নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -১৮)
নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -১৮)
———————————- রমিত আজাদ
হাটছিলাম মস্কোর একটি নির্জন রাস্তার পাশের ফুটপাত ধরে। তখন রাত নয়টা হবে। আকাশে ঘন অন্ধকার! হঠাৎ একটা জীপ আমার পাশে এসে থামলো। আমি লক্ষ্য করলাম পুলিশের জীপ। কালো পোষাক পড়া দু’জন পুলিশ লাফ দিয়ে জীপ থেকে নামলো। দুজনার কাধেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। একজন আমার সামনে আরেকজন, আমার পাশে দাঁড়ালো, এবং পাশেরজন তার কাঁধের অস্ত্রটির উপর তার একটা হাত রাখলো। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। তাহলে কি আজ কোন অঘটন ঘটতে যাচ্ছে? এমনতো ইদানিং প্রায়শঃই ঘটছে!
মস্কো শহরের একটা বৈশিস্ট্য হলো আপনি শহরের প্রাণকেন্দ্রের পাশেই হাটছেন, অথচ আপনার মনে হতে পারে আপনি শহরতলীর মধ্য দিয়ে হাটছেন। চওড়া রাস্তা, দুইপাশে চার সারিতে গাছ, পথচারীর সংখ্যা কম। আবার শহরের মধ্যেই কিছু এলাকা রয়েছে যেগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া। সেগুলোতে লোকবসতি প্রায় নাই, তাই সন্ধ্যা আটটার পরই রাস্তাঘাট জনশূণ্য হয়ে পড়ে। এরকম একটা এলাকা হলো ‘মাগিস্ত্রালনায়া’। এক সময় এখানে প্রচুর মিল ইন্ডাস্ট্রীজ ছিলো, বিগত পরিবর্তনে অনেক মিল ইন্ডাস্ট্রীজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এলাকা আছে, বিল্ডিংগুলোও আছে। তাই দালানের ইনচার্জ-রা ওগুলো ভাড়া দিতে থাকে, কিছু কিছু আবার বিক্রিও হয়। ভাড়া বা কিনে থাকে নব্য ধনী ব্যবসায়ীরা। তারা আবার তাদের অফিসগুলো এখানে সেট-আপ করে।
‘দ্বিতীয় মাগিস্ত্রালনায়া’ সড়কের একটা অফিসে দাফতরিক কাজে আমার যাতায়াত রয়েছে। ঐদিন কিছুটা দেরী হয়ে গেলো। বাইরে এসে বাস স্টপেজে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, কিন্তু কাজ হলো না এই রুটে বাস চলে খুব কম। এখানে ট্যাক্সিও খুব একটা চলে না। আমি সামনের দিকে হাটতে শুরু করলাম। একটাই ভরসা, যদি কোন প্রাইভেট কার চলার পথে লিফট দেয় সামান্য ভাড়ার বিনিময়ে। আবার মাইক্রোবাস গণপরিবহন মাঝে মাঝে থামিয়ে যাত্রী নেয়।
মস্কো বা রাশিয়ায় নানান লেভেলের সন্ত্রাসী কার্যক্রম দিনদিন বাড়ছেই। তাই সরকার থেকেই পুলিশের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পুলিশও রয়েছে নানান ধরনের। সিটি পুলিশ সম্ভবত নগর মেয়রের কমান্ড মানে, তিনি ন গরীর নিরাপত্তার জন্য পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছেন বলে শোনা যায়। অনেক পুলিশ রয়েছে যারা আট-দশজনের একটা ট্রুপ করে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। যেমন মেট্রো-স্টেশনের বাহির বা প্রবেশমুখে, চৌরাস্তার মোড়ে, বাজার বা মার্কেটের সামনে, আন্ডারপাসের ভিতরে, ইত্যাদি। কিছু পুলিশ হেটে হেটে টহল দেয়, আবার কিছু পুলিশ জীপ বা গাড়ী নিয়ে পেট্রোলিং করে। আগে পুলিশের গাড়ী ছিলো লাবড়া-জাবড়া, ইদানিং পুলিশকে বাহারী ফোর্ড গাড়ী দেয়া হয়েছে! তাদের ক্ষমতা রয়েছে, যে কাউকে যে কোন জায়গায় থামিয়ে তার ডকুমেন্ট চেক করা। অতীতে কোন একসময় সাথে শুধু স্টুডেন্ট কার্ড রাখলেই, এখন কড়া নির্দেশ বিদেশীদেরকে সাথে পাসপোর্টই রাখতে হবে। যে কোন পুলিশ ভিসা থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত সবই চেক করবে। মস্কোতে বসবাসরত যেকোন বিদেশীকেই দিনে কয়েকবার পুলিশের ডকুমেন্ট চেকিং-এর শিকার হতে হয়।
আর এটার ভয়াবহ সুযোগ নিচ্ছে একদল অসৎ পুলিশ। সবাই একরকম তা বলছি না, তবে সবখানেই সৎ-অসৎ রয়েছে। অনেক অসৎ পুলিশই ডকুমেন্ট হাতে নিয়ে বলে, এই পাসপোর্ট-ভিসা সবই তো ভূয়া, তোমাকে এখন থানায় যেতে হবে। তারপর কিছুক্ষণ ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিছু টাকা খেয়ে তারপর ভিক্টিম-কে ছেড়ে দেয়। এরকম বেশ কিছু ঘটনার নিউজ শোনা গেছে যে, নির্জন রাস্তায় কাউকে পেয়ে, তার টাকা-পয়সা সবকিছু কেড়ে নিয়েছে পুলিশ। সবচাইতে ভয়াবহ যেটা সেটা হলো নির্জন রাস্তায় কাউকে পেয়ে পুলিশ তাকে পিটিয়ে আধমরা করেছে।
এ মুহূর্তে আমার সামনে পাশে যে দুজন পুলিশ দাঁড়ালো তারা দুজনই খুব ইয়াং কারো বয়সই পঁচিশের ঊর্ধ্বে হবে না। এই আরেকটা সমস্যা! একসময় দেখতাম পথেঘাটের এইসব ডিউটিতে বয়ষ্ক পুলিশদেরকে দেয়া হতো, তাদের অভিজ্ঞতা ও বিবেচনাশক্তি বেশি থাকে। কিন্তু ইয়াংদের সেটা থাকে না, বরং তারা নানা কারণে অবিবেচক ও মারমুখী হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই ক্রাইসিসের সময় রাশিয়ার পুলিশ বাহিনী নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে!
পুলিশের মুখোমুখী হওয়া, ডকুমেন্ট চেকিং-এর মুখোমুখী হওয়া আমার এই প্রথম নয়। আগেই বলেছি, এটা আমাদেরকে দিনের মধ্যে কয়েকবার হতে হয়। কিন্তু এমন নির্জন রাস্তায়, একা পুলিশ কার ও চারটি পুলিশের (আরো দুজন গাড়ীতে বসে ছিলো) মুখোমুখী হওয়া এই প্রথম। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত হলাম। আমার দুটা এ্যাসেট আছে – এক. স্মার্টনেস, দুই. ভালো রুশ ভাষা বলতে পারা। আমি মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে এই দুটা হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হলাম।
পুলিশ ১: আপনার ডকুমেন্ট দেখান।
আমি জ্যাকেটের ভিতরের বুক পকেট থেকে আমার সবুজ বাংলাদেশী পাসপোর্ট-টি বের করে পুলিশের হাতে দিলাম।
পুলিশ ২: বিদেশী?
আমি: জ্বী।
পুলিশ ২: কোন দেশ।
আমি: বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ শব্দটা শুনলে পুলিশের মধ্যে দুইটা প্রতিক্রিয়া হয় – ১. এরা নিরীহ, ভয়াবহ কোন নেশায় আসক্ত থাকে না, ২. তবে এদের অনেকেরই এখানে থাকার লিগাল ডকুমেন্ট নাই। আমার দুইএকজন আমলা বন্ধুদের কল্যাণে এটা আমি জানি।
পুলিশ ১: আপনার ভিসা-রেজিস্ট্রেশন কোন পাতায় আছে?
আমি খুব স্মার্টলি তাকে পাতাটি বের করে দিলাম।
আমি: এইতো আপনাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সীল।
পুলিশ ২: কি করেন? স্টুডেন্ট?
আমি: না ঠিক স্টুডেন্ট নই! এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি বিষয়ে গবেষণারত।
পুলিশ দুজন দুজনার দিকে তাকালো।
পুলিশ ১: কোথায় বলেন তো?
আমি জানি এটা তাদের ইন্টারোগেশনের স্টাইল। ভূয়া লোক হলে ঠিকমত নাম ঠিকানা বলতে পারে না।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও ভৌগলিক অবস্থান বললাম। চেষ্টা করলাম যতটা সম্ভব চোস্ত রুশ ভাষায় বলতে।
আমার সামনের পুলিশটি মুচকি হাসলো। অন্যজন প্রশ্ন করলো, “কোন সাবজেক্ট?”
আমি: ফিজিক্স।
এবার দুজনাই হাসলো। একজনার হাসিতে দাঁতের মারি বেরিয়ে পড়লো। আমি জানি এরা ফিজিক্স সাবজেক্ট-টাকে বেশ ইজ্জ্বত করে। সবারই ধারণা ফিজিক্স-এর ছাত্ররা ভীষণ মেধাবী।
এখন তাদের অনেকটাই নমনীয় দেখলাম।
পুলিশ ১: আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
আমি: ওদিকেই যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে।
পুলিশ ২: গাড়ীতে বসেন। আপনাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দেই।
আমি আবার ভয় পেলাম। এটাও অনেক সময় ট্রিক হয়। গাড়ীতে বসিয়ে পুলিশ যে কোথায় নিয়ে যাবে উপরওয়ালাই মালুম!
আমি: না থাক আপনারা আর কষ্ট করবেন কেন? এম্নিতেই গাড়ীতে জায়গা কম। আমি একটা যানবাহন পেয়ে যাবো।
পুলিশ দুজন তাদের গাড়ীতে উঠে গেলো। ঠিক সাথে সাথেই একটা মাইক্রোবাস আমার সামনে এসে থামলো। মনে হলো যেন উপরওয়ালা আমার জন্য মাইক্রোবাসটি নাজিল করেছেন। আমি চট করে ওটায় উঠে গেলাম।
ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছেড়ে গেল!
ডরমিটরিতে ফিরে দেখলাম, আনিতা ভিসিআর চালিয়ে একটা ফিল্ম দেখছে। ফিল্মের সে খুবই ভক্ত, তবে ইউজুয়ালী রোমান্টিক ফিল্মই বেশি দেখে। আমি একবার ওকে ‘দি মেসেজ’ ও ‘স্পার্টাকাস’ দেখিয়েছিলা। আরেকবার ওই আমাকে রোমের পাগলা সম্রাটকে নিয়ে ফিল্ম ‘কালিগুলা’ দেখিয়েছিলো। ঐ ফিল্মটা সেমি-পর্ণো টাইপ। আসলে সেখানে সেই সময়ের রিয়েল রোমকেই চিত্রায়িত করেছিলো। হাসতে হাসতে আনিতা বলেছিলো যে ও আর মারিতা একবার হলে গিয়েছিলো সিনেমা দেখতে। আর সেখানে এই ‘কালিগুলা’-ই চলছিলো। এ্যামনই এ্যারোটিক ফিল্ম যে মেয়েরা দ্রুতই হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলো, আর পুরুষরা সব রয়ে গিয়েছিলো।
আজ আনিতা দেখছিলো, ফিল্ম ‘জুলিয়াস সিজার’। ইতিহাসের এই চরিত্রটা আমার কাছেও বেশ ইন্টারেস্টিং! সাদা-কালোয় মিশ্রিত ধুসর এক চরিত্র এই সিজার। জুলিয়াস সীজার ও ব্রুটাস-এর পুরো কাহিনীটিই চমকপ্রদ।
এনলাইটেনড ডিক্টেটর-এর কনসেপ্ট-টি ব্রুটাসই প্রথম সিজারের মাথায় ঢুকিয়েছিলো, প্লেটোর রিপাবলিক পড়ে। আর সেই ব্রুটাস-ই আবার রোমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজ পিতা সিজার-কে হত্যা করেছিলো। কয়েকজনার পর ব্রুটাস সিজারকে ছুড়িকাঘাত করতে এলে সিজার অবাক হয়ে বলেছিলো, “এত তু ব্রুতে?!” (ব্রুটাস তুমিও?!) কোন কোন বইয়ে লেখা হয় যে, সিজার বলেছিলো, “তুমিও আমার পুত্র?!”
সীজার ও ব্রুটাস এর মধ্যে পিতা-পুত্র সম্পর্কে ছিলো কিনা, এটাও ইতিহাসের পাতায় ধোঁয়াশা। তবে ব্রুটাস-এর মাতা যে সিজারের চিরকালীন প্রেমিকা ছিলো, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আর ঐরসজাত না হলেও ব্রুটাস বড় হয়েছিলো সিজারের নিজ সন্তানের মতই। কেন সিজারকে এইভাবে হত্যা করা হলো, এই প্রশ্নের জবাবে ব্রুটাস বলেছিলো, ‘রোমের সবচাইতে সুন্দরী তরুণীটির চাইতেও অধিক কাম্য ছিলো রোমের গণতন্ত্র’!
এটা বোধহয় সব যুগেই প্রযোজ্য! আমাকেও যদি প্রশ্ন করা হয়, “তুমি কাকে বেশি কামনা করো; আনিতা, লেনা, মোনালিসা নাকি গণতন্ত্র?” আমি উত্তরে গণতন্ত্র-ই বলবো।
(চলবে)
রচনাতারিখ: ০৩রা আগষ্ট, ২০২০সাল
রচনা সময়: রাত ১০টা ৪৫মিনিট
The Lonely Carnation
——————- Ramit Azad