নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব – ২১)
———————————- রমিত আজাদ
আনিতা: এখন ঝাড়বাতি-টার নতুন রঙিন বাল্বগুলো খুব সুন্দর হয়েছে!
রাশিয়াতে অল্পদামে খুব সুন্দর সুন্দর ঝাড়বাতি পাওয়া যায়। এই কারণে প্রায় সব ঘরেই একাধিক ঝাড়বাতি রয়েছে; এমনকি স্টুডেন্ট ডরমিটরিতেও অনেক রুমেই বাহারি ঝাড়বাতি থাকে। আমার রুমেও একটা সুদৃশ্য ঝাড়বাতি ছিলো। আজ হঠাৎ ওটার বাল্বগুলো পাল্টে নতুন কিছু রঙিন বাল্ব লাগালাম। আনিতা সেটার কথাই বলছিলো।
আমি: একটা জোক মনে পড়লো।
আনিতা: কি জোক?
আমি: নতুন যৌবনপ্রাপ্ত একটা মেয়ে মনে মনে বাসনা করছে যে, ‘কবে আমার একটা বয়ফ্রেন্ড হবে, যে আমার হাত ধরে বেড়াবে, যে আমাকে কফি খাওয়াবে, যে আমাকে ফুল কিনে দেবে, আর মাঝে মধ্যে আমাকে সিলিং ফ্যান দেখাবে!’
আনিতা: (রিনরিন শব্দ করে হেসে ফেললো। লাজুক দৃষ্টিতে তাকালো) তুমি না মাঝে মাঝে ভীষণ দুষ্ট!!!
আমি: এখন কি তুমি চাও যে, আমি তোমাকে সিলিং ঝাড়বাতি দেখাই?
আনিতা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। এই হাসির মানে হলো ‘অনুমতি দেয়া গেলো’।
——————————————————
পরবর্তি মঙ্গলবার আমি আর লেনা ডিপার্টমেন্টে বসলাম। অপেক্ষাকৃত বড় একটা ব্যাগ সাথে এনেছে লেনা। সেখান থেকে একগাদা কাগজ বের করলো সে। আমার অবস্থাও তথৈবচ! দু’জনার কাগজগুলো বের করে যখন টেবিলের উপর রাখলাম, তখন সেখানে শুধু কাগজ আর কাগজ। থিওরেটিকাল ফিজিক্সের গবেষণার অবস্থাটাই এই, কাগজে কাগজে সয়লাব!
লেনা: (ঠোট কিঞ্চিত বিকৃত করে) শুধু কাগজ আর কাগজ; কাগজ আর কাগজ!
আমি: হ্যাঁ। কাগজে কাগজে সয়লাব!
লেনা: যদি কাগজ খাওয়া যেত, আমাদের তাহলে আর ক্ষুধার ভয় থাকতো না!
আমি: হ্যাঁ, ভালোই বলেছে! থিওরেটিকাল ফিজিক্স মানেই ঘর ভরা কাগজ, আর মাথা ভরা অংক।
লেনা: হু। ফিজিসিস্ট-রা কথাও বলে অংকের ভাষায়!
আমি: (হেসে বললাম) এই নিয়ে একটা জোক আছে, শুনবে?
লেনা: (উৎসাহী হয়ে) বলতো।
আমি: কোন এক ফিজিসিস্ট কাম গণিতবিদ তার নতুন গার্লফ্রেন্ড-কে বলছে, “আমি তোমার সাথে পরিচিত হতে চাই।” গার্লফ্রেন্ড বলে, “আমরা তো পরিচিতই।” গণিতবিদ – “না, মানে খুব ঘনিষ্টভাবে পরিচিত হতে চাই।” গার্লফ্রেন্ড – “আমরা তো এখন অনেকটাই ঘনিষ্ট।” গণিতবিদ – “আরো ঘনিষ্ট হতে চাই, এতটাই ক্লোজলি পরিচিত হতে চাই যেন, আমাদের মধ্যে দূরত্ব হয় মিনিমাম, মানে শূণ্য; এমনকি কিছু কিছু পয়েন্টের ভ্যালু যেন নেগেটিভ মানও ধারন করে!”
কৌতুকটা আদিরসিক, কিন্তু লেনা হাসি চাপতে না পেরে রিনরিন করে হেসে উঠলো। এরপর লাজুক ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমরা দুজনাই কিন্তু ফিজিসিস্ট!“
ডিপার্টমেন্টের কাজ সেরে ক্যাফেতে গেলাম। আমরা বসার সাথে সাথেই ক্যাফের সাউন্ডবক্সে একটা পপুলার রুশ প্রেমের গান বেজে উঠলো! গানটির নাম, ‘মালচিক মই’। আমি আর লেনা মনযোগ দিয়ে গানটা শুনতে লাগলাম। ক্যাফেতে বসে থাকা বেশিরভাগই চুপচাপ শুনছিলো গান-টা। গানটি গাইছে একটা মেয়ে, গানের কথায় সে তার প্রেমিক-কে স্মরণ করছে।
‘প্রেমিক আমার, বৃষ্টির সঙ্গীত আমাকে বলবে, তোমার কি হয়েছে।
প্রেমিক আমার, আমাকে স্মরণ করো,
তুমি এখন অনেক অনেক দূরে,
এতগুলো দিন, নাকি বছর?
তুমি এখন অনেক অনেক দূরে,
বৃষ্টির ছটা আছড়ে পড়ে আমার জানালায় নক করছে,
এই হেমন্ত তোমার সব চিহ্ন ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
রাত নামবে, তারা জাগবে, তুমি স্বপ্নে আমাকে দেখবে,
প্রেমিক তুমি বেদনার্ত হও,
হয়তো সেটাই তোমার আঁখি খুলে দেখাবে আমার সিক্ত হৃদয়।’
গানটা চলার সময় মাঝে মাঝে লেনা আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। আমি জানি না, লেনা কি ভাবছে। কেন যেন মনে হয় আমি জানতে চাইও না। কি এক দোলাচলে আছি আমি! কি চাই, আর কি চাইনা; মাঝে মাঝে আমি নিজেও তা জানি না!
————————————————————————
ক্রেস্তের ক্যাফেতে আড্ডা জমেছে ধুম!
নাসির ভাই: বুঝলেন ভাই, লুঙ্গি সমাচার।
আমি: এই শীতের দেশে আবার লুঙ্গি সমাচার কিসের?
নাসির ভাই: যে সকল পুরুষ লুঙ্গি পড়েই না। ট্রাওজার বা শর্ট প্যান্ট পড়ে ঘুমায়৷ এদের নাকি আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে!
আমি: সত্য কথা যদি বলি, আমি আসলে সুন্নত হওয়ার পর কিছুদিন লুঙ্গি পড়ে ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু অভিজ্ঞতা ভালো না; ঘুম থেকে উঠে যা দেখতাম তাতে বুঝতাম আমাকে দিয়ে আর যাই হোক লুঙ্গি ম্যানেজমেন্টের কাজ হবে না! সেই থেকে ট্রাওজার বা শর্ট প্যান্ট পড়েই ঘুমাই৷
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো!
নাসিম ভাই: তা ভাই, লুঙ্গি ম্যানেজ করতে না পারলেও, অন্য সব ম্যানেজমেন্টে তো আপনি ভালোই দক্ষ!
আমি: না ভাই। বাইরে থেকে অনেক কিছুই মনে হয়, ভিতরে কিন্তু নড়বড়ে অবস্থা!
টিটো: যেমন?
আমি: এই যে ধরুন মতের মিল বলে একটা বিষয় আছে। ছেলে ছেলে বন্ধুত্বে এটা নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামায় না। কিন্তু, নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিষয় যখন আসে, তখন কিন্তু বিষয়টা সিরিয়াস!
নাসিম ভাই: হ্যাঁ, ভাই আমার ফিলিং-ও একই কথা বলে।
এজাজ: মিলিয়ে নিয়ে চলা যায় না?
নাসির ভাই: ঐ মিলাতে গিয়েই তো যত ঝক্কি! মনের মিল হলেও, মতের মিল হওয়া অত সহজ নয়!
আমি তখন ভাবছি, আমার সাথে আনিতার মনের মিল হলেও মতের মিল কেন হবে? আমরা দু’জন তো দুই সত্তা। আমার জীবন, আমার শিক্ষা, আমার সংস্কৃতি, আমার ঐতিহ্য, আমার অভিজ্ঞতা, আমার চিন্তাধারা এবং অপরদিকে তার জীবন, তার শিক্ষা, তার সংস্কৃতি, তার ঐতিহ্য, তার অভিজ্ঞতা, তার চিন্তাধারা সবই তো ভিন্ন! এই চরম সত্যটা তো অনস্বীকার্য্য! অনেকেই প্রেমের মায়াজালে পড়ে ঐ সত্যটাকে এড়িয়ে যায়, অথবা এড়িয়ে যেতে হয়। অথবা ঐ সত্যটাকে চিন্তাভাবনা করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করেই না!
যেমন, আমি ফিজিক্সের ছাত্র। তাই লজিক খুব পছন্দ করি ও বুঝি। অযৌক্তিক কোন কিছু আমার মনে ধরে না!
যদিও আনিতা নিজেও বিজ্ঞানের ছাত্রী, তারপরেও অংকে সে কাঁচা; আর ফিজিক্স ভীষণ ভয় পায়। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে, যারা অংকে কাঁচা তারা লজিকেও খুব দুর্বল হয়।
আমার কেন যেন মনে হয়, এই দুনিয়ায় বেশীরভাগ নারীই গণিতে কাঁচা, এ্যাকর্ডিংলি লজিকেও দুর্বল!
এই বিল্ডিং-এ আর্টস-এর ক্লাস হয় মূলত। তাই এখানকার মেয়েদের রূপের ঝলকই আলদা। ক্যাফেতে বসে আড্ডা দেয়ার পাশাপাশি, ছেলেরা সবাই রূপের পূজারী হয়ে চোখের ব্যায়াম করে।
আমার বিগত দিনের একটা ঘটনা মনে পড়লো। একদিন ইউনিভার্সিটির পথে দেখি, একটা ইয়াং কাপল যাচ্ছে কোমর জড়িয়ে ধরে খুব পেয়ার করে। কাপল-এর ছেলেটাকে আমি চিনতাম, কেমিস্ট্রি ডিপার্টেমেন্টের ছাত্র, মাঝে মাঝে আমাদের ডরমিটরিতে আসতো। মেয়েটাকে আজ প্রথম দেখলাম। বুঝলাম, মেয়েটা ওর বান্ধবী। মেয়েটাকে দেখে মনে হলো যে, পুরাই রাক্ষুসী। আমার সাথে দেখা হলে, ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে এলো, বলে “আজ আমার পরীক্ষা বুঝলি? তা আমার প্রেমিকা বলেছে যে, আজ আমি পরীক্ষাটা খুব ভালো দেব, তার মন বলে।”
আমি মনে মনে বলি, “যে রাক্ষুসী প্রেমিকা তোমার! ওরে পাইলা কোথায়?”
সে ছিলো প্রথম যৌবনের কথা। তখন বুঝতাম কম, বলতাম বেশী। এখন বুঝি প্রেমিক বা প্রেমিকা দেখতে কে কেমন সেটা বড় কথা নয়। ভালোবাসাটাই বড় কথা!
(চলবে)
——————————————————–
রচনাতারিখ: ১৮ই আগষ্ট, ২০২০সাল
রচনা সময়: রাত ০৮টা ২০মিনিট
The Lonely Carnation
——————- Ramit Azad