ডান্ডি কার্ড চেকিং – ৩,৪,৫
ডান্ডি কার্ড চেকিং – ৩
ডান্ডি কার্ড চেকিং-এর উপর আগে দুইটা লেখা দিয়েছিলাম। আজ আরেকটি দিচ্ছি।
বাইরে বের হলে আইডি কার্ড অথবা পাসপোর্ট সাথে নেয়ার বিড়ম্বনায় বহু বছর ছিলাম পরাশক্তি রাশিয়াতে।
খুবই অস্বস্তিকর ও বিড়ম্বনাময় ছিলো বিষয়টি। দিনের মধ্যে কয়েকবার পুলিশের মুখোমুখী হতে হতো, আর তারা আইডি কার্ড/পাসপোর্ট চেক করতো। কিছু পুলিশ ভদ্রসভ্য ছিলো, কিছু ছিলো রাফ! অনেকেরই মাথায় থাকতো যে, কোনভাবে মক্কেল-কে আটকাতে পারলে টু-পাইস ইনকাম হবে! এই নিয়ে বহুবার বহু ভালো/মন্দ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সবগুলো লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে!
আগে চারটা লিখেছিলাম। আজ একটা লিখছি:
ঘটনা ৫:
আমি ও আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী গিয়েছি বাজার করতে। তা বাজারের সামনেই আমাদেরকে আটকালো দুই ইয়াং পুলিশ কনেস্টেবল। সরাসরি বললো, “ভাশে দকুমেন্তি ইয়েস্ত?”। এর ঊর্দু তর্জমা করলে দাঁড়াবে, “ডান্ডি কার্ড হ্যায়?” আমরা দু’জনাই তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র জীবন সমাপ্ত করে পি.এইচ.ডি. গবেষণা করছি। আমি আমার পাসপোর্ট বাড়িয়ে দিলাম। হাতে নিয়ে চেক করলো কনস্টেবল। আমার স্ত্রীর সাথে তখন পাসপোর্ট ছিলো না, কারণ, পাসপোর্ট ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে কোন একটা কাজে। এই রকম সিচুয়েশন হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা ‘বলপত্র’ দেয়া হয়, যেখানে ব্যাক্তির ছবিসহ স্পষ্ট লেখা থাকে যে, ‘এই নাম্বারের পাসপোর্টধারী এই নামের ব্যাক্তি, অমুক দেশের; তার পাসপোর্ট আমাদের দফতরে অমুক কাজে রাখা আছে, এত তারিখ পর্যন্ত থাকবে।’ আমার স্ত্রী বলপত্র-টি দেখালেন। ঐ দেখে কনস্টেবল পেয়ে বসলো! বললো, “না, না, এতে কাজ হবে না। এই বলপত্রের কি মূল্য আছে? পাসপোর্ট-ই লাগবে। যাহোক, আপনি থাকেন, মেয়েটিকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।” ব্যাটার কথা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেলো। আমি ঢাকার ছেলে হলেও, পূর্বপুরুষের বাড়ী বরিশাল। ঐ তেজ আছে কিছু এখনো! রেগে গেলে মেজাজ ঠিক থাকে না!
আমি বললাম, “বলপত্রে তো স্পষ্ট-ই সব লেখা আছে। এরপরেও কথা কিসের?”
কনস্টেবল : আমাদের দরকার পাসপোর্ট। ঐ ‘বলপত্র’ সন্দেহজনক। বিষয়টা ক্লিয়ার করতে হবে। তাই মেয়ে-কে থানায় যেতে হবে।
আমি: মেয়ে-কে নিলে আমাকেও থানায় নিতে হবে। চলেন গাড়ীতে উঠি।
কনস্টেবল : আপনার কাগজ তো ঠিকই আছে। আপনি যাবেন কেন?
আমি: কারণ মেয়েটি আমার বিবাহিতা স্ত্রী। ওকে আমি একা ছেড়ে দিতে পারিনা।
কনস্টেবল এই পর্যায়ে একটু দমে গেলো।
কনস্টেবল: আপনার স্ত্রী? উনার ভিসা/রেজিস্ট্রেশন সব ঠিক আছে কিনা, চেক করা দরকার। পাসপোর্ট-টা কোথায় আছে সেটাও ক্লিয়ার করা দরকার।
আমি: পাসপোর্ট-টা কোথায় আছে সেটা ঐ বলপত্রে ভালোভাবেই লেখা আছে। তাছাড়া উনার ভিসা/রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদির ইনফর্মেশনও ঐ বলপত্রে আছে। বলপত্র কি আমরা বানাই? দেখছেন ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীল-ছাপ্পড় সবই আছে?
কনস্টেবল : বিশ্ববিদ্যালয়?
আমি: হ্যা। আমরা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। যদি বলপত্র-তে আপনাদের সন্দেহ থাকে তাহলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরকে বিষয়টি জানাবো। তাছাড়া আমাদের রেক্টর এখন পুরো রাশিয়ার ‘শিক্ষামন্ত্রী’।
কনস্টেবল : (একটু ধাক্কা খেয়ে) জ্বী, কি বললেন? মন্ত্রী?
আমি: জ্বী, মন্ত্রী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর বর্তমানে এই দেশের ‘শিক্ষামন্ত্রী’।
এবার দু’জন কনেস্টেবল মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।
আসলে ক্ষমতা দিলে একজন কনস্টেবলও প্রমাণ করতে চায় যে, সে-ই সর্বচ্চো ক্ষমতার অধিকারী। কাউকেই সে কোন সম্মান করতে চায় না। ব্যাক্তির মেধা, পেশা, বয়স কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না।
কনস্টেবল: আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর বর্তমানে রাশিয়ার ‘শিক্ষামন্ত্রী’?
আমি: জ্বী।
কনস্টেবল: কোন বিশ্ববিদ্যালয়?
আমি: রুশ গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো। এখান থেকে এক-দেড় কিলোমিটার হেটে গেলেই আমাদের মেইন ক্যাম্পাস।
কনস্টেবল দুজন কয়েক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি: তা এখন কি আমরা গাড়ীতে উঠবো?
কনস্টেবল: না থাক। আপনাদের কথা বিশ্বাস করলাম। এই নিন ‘বলপত্র’। যেখানে যাচ্ছিলেন যান।
উল্লেখ্য: রেফারেন্স ও তেজে বহু দেশেই কাজ হয়!
ডান্ডি কার্ড চেকিং – ৪
রাষ্ট্রদূত মান্যবর ডেকে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। বাংলাদেশ থেকে উনার বড় মেয়ে আর মেয়ে জামাই এসেছেন মস্কো-তে বেড়াতে। পিতৃতুল্য মান্যবর রাষ্ট্রদূত একজন ভালো মানুষ ছিলেন। পাশাপাশি ছিলেন সুবিবেচক। আমি ভোট দেই না, এমন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন তিনি। আমার রাজনৈতিক অবস্থান তিনি ভালোভাবে জানতেন, দুইএকসময় এই নিয়ে বিতর্কও হয়েছে আমাদের মধ্যে। তারপরেও তিনি নানা প্রয়োজনে আমাকে ডাকতেন। আমার সকল অনুরোধও রাখতেন।
উনার স্ত্রী-ও ভালো মানুষ ছিলেন। দুপুর বেলায় উনার নিজ হাতে রান্না ভাত খাওয়ালেন। বড় বড় গলদা চিংড়ি মাছ উনার হাতের রান্না বেশ চমৎকার। সেই স্বাদ এখনও মনে আছে। লাঞ্চ শেষ হলে তিনি বললেন, “বাবা, আমার মেয়ে আর মেয়ে জামাই এসেছেন বেড়াতে। ওদেরকে একটু মস্কোটা ঘুরে দেখাবেন, প্লিজ।” পিতৃ-মাতৃতুল্য ব্যাক্তিদের অনুরোধ কি না রেখে পারা যায়?
যাহোক, উনাদেরকে নিয়ে গাড়ীতে উঠালাম। মেয়ে জামাই আমাদের দেশে বরাবরই একটা ইমপর্টেন্ট পোস্ট, তাই উনার খাতির যত্নের ত্রুটি করতে হয় না। তবে এই দুলাভাই-টি খুব মাই ডীয়ার টাইপের মানুষ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সখ্যতা হয়ে গেলো উনার সাথে। বললাম, ” — ভাই, পাসপোর্ট-ভিসা সাথে নিয়েছেন তো? এই দেশে কিন্তু পথেঘাটে ‘ডান্ডি কার্ড’ চেকিং হয়! জামাই বলে খাতির করবে না কিন্তু!” তিনি হেসে ফেললেন, বললেন, “হ্যাঁ, আমি শুনেছি। সবকিছু আছে সাথে।” বললাম, “চলেন। প্রথমে ক্রেমলিন ও রেড স্কয়ার-টা ঘুরে আসি। ওটাই মস্কোর প্রাণকেন্দ্র!”
গাড়ী থামলো রেড স্কোয়ার থেকে কিছুটা দূরে। হেটে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি, অনেক ভীড়! কি ব্যাপার? আমি উনাদেরকে নিয়ে ঠেলেঠুলে আরো সামনে গেলাম। দেখি পুরো রেড-স্কয়ার ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরা। অনেক ইংলিশ-আমেরিকান ট্যুরিস্টও হা করে দাঁড়িয়ে আছে, ভিতরে ঢুকতে পারবে না বলে আফসোস করছে! ব্যারিকেডের ওপাশে উদ্ধত ভঙ্গিতে পুলিশ দাঁড়ানো। আমি একেবারে ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে একজন পুলিশ অফিসার-কে প্রশ্ন করলাম, “কি বিষয়? রেড-স্কয়ারে ঢোকা যাবে না?” উত্তরে পুলিশ নিরস বদনে বললো, “না, ভিতরে ঢোকা যাবে না। অনুষ্ঠান আছে আজ বিকালে। তাই সকাল থেকেই ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে।” শুনলাম, দুইজন আমেরিকান মহিলা, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। আমি যতটুকু পারা যায়, দূর থেকে বোন-দুলাভাইদেরকে রেড-স্কয়ার আর ক্রেমলিনটা দেখিয়ে, মন খারাপ করে ওখান থেকে সরে আসলাম।
— ভাই আমাকে বললেন, ঐ আমেরিকান মহিলা দুজন কি বলছিলো শুনেছেন?” আমি বললাম, “না। ঠিক খেয়াল করিনি।”
— ভাই আমাকে বললেন, “একজন মহিলা বললো, ‘ব্যাড লাক, উই কান্ট গো ইনসাইড টুডে!’ আর অপর মহিলাটি বলেছিলো, ‘ওহ! দে আর কম্যুনিস্টস। বি হ্যাপী, দ্যাট ইউ আর স্টিল এ্যালাইভ!”
এই এক্সপ্রেশনের ভাবার্থ হলো, ডান্ডি কার্ড চেকিং-ফেকিং তো কিছুই না। তুমি যে বেঁচে আছো, এটাই তো বড় কথা!
আমরা সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম! পর মুহূর্তে আবার ভাবলাম, ‘হোয়াট ইজ কলড হিউম্যান রাইট?”
ডান্ডি কার্ড সমাচার -৫
জনৈকা মহিলা সাংবাদিক কাম অধ্যাপিকা একবার একটি টক শো-তে মরহুম ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্-কে প্রশ্ন করেছিলেন যে, “ঢাকা শহরে ভাসমান মানুষদের আইডি কার্ড থাকা দরকার, অনেক দেশেই তো এটা আছে! আপনি কি বলেন?”
উত্তরে জনাব হান্নান শাহ্ সাফ সাফ বলে দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, ঐ আইডি কার্ড বিড়ম্বনা বিষয়টি অনেক দেশেই আছে। তবে সেটা মূলত আছে সোসালিস্ট কান্ট্রীগুলোতে আছে। একটা গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রে, মুক্ত চিন্তার রাষ্ট্রে এমনটা থাকার কোন সুযোগ নেই।”