নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -১৬)
নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -১৬)
———————————- রমিত আজাদ
অনেকটা ধাতব কন্ঠে বলতে শুরু করলেন আনিতার সুপারভাইজার ডক্টর গোর্দিয়েভ, “দেখুন, আমাদের দেশে যখন বিদেশ থেকে ছেলেমেয়েরা আসে তখন তারা বয়সে তরুণ থাকে। তাদের বয়স থাকে উনিশ-বিশ বছর। তারা দেশ ও সবকিছু ছেড়ে একটা অপরিচিত দেশের মাটিতে পা রাখে। এখানে আনিতা নামের এই মেয়েটি এসেছিলো আরো কম বয়সে, মাত্র সতেরো বছর বয়সে। মেধাবী না হলে কোন মেয়ে মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্কুল সমাপ্ত করতে পারে না। মেয়েটি ঐ কাঁচা বয়সে এসেছিলো নিজ দেশ, আত্মীয়-স্বজন এমনকি পিতা-মাতা ছেড়ে। বলা বাহুল্য অন্যান্যদের মত সেও ভীনদেশী মাটিতে পা রেখে একটা ধাক্কা খেয়েছিলো। সব চাইতে বড় ধাক্কাটা হলো, একটি অজানা বিদেশী ভাষা শিক্ষা করে ঐ ভাষায় উচ্চশিক্ষার বইগুলা পড়া ও ক্লাস করা। কাজটা অতটা সহজ নয়, যেখানে আমাদের দেশীয় ছাত্রছাত্রীরা নিজ মাতৃভাষায়ই লেখাপড়া করে থাকে। জনাব ডীন, লক্ষ্য করে দেখুন যে, মেয়েটার রেজাল্ট এভারেজ ছিলো শুধু প্রথম দুইটা বছরে, আর থার্ড ইয়ার থেকে তার রেজাল্ট বিস্ময়করভাবেই ভালো। তার মানে কি? মেয়েটা আসলেই মেধাবী, ভাষাগত ব্যারিয়ারের কারণে সে প্রথম দিকে পিছিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু যখনই সে ব্যারিয়ারটিকে অতিক্রম করতে পেরেছে তখনই তার গতি ত্বরান্বিত হয়েছে, এবং আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন যে, সাম্প্রতিক ডিফেন্সে মেয়েটার থিসিস পেপার বিস্ময়করভাবে ভালো ছিলো, আপনি নিজেও তো তার রিসার্চের প্রশংসা করেছিলেন! জনাব ডীন, ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’। আনিতার শেষ ভালো ছিলো। এই বিবেচনায় আমি অনুরোধ করছি, তার স্কলারশীপ অনুমোদন করতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আনিতা পিএইচডি গবেষণাও ভালো করবে।”
ডক্টর গোর্দিয়েভ-এর এই ধারালো বক্তৃতা আর উপেক্ষা করার মত ছিলো না। জ্ঞানী-গুণি অধ্যাপকদের এই সভার সকলেই কয়েক মুহূর্ত নিস্তদ্ধ হয়ে রইলেন। তারপর ডীন আস্তে আস্তে বললেন,
ডীন: ডক্টর গোর্দিয়েভ, আপনি কি আনিতার দায়িত্ব নিতে রাজী আছেন?
গোর্দিয়েভ: জ্বী আমি রাজী আছেন (দৃপ্ত কন্ঠে)
ডীন: তাহলে আর কি? স্কলারশীপ অনুমোদন করা হলো।
এই বলে তিনি পেপারে স্বাক্ষর করলেন।
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, এবং মনে মনে অসীম খুশী হলাম। আমি জানতাম পিএইচডি-র এই পার্ট-টা মানে স্কলারশীপের অনুমোদন পাওয়াটা একটা বড় বিষয়। স্কলারশীপ পেলে অনেকেরই মেধা স্ফুরণের সুযোগ হয়ে যায়, আবার কেবল স্কলারশীপ না পাওয়ার কারণেও অনেকেই পিছিয়ে পড়ে। যাহোক, আনিতা ভাগ্যবতী, জীবনে একটা বড় সুযোগ পেলো।
আমি আনিতার সুপারভাইজার ডক্টর গোর্দিয়েভ-কে খাস করে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি বললেন যে, ধন্যবাদের কিছু নাই, এটা উনার দায়িত্ব, আনিতা উনার মেয়ের মত। উনার নিজের মেয়েও রিসেন্টলি ‘মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি’ থেকে পিএইচডি শেষ করেছে।
আমি আনিতার রুমে গেলাম। আনিতা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। ওর চোখেমুখে উৎকন্ঠা!
আনিতা: কি হলো। কি সংবাদ?
আমি ভাবলাম, ওকে প্রথমে একটু ঘাবড়ে দেব কিনা? তারপর ভাবলাম, নাহ ঠিক হবে না, বেচারী এত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে!
আমি: মিঠাই কাহা হ্যায়?
আনিতা: বাহ্, বেশ তো হিন্দি বলছো! যো, মিঠাই কা বারে মে বোলতা হ্যায়, তো জরুর খোশ খবরী হ্যায়!
আমি: হাঁ, খোশ খবরহি হ্যায়।
আনিতা: তো বলো।
আমি: তোমার স্কলারশীপ-টা ফ্যাকাল্টি এ্যাপ্রুভ করেছে।
আনিতা: হুররা!!!!!!!!!!!!!!!!!
তার পরের অংশটা আর পাঠকদের বলতে চাই না। সেই চিরন্তন নারী-পুরুষ আবেগঘনতার আলিঙ্গন ও চুম্বনসুধার উত্তাল তরঙ্গ সঞ্চালন!
আমি: চলো।
আনিতা: কোথায়?
আমি: যদিও এখনো রেক্টরের স্বাক্ষর বাকি আছে। তবে আশা করি তা হয়ে যাবে, ফ্যাকাল্টি এ্যাপ্রুভ করলে উনারা আর না বলেন না। কয়েকদিন পরে চিঠি পেয়ে যাবে আশা করি। আজ আমি সামান্য সেলিব্রেট করতে চাই। চলো বাইরে কোথাও খেয়ে আসি।
আনিতা: কোথায় খাবে রোস্টিকস?
আমি: চিকেন উইং ফ্রাই? তোমার ভালো লাগে? ঠিকআছে চলো তাহলে ওখানেই যাই।
আনিতা বাইরের পোষাক পড়ে তৈরী হওয়ার পর। আমরা দুজনা নিচে নেমে এলাম। আনিতাকে বললাম যে আমাকে একটু আমার রুমে যেতে হবে টাকা আনতে। আমরা দুজনা হাটতে হাটতে, আমার ডরমিটরি পর্যন্ত গেলাম। দুজনাই ভিতরে ঢুকলাম। আনিতাকে বললাম, “তুমি নিচতলাতেই থাকো আমি চট করে, আমার রুম থেকে আসছি।”
হঠাৎ আমার চোখ পড়লো লেটার টেবিলটার উপরে। এখানকার ডরমিটরিগুলার নিচতলাতে একটা লেটার টেবিল থাকে। সেই টেবিলে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে লেখা বাইরে থেকে আসা চিঠিগুলা ছড়িয়ে রাখা থাকে। যার চিঠি সে নিয়ে নেয়। আমি দেখলাম ওখানে বাংলাদেশ থেকে আসা একটা ইনভেলাপ রাখা আছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম স্পষ্ট ইংরেজীতে আমার নাম লেখা। বাম পাশে লেখা প্রেরকের নাম, ‘মোনালিসা রহমান’। আনিতাও আমার সাথে এগিয়ে এসেছিলো, সেও নাম দুটা পড়লো। আমি চিঠিটা হাতে নিলাম, মুহূর্তেই অনেক কিছুই আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো! আনিতা জানতে চাইলো, “কে মেয়েটি?”
আমি কিছু বললাম না।
রোস্টিকস-এ গিয়ে চিকেন ফ্রাই নিয়ে আমরা বসলাম। তবে আমার মনটা আজ বারবার বিক্ষিপ্ত হচ্ছিলো। তার কারণ ছিলো ঐ চিঠিটা। চিঠিটা আমি এখনও খুলে পড়ে দেখিনি। জাস্ট রুমে রেখে নিচে নেমে এসেছি। মেয়েটা এতগুলো বছর পরে আমাকে মনে করতে গেলো কেন? চিঠি লিখতে গেলো কেন? আর আমারও কপাল! আনিতা যখন আমার সাথে ঠিক তখনই আনিতার সামনেই চিঠিটা হাতে পড়লো!? একটু আগে বা পরে হলেও তো পারতো!
আনিতা: তোমার মনটা দেখছি বারবার অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে।
আমি: না তা না।
আনিতা: আমি তো দেখছি। তুমি বারবার অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছ। আচ্ছা ঐ চিঠিটার সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে কি?
আমি মনে মনে একটু ক্ষেপলাম, আমার যেখানে দুর্বলতা সেখানেই ও আঘাত করছে!
বললাম, “না, চিঠিটা আমি এখনও খুলেই দেখিনি।
আনিতা: কে মেয়েটা?
আমি: ঢাকাতে আমাদের প্রতিবেশী এক মেয়ে। আমরা পারিবারিকভাবে ক্লোজ।
আনিতা: তোমার সাথে কি স্পেশাল কোন রিলেশন?
আমি: বাদ দাও। পরে বলবো তোমাকে। তবে আপাতত বলছি, আমাদের মধ্যে তেমন কিছু ছিলো না।
আনিতা: তুমি বলছো, ‘তেমন কিছু ছিলো না’, কিন্তু তুমি বলোনি যে, ‘কিছুই ছিলো না’।
আমি চুপ করে রইলাম।
আনিতার মনে একটা চিন্তার রেখা দেখলাম!
আজ ক্রেস্তের ক্যাফেতে গিয়ে দেখলাম। কস্তুরী আপা বসে আছেন। কস্তুরী আপা একজন ডাক্তার। আপাতত মস্কোতেই আছেন উনার ব্যবসায়ী স্বামীর সাথে। কস্তুরী আপা খুব সহজ-সরল আর হাসিখুশী একজন মানুষ। উনাকে সহজে ক্ষেপানো যায় না। তবে একটা বিষয় ছাড়া, উনার গ্রামের বাড়ী নোয়াখালী, আর এই নিয়ে যদি আমরা কৌতুক করি তাহলে তিনি ভীষণ ক্ষ্যাপেন। কস্তুরী আপার বাসায় একবার আমরা দলবল নিয়ে দাওয়াত খেলাম খাওয়া শেষ আমি বললাম, “দাওয়াতের খাওয়া শেষ এখন আমি ঘরে যাই।” একজন আমাকে বলে, “আপনি দেখি নোয়াখাইল্লা হয়ে গেলেন! খেয়েদেয়েই দৌড় দ্যান!” এই কথা শুনে সবাই কোরাসে হাসলো। দু;একজন আবার আড়চোখে কস্তুরী আপার দিকে তাকালো। কস্তুরী আপা গেলেন ক্ষেপে, বলেন, “হাসো, হ্যা হ্যা কইরে হাসো!!!” আপার উচ্চারণে কিছুটা আঞ্চলিকতার টান আছে, এই নিয়েও অনেকে মজা করে। রান্না করতে যাওয়ার সময় কস্তুরী আপা বলেন, “যাই, আমি একটু ফাক করি আসি।” আমাদের জুয়েল ভাই বলেন, “আর আমিও অপেক্ষা করি!” কস্তুরী আপা কিছু না বুঝে মিটমিট করে তাকালেন, আর আমরা হাসতে লাগলাম। তবে যাই বলি না কেন, কস্তুরী আপা আমাদের সবার প্রিয়। বিদেশে একটা বড় বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, কস্তুরী আপা আমাদের সেই বড় বোন।
আমি ক্যাফেতে ঢুকতেই কস্তুরী আপা বলেন, “আরে আসো আসো, তোমার জন্যিই অপেক্ষা খরতাছিলাম।” আমি বললাম “সালাম আপা, কেমন আছেন?” আপা বলেন, “আমি বালোই আছি। তুমি খেমন আছো?”
আমি: জ্বী, ভালো আছি।
কস্তুরী আপা: ভালো থাকারই খতা। সুন্দরী বান্ধবী থাকলে তো বালোই থাকবা।
আমি একটু চুপ মেরে গেলাম। মাঝে মধ্যে আবার কস্তুরী আপার মুখে ট্যাক্স থাকে না। ফট করে একটা তিন নাম্বার কথা বলে ফেলেন।
কস্তুরী আপা: বুজলা নি? এই যে হাসমত যে কাজটা খরতাসে, তারে একটু বুজাইয়া বলা দরকার।
আমি: কি বোঝাবেন?
কস্তুরী আপা: মলি মাইয়াটা বাংলাদেশ থেইকা নতুন আইছে। ইয়াং মাইয়া, সুন্দরী মাইয়া। ও কি আর হাসমতের লগে যাইবো নি?
আমি: কেন, হাসমত ভাই খারাপ কিসে? লেখাপড়া জানা মানুষ, কোয়ালিফাইড।
কস্তুরী আপা: আরে লেখাপড়া তো ইখানে সবাই জানা। তার মতো খাটো মানুষেরে মলি পছন্দ করবো?
আমি: আরে খাটো তাতে কি? আমিও তো বেশি লম্বা না।
কস্তুরী আপা: তুমি বেশি লম্বা না অইলেও তুমি তো স্মার্ট-টেস্মার্ট আছো। হাসমত তো তাও না।
আমি হেসে ফেললাম। নিজের প্রসংশা শুনতে সবারই ভালো লাগে। তবে আমি হাসলাম কস্তুরী আপার কথা ও ভঙ্গি শুনে। আমার গুমোট মনটা কিছুটা শান্ত হলো!
রচনাতারিখ: ০১লা আগষ্ট, ২০২০সাল
রচনা সময়: রাত ১২টা ২৯মিনিট
The Lonely Carnation
——————- Ramit Azad