমনি প্রাকটিকালি বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত হলো যে আলো এক ধরণের ‘তরঙ্গ’; আবার সেই থিওরেটিকালি, ও প্রাকটিকালি বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত হলো যে আলো এক ধরণের ‘কণিকা’। কি বুঝলাম? দ্বৈততা? জ্বী, এটা দ্বৈততাই। একে বলা হয় আলোকের তরঙ্গ-কণিকা দ্বৈততা।
খটকা কিন্তু দূর হলো না। বিজ্ঞান নামক শাস্ত্রটির জন্ম হওয়ার পর মানবজাতি ধরেই নিয়েছিলো যে এমন একটা সাবজেক্টের জন্ম হয়েছে যে, সেখানে দর্শনের মতন কোন দ্বৈততা নেই। কিন্তু ‘ আলোকের তরঙ্গ-কণিকা দ্বৈততা’ আবার সেই ঘূর্ণাবর্তে নিয়ে যাচ্ছে!
চলবে)
—————————————————————-
রচনাতারিখ: ২৩শে অক্টোবর, ২০২০ সাল
সময়: রাত ১২টা ৪০মিনিট