নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -১৪)
নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -১৪)
———————————- রমিত আজাদ
আজ লেনা কোথাও যেতে বললে, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না। এমন কি আজ আমি ওর সাথে এক কাপ কফিও খেতে পারবো না। আজ আমি ভীষণ ব্যস্ত। আনিতার কাগজগুলো রেডী করতে হবে। আজও লেনা বরাবরের মতই সুন্দর পাশ্চাত্য পোষাকে সজ্জি. আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে লেনা রুশ ললনা হিসাবে তুলনামূলক শালীন পোষাক পড়ে। টপসটা এমনভাবে পড়ে যে কখনোই ক্লিভেজ দেখা যায় না। আচ্ছাদিত পোষাকেও তার রূপ-ঝলকানি এতটুকুও কমে না। ওর নীল নয়ন, রক্তিমাভা কপোল, গোলাপী তনু, ঈষৎ উন্মুক্ত পেলব বাহু, সবকিছু এতটাই লাবণ্য ভরা যে, যেকোন অসন্যাসী পুরুষেরই ইচ্ছে হবে কোন এক নিরালায় তার সর্বাঙ্গে স্পর্শ বুলিয়ে তার তপ্ত মাধুর্য আর মায়া-যাদু মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করা।
লেনার প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম, “আমি ভালো আছি লেনা। তুমি কেমন আছো?”
নেনা তার সরু ও পাতলা টিন এজড লাইক অধর দুটি খুলে বললো, “মোটামুটি, ভালো।”
কেন ও মোটামুটি আছে, এটা আমি জানি, নিসঙ্গতায় কারই বা ভালো লাগে!
লেনা: তুমি কি এখন ফ্রী?
ওর মুখের আবেগ-দীপ্তি আমি বুঝতে পারলাম বোধহয়। তারপরেও বুকে পাষাণ বেধে বলতে হলো, “আজ রবিবার হলেও আজ আমি ভীষণ ব্যাস্ত লেনা। আজ তোমাকে সময় দিতে পারবো না, রিয়েলি সরি।”
লেনা: রবিবারে কিসের ব্যস্ততা তোমার?
আমি ঠিক কি যে বলে কাটাবো বুঝতে পারছিলাম না। সত্য কথাটা ওকে বলতে চাইনা। এই পৃথিবীতে ১০০% সত্য কথা কে কবে বলেছে? গৃহত্যাগী সাধু হলে সে ভিন্ন কথা, কিন্তু গৃহীরা তা পারে না।
আমার মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো, আচ্ছা এমন রূপসীর তো বয়ফ্রেন্ডের অভাব হওয়ার কথা না। তারপরেও ও আমার প্রতি আসক্ত কেন? তবে কি বিদেশী দেখে লেনা রোমাঞ্চিত হয়েছে?
আমি: লেনা। আমার কিছু দেশী ভাইয়েরা আজ একটা গেট টুগেদার করবে। ওখানে আমাকে দাওয়াত দিয়েছে, তাও ওখানে যেতে হবে। অনেকদিন পরে সবাই একসাথে হচ্ছে আর কি, তাই আমি প্রোগ্রাটা মিস করতে চাচ্ছি না।
একটা সত্য ঢাকতে আরেকটা মিথ্যে বলতে হলো।
লেনা: ও আচ্ছা। যাও তাহলে ওখানে। আমি একটু এইদিকে ঘুরতে এসেছিলাম। এখন তাহলে ঘরে ফিরে যাই। তুমি ফোন কল দিও আমাকে।
আমি: ঠিকআছে। ফোন দেব।
লেনাকে কোনভাবে পাশ কাটিয়ে। কাগজগুলো ফটোকপি করে রুমে ফিরে এলাম।
ততক্ষণে আমার জন্য লাঞ্চ রেডী করে ফেলেছে, বিস্ময়কর সুন্দরী ও সপ্রতিভা আনিতা।
আমি: এই নাও তোমার অরিজিনাল কাগজপত্র। এইখানে একসেট ফটোকপি তোমার, আর এই সেট-টা আমি আমার কাছেই রাখবো।
আনিতা: থ্যাংক ইউ ডিয়ার। এত দেরী হলো যে?
আমি: দুই সেট কাগজ, একটু তো সময় লাগবেই (সব কথা কি আর ওকে বলা যায়?)। বাই দ্যা ওয়ে। তোমার এ্যাম্বেসীর লেটার অব রিকমেন্ডেশন-টা জোগাড় হয়েছে?
আনিতা: হ্যাঁ। যেদিন গেলাম। সেদিনই দিয়ে দিলো। আমাদের এ্যাম্বেসীর মিনিস্টার-কাউন্সিলার ভদ্রলোক খুব ভালো।
আমি: বয়স কেমন?
আনিতা: বয়সসসসস। কেন? উনার বয়স জানতে চাইছো কেন?
আমি: (হাসতে হাসতে কৌতুক করে বললাম) না মানে, তিনি যদি মাঝ বয়সী হন, তাহলে এমন বিস্ময়কর রূপসী দেখে এমনই গলা গলেছেন যে, সাথে সাথেই ডকুমেন্ট দিয়ে দিলেন।
আনিতা কপট রাগের হাসি হেসে বললো, “হু বলেছে, তোমাকে!”
আমি এগিয়ে গেলাম আনিতার দিকে। উদ্দেশ্য ওর কপোলে আমার অধর ছোঁয়াবো। সহসা রক্তিমাভ হয়ে ওঠা ওর কপোল আর আমার অধর যখন ছোঁয়াছুয়ি হলো, হঠাৎ আমার চোখ পড়লো সামনে রাখা দেয়ালের আরশির উপর। ওমা এ কি দেখছি? প্রতিফলন যেন সত্যটা তুলে ধরছে! আমার গাত্রবর্ণ আর আনিতার গাত্রবর্ণ যেন চাঁদের এপিঠ-ওপিঠ, আলো-আঁধারের সহাবস্থান। আমার গায়ের রঙ বাঙালীদের মধ্যে ফর্সাই, মস্কোর ঠান্ডায় আরেকটু উজ্জ্বল হয়েছে হয়তোবা। কিন্তু আনিতার দুধে-আলতা গাত্রবর্ণের জ্যোতির কাছে আমি একেবারেই অমলিন। ঐ প্রতিফলিত দৃশ্যপট আমার মনে কেন যেন এক নতুন রোমান্সের জন্ম দিলো।
“আচ্ছা এখন থাক। আগে লাঞ্চ করি তারপর দেখা যাবে”, বললো লেনা।
লাঞ্চ করতে করতে আমি বললাম,
“পিএইচডি বিষয়ক অফিসের চীফ-এক্সিকিউটিভ কিন্তু একজন লেডি নাম ‘ইরিনা ইভানোভনা’, শোনা যায় যে সে এই ইউনিভার্সিটর প্রো-রেক্টর ‘শিলনোভ’-এর প্রেমিকা। তাই তার ভাবসাবও খুব বেশী ঝামটা-খামটাও অনেক।
আনিতা: শিলনোভ? মেডিকেল ফ্যাকাল্টির প্রফেসর?
আমি: হ্যাঁ, উনিই।
আনিতা: উনার কি বৌ-টৌ কিছু নাই?
আমি: বৌ আছে কিনা আমি জানি না। তবে টৌ আছে। আর ‘ইরিনা ইভানোভনা-ই হলো সেই টৌ। জানৈ তো এইদেশে প্রায় সব পুরুষেরই ঘরের বৌ-এর পাশাপাশি বাইরে দুই-একটা প্রেমিকাও থাকে।
আনিতা: প্রিন্স চার্লস ডায়নাকে কি বলেছিলো জানো?
আমি: ইংল্যান্ডের ঐ বেহায়া-টা?
আনিতা: হ্যাঁ। তার বৌ ডায়না যখন কমিলা-কে নিয়ে অভিযোগ করেছিলো, তার উত্তরে চার্লস বলেছিলো, “তুমি কি এমন কোন রাজা বা প্রিন্সকে জানো, যার মিসট্রেস মানে রক্ষিতা ছিলো না?”
আমি: আর ডায়না কি কম গিয়েছিলো?
আনিতা: মানে কি?
আমি: তুমি হাসনাত খান-এর নাম শুনেছ?
আনিতা: না তো।
আমি: ইমরান খান-এর নাম তো শুনেছ?
আনিতা: ক্রিকেটার ইমরান খান? ওর নাম কে শোনে নাই বলো। দ্যা গ্রেট লেডি কিলার! বাই দ্যা ওয়ে তোমাদের বাঙালী অভিনেত্রী মুনমুন সেন-এর সাথে নাকি ইমরান-এর সম্পর্ক ছিলো?
আমি: থাকতে পারে। একসাথেই তো অক্সফোর্ডে পড়েছিলো দু’জন।
এরপর আমার অন্য একটা ঘটনা মনে পড়লো। আমি বললাম
আমি: ইন্দিরা গান্ধী যখন বিশ্বভারতীতে পড়তো তখন আমাদের দেশের একজন প্রতিভাবান লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীও ওখানে পড়তেন। সৈয়দ মুজতবা আলীও ভীষণ হ্যান্ডসাম ছিলেন!
আনিতা: তুমি কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছো?
আমি: কিছু না। বাদ দাও। তোমাকে যেটা বলছিলাম, ঐ ‘ইরিনা ইভানোভনা’ সম্পর্কে তোমাকে আগেভাগে সাবধান করে দিলাম, পাওয়ারফুল লেডি, তার সাথে হিসেব করে কথা বলবে।
আনিতা: কেন?
আমি: শোন, এতদিন তুমি ছিলে ওনলী ছাত্রী। তাই অনেক কিছু থেকে দূরে ছিলে। এখন জীবনের একটা নতুন স্টেজে উঠছো, তাই জীবন ও পৃথিবীকে নতুন করে দেখতে হবে।
আনিতা: বাব্বাহ্! এতটা সিরিয়াস?
আমি: বিষয়গুলা সিরিয়াস-ই। পিএইচডি শুধুই মেধার উপর নির্ভর করে না। ব্যুরোক্রেসির অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে। আর এই ফর্মার-কম্যুনিস্ট দেশটার ব্যুরোক্রেসি ভয়াবহ। তাই এদেশের ব্যুরোক্রেসি-কে হিসেবে ধরে চলতে হবে।
আনিতা: আমি এখনো ছোট। অতকিছু বুঝি না। আচ্ছা, চলার পথে স্টেপ বাই স্টেপ তুমি সবকিছু বুঝিয়ে দিও।
আনিতার মুখে ‘চলার পথে’ কথাটা শুনে আমার কেমন যেন লাগলো? ওর সাথে কি আমার পথ চলা হবে?
(চলবে)
রচনাতারিখ: ৩০শে জুলাই, ২০২০সাল
রচনা সময়: বিকাল ০৪টা ২৮মিনিট
The Lonely Carnation
——————- Ramit Azad