নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -৩)
নিঃসঙ্গ কার্নেশন (পর্ব -৩)
—————————- রমিত আজাদ
সন্ধ্যার দিকে ডরমিটরিতে ফিরলাম। চাবি দিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে দেখি ভিতর থেকে লক করা। বুঝলাম আনিতা এসেছে। আমি দরজা নক করতেই আনিতা দরজা খুললো। একগাল মিষ্টি হেসে বললো, “আমরা আগে থেকেই এসে গেছি।”
আমরা মানে?
আমি তাকিয়ে দেখলাম পেরুর মেয়ে মারিতা ওখানে বসা। আনিতা আর মারিতার ভীষণ বন্ধুত্ব। ওরা দুজন দেখতে আবার কাছাকাছি। তাই অনেকেই কনফিউজড হয়ে মারিতাকে আনিতা ভাবে, আর আনিতা-কে মারিতা ভাবে। একবার একজন আমাকে বলে, “আপনার বান্ধবী আনিতা-কে গত রবিবার ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে দেখলাম।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “গত রবিবার তো আনিতা আমার সাথেই ছিলো!” সেও অবাক হলো, তারপর কনফিউশন দূর হতে দুজনাই হেসে ফেললাম।
পাঠকদের অনেকে মনে করতে পারেন যে, ভারতীয় মেয়ে আর ল্যাটিন আমেরিকান মেয়ে দেখতে একই রকম হয় কি করে? বিদেশে এসে বিষয়টা দেখে আমিও প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। আসলে ল্যাটিন আমেরিকানদের মেজরিটিই দেখতে দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশের মানুষদের মত। কথিত আছে যে, কয়েক হাজার বছর আগে এশিয়ানরাই আমেরিকাতে মাইগ্রেট করেছিলো। তাই চেহারা ও জিনে মিল রয়েছে।
যাহোক। মারিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন আছো?”
মারিতা: ভালো আছি।
আমি: কিছু খেয়েছ? আনিতা ওকে কিছু খেতে দিয়েছ?
মারিতা: না, এখনও কিছু খাইনি। আমরা আসলে এসেছি বেশি সময় হয়নি।
আনিতা: ওয়েল আমি কফি বানাচ্ছি।
আমি: আমি সুইট রোল এনেছি। কেটে দাও।
আনিতা তো আমার সাথেই সময় কাটায়। মারিতা মাঝে মাঝে আসে। যেইদিন আসে বেশি সময়ই থাকে। আমরা অনেক গল্প-টল্প করি।
আমি: মারিতা ইন্ডিয়ান ফিল্ম দেখবে?
মারিতা: ইন্ডিয়ান ফিল্ম তো আমি খুবই পছন্দ করি। দেশে থাকতে আমি ও আমার মা হলে গিয়ে ইন্ডিয়ান ফিল্ম দেখতাম। আর খুব করে কাঁদতাম।
আমি: কাঁদতে কেন?
মারিতা: ওমা। কাঁদবো না। তোমাদের ছবিগুলা তো সবই কান্নার? হাসির কোন ছবি বানাও তোমরা? হাসির ছবি তো ফ্রেঞ্চরা বানায়।
এই একটা সমস্যা! মারিতাকে কখনো-ই বোঝাতে পারিনি যে, বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়া এক না। বোঝাতে গেলেও ও বলে, “এটা তোমাদের ব্যাপার। আমার কাছে দূর থেকে একরকমই লাগে। এই যে তুমি আর আনিতা, দেখতে ভাই-বোনের মত লাগে!”
আমি বলি, “এ আবার কি? প্রেমিকাকে বোন বানিয়ে দিলো!”
যাহোক, আমি ভিসিআর-এ একটা বোম্বাই ফিল্ম চালু করলাম।
আনিতা: কি ম্যুভি ওটা?
আমি: ‘নিকাহ্’।
আনিতা: সালমা আগার?
আমি: হ্যাঁ।
আনিতা: ওয়ান্ডারফুল! সবাই মিলে দেখবো এখন ফিল্মটা।
ফিল্ম শুরু হতে হতে আমার বাংলাদেশী বন্ধু মুস্তাফিজ এসে ঢুকলো। আমার বন্ধুটি খুবই ভালো মানুষ! লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট। দেখতে শুনতে হ্যান্ডসাম। তবে একটাই খুঁত অথবা গুন, ওর আলুর দোষ রয়েছে! বান্ধবীর কোন অভাব নাই। মারিতা-কে দেখে মনে হয় সে প্রসন্ন হলো। ওর কাছাকাছিই বসলো। ফিল্ম তো হচ্ছিলো ঊর্দু ভাষায়। মুস্তাফিজ ঊর্দু কম বোঝে। তারপরেও সে মারিতাকে ডায়লগ ট্রান্সলেট করে দিচ্ছিলো। উদ্দেশ্য মারিতাকে পটানো।
আনিতা অল্প সময়েই চা-কফি, সুইট রোল, বিস্কিট, চানাচুর, ইত্যাদির আয়োজন করে ফেললো। তারপর আমি আর আনিতা এক সোফায় বসলাম। মারিতা পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসেছে। তার কাছেই মুস্তাফিজ বসেছে খাটে।
একসময় সিনেমাটার মধ্যে ডুবে গেলো সবাই। ছবিটা এতটাই মনোমুগ্ধকর যে কারো আর চোখের পলক পড়ে না। মাঝখানে একবার আমি সবার জন্য আরেক কাপ কফির ব্যবস্থা করলাম। ছবির শেষে দেখলাম মুস্তাফিজের মনটা খারাপ। আর মারিতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। আমি ভান করলাম যেন মারিতার চোখের পানি দেখেনি। মুস্তাফিজকে বললাম, “কিরে তোর মন খারাপ কেন?”
মুস্তাফিজ: নাহ্। ভালো ছবি। নায়িকাটার জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেলো!
বুঝলাম। মানুষ মানেই মানুষ। যতই আলুর দোষ থাকুক, ওরও তো মন আছে, আবেগ অনুভূতি আছে!
তিন ঘন্টার ছবি শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেলো। মারিতা বললো, “এখন আমি উঠি।” আমি বললাম, “ওকে।”
মুস্তাফিজ: মারিতা তুমি কোথায় থাকো? ১১ নাম্বার বিল্ডিং-এ?
মারিতা: হ্যাঁ, ওটাই তো গার্লস হোস্টেল। আমি ওখানেই থাকি।
মুস্তাফিজ: আমি থাকি ১০ নং বিল্ডিং-এ। চলো তোমাকে পৌঁছে দেই।
আমি মনে মনে বললাম, “যাও। ওর সাথে যাও। যাওয়ার পথে ওকে পটাও। দেখো, আজই তোমার রুমে নিতে পারো কিনা!”
মুস্তাফিজ ও মারিতা চলে গেলো। আনিতা আমার সাথে রয়ে গেলো।
নেক্সড মঙ্গলবারে আমি একটি আগে আগেই ফ্যাকাল্টিতে গেলাম। আমার সুপারভাইজার আরো আগে থেকেই ছিলেন। তিনি আমাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝাচ্ছিলেন। ফিজিক্স স্কুল জীবন থেকেই আমার প্রিয় সাবজেক্ট। আমি ফিজিক্স খুব এনজয় করি। কিন্তু আজ আমার ফিজিক্সে মন বসছিলো না। প্রায়ই ইতিউতি তাকাচ্ছিলাম। আমার সুপারভাইজার বললেন, “কি ব্যাপার? আজ আপনার একদম মন নেই দেখছি?”
আমি: জ্বীনা। মন থাকবে না কেন? আপনি বলুন আমি শুনছি।
এই বলতে বলতেই লেনা রুমে ঢুকলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। ও আবারও সেই মৃদু মিষ্টি হাসিটি উপহার দিলো।
ইরমোলায়েভ: আরে ইয়েলেনা যে। বসো বসো, তোমার জন্য একটা টপিক সিলেক্ট করেছি।
লেনা: থ্যাংক ইউ।
ইরমোলায়েভ: আর শোন তোমাদের দুজনকেই বলছি। এখন থেকে আমরা সপ্তাহে দুদিন দেখা করবো। মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার ঠিক আছে?
আমরা দুজনাই একসাথে বললাম, “ঠিক আছে।”
ইরমোলায়েভ: তুষার তুমি একপাশে বসো, আমি ইয়েলেনা-কে টপিকটা বুঝিয়ে দেই।
আমি একপাশে বসে ফিজিক্স বাদ দিয়ে ইয়েলেনার রূপ ঝলকানী দেখতে লাগলাম! আজ ও পড়েছে জিনস-এর একটা কম্বিনেশন। এই জিনস-টা বেশী আকাশী রঙের। তবে ওকে মানিয়েছে বেশ। কম্বিনেশনের নীচে টপস-টা নেভী ব্লু কালারের। ওর ড্রেসের কালার কম্বিনেশন খুব সুন্দর হয়।
আমার একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো। একজনকে প্রশ্ন করা হয়েছে,
: তোমার নতুন গার্ল ফ্রেন্ডের বয়স কেমন?
: ইয়াং। আমার চাইতে তিন বছরের ছোট।
:তোমার নতুন গার্ল ফ্রেন্ড দেখতে কেমন?
:খুব সুন্দরী!
: তা, তোমার নতুন গার্ল ফ্রেন্ড পোষাক কেমন পড়ে?
: খুব তাড়াতাড়ি!
নিজের মনে নিজেই হাসলাম।
সুপারভাইজারের সাথে লেনার কথা শেষ হলো। তারপর তিনি বললেন, “আজ আমি গেলাম। আপনাদের সাথে দেখা হবে নেক্সট বৃহস্পতিবার। ঠিকআছে?”
আমরা দুজনাই সমস্বরে বললাম, “খুবই ঠিকআছে!”
সুপারভাইজার হাসি চাপতে পারলেন না। তারপর তিনি প্রস্থান করলেন।
ঐ মুহূর্তে ঐ রুমে শুধু আমরা দুজন। অখন্ড নীরবতা। আমি লেনার দিকে তাকিয়ে আছি। লেনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
লেনা: কি?
আমি: কি?
লেনা: কিছু বলবে না?
আমি: কি বলবো?
লেনা: কই আমাকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দেবে না?
এবার আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
আমি: আরে অবশ্যই অবশ্যই। চলো যাই কফি খেতে যাই।
লেনা তার ব্যাগটা হাতে নিলো। আমরা বাইরে করিডোরে বের হতে লেনা বললো, “আমার ব্যাগটা একটু ধরতো। চুলটা ঠিক করে নেই। আমি ওর ব্যাগটা হাতে নিলাম। ও চুল ঠিক করলো। তারপর বললো, “দাও ব্যাগ দাও।”
আমি: থাক। আমিই ক্যারি করি ব্যাগটা।
একটু সামনে যেতে লক্ষ্য করলাম একটি রুশ মেয়ে আমাদেরকে খুব মনযোগ দিয়ে দেখছে। মেয়েটাকে চেনা চেনা মনে হলো কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, ওকে কোথায় দেখেছি, বা ও কে।
ক্যাফেতে গিয়ে কর্ণার টেবিলে আমাদের পরিচিত জায়গাটায় বসলাম। কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে দুজনায় গল্প করতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে আমি বললাম,
আমি: আমি খুব বই প্রিয়। বই পড়তে ও কিনতে আমার খুব ভালো লাগে।
লেনা: কোথায় বই কেন তুমি?
আমি: একটু দূর হয়ে যায়। পার্ক কুলতুরী মেট্রোর কাছে একটা দোকান আছে। ওখানে কিনি।
লেনা: এতদূর যাওয়ার কি আছে? কাছেই তো বড় দোকান আছে।
আমি অবাক হলাম।
আমি: মেট্রো শাবলোভ্স্কায়া দিয়ে আমি প্রতিদিন হেটে হেটে ফ্যাকাল্টিতে আসি। ইচ্ছে করেই ট্রামে চড়ি না। কই কোনদিন তো কোন বইয়ের দোকান দেখলাম না!
লেনা: ঐ দিকে নাই।
আমি: তা কোন দিকে আছে?
লেনা: এই ফ্যাকাল্টির পারপেনডিকুলার একটাভ রাস্তা আছে দেখেছো?
আমি: দেখেছি মানে? আমি ঐ রাস্তা দিয়ে হেটে যাইও মাঝে মাঝে। দানস্কৈ মনাস্ট্রী-র পাশের রাস্তাটা তো?
লেনা: তোচ্না (একজাক্টলি)!
আমি: ঐ রাস্তা ধরে বরাবার হাটলে লেনিন এ্যাভিনিউ-তে গিয়ে হিট করবো।
লেনা: হ্যাঁ। ঐ লেনিন এ্যাভিনিউতেই বড় একটা বইয়ের দোকান আছে।
আমি: চিনি না।
লেনা: সমস্যা কি? আমি চিনিয়ে দেব।
আমি: কবে?
লেনা: আজই।
আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “তোমার আজ কোন ব্যস্ততা নাই?”
ও একটা নীরব এক্সপ্রেশন দেখালো। তার মানে হলো, ‘যতই ব্যস্ততা থাকুক। আজ আমি তোমার সাথে যাবো।’
আমি: ওকে। যাবো নে বইয়ের দোকানে একসাথে।
তারপর বললাম,
আমি: তুমি কি কোন চাকরি-বাকরি কিছু করো?
লেনা: হ্যাঁ। একটা ছোট চাকুরী করি।
আমি: কোথায়?
লেনা: ঐ যে তোমরা শীতকালে হিটারে গরম পানি পাও। যা দিয়ে প্রতিটি বাড়ী বা প্রতিটি ডরমিটরির প্রতিটি রূম গরম থাকে।
আমি: গরম পানি প্রোডিউস করার ইন্ডাস্ট্রী?
লেনা: হ্যাঁ। ইন্ডাস্ট্রী বলতে পারো।
আমি: পাশাপাশি পিএইচডি করছো। ভালো তো। তা ইন্ডাস্ট্রী-তে ফ্যাকাল্টিতে আসার জন্য ছুটি পাও।
লেনা: হ্যাঁ পাই। দেয় ওরা ছুটি। অফিসারটা বয়স্ক ভালো মানুষ। কলিগরাও ভালো। আমি যতক্ষণ না থাকি ওরা সামলে নেয়।
ঘন্টাখানেক ক্যাফেতে বসে কফি খেলাম। তারপর লেনা-কে বললাম, “চলো, বইয়ের দোকানে যাই।”
বাইরে বেরিয়ে লেনা বললো, “ট্রামে উঠবে না?”
আমি বললাম, “না। অল্প পথ। আমার হাটতেই ভালো লাগে। তোমার আপত্তি আছে?”
লেনা: না, আপত্তি নাই। আমারও হাটতে ভালো লাগবে।
সামান্য কিছুদূর যাওয়ার পর, রাস্তাটা একটা পার্কের পাশ দিয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন রাস্তা ছেড়ে পার্কের উপর দিয়ে হাটতে লাগলাম। আমি আর লেনা পাশাপাশি।
(চলবে)
রচনাতারিখ: ২৩শে জুলাই ২০২০ সাল
রচনা সময়: রাত ৯টা ১০ মিনিট
Lonely Carnation
————————- Ramit Azad