
পবিত্র লাইলাতুল মিরাজ ও সময়ের আপেক্ষিকতা: পর্ব ৫
পবিত্র লাইলাতুল মিরাজ ও সময়ের আপেক্ষিকতা: পর্ব ৫
———————— ড. রমিত আজাদ
আপনি হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে আছেন। একটি গাড়ী বুলেটের মত সাঁ করে আপনার পাশ দিয়ে চলে গেলো। সাথে সাথে বেজে উঠলো হুইসেল। টহল পুলিশ গাড়িটিকে থামিয়ে দিলো। তার অপরাধ, নির্দিষ্ট স্পিড লিমিট সে ভায়োলেট করেছে। ঐ হাইওয়েতে গাড়ীর সর্বচ্চো গতিবেগ ৮০ মাইল পার ঘন্টা। অথচ তার গতিবেগ ছিলো ১০০ মাইল পার ঘন্টা। এদিকে ঐ গাড়ীর পিছু পিছু আসা আরেকটি গাড়ীর কাছে মনে হলো, ওকে থামালো কেন, ও তো মাত্র ত্রিশ মাইল পার ঘন্টা বেগে যাচ্ছিলো? দ্বিতীয় গাড়িটির গতিবেগ আপনার কাছে মনে হয়েছিলো ৭০ মাইল পার ঘন্টা। তৃতীয় আরেকটি গাড়ী আসছিলো প্রথম গাড়িটির মুখোমুখি, তার কাছে মনে হয়েছিলো প্রথম গাড়িটির গতিবেগ ১৫০ মাইল পার ঘন্টা। আপনার কাছে মনে হয়েছে তৃতীয় গাড়িটির গতিবেগ ৫০ মাইল পার ঘন্টা। মজার ব্যাপার তাইনা? গতিবেগ একেক জনার কাছে একেক রকম। এরকমই হওয়ার কথা, কারণ গতি ও গতিবেগ আপেক্ষিক। গতিবেগ সব সময়ই মাপা হয় অন্য একটি কায়ার সাপেক্ষে। আলোকের গতিবেগ নিয়ে কাজ চলছিলো অনেক আগে থেকেই। আল হাইয়াম বলেছিলেন যে, ‘আলোর গতি অতীব উচ্চ তবে সসীম’। গ্যালিলিও গ্যালিলেই (1564 – 1642) আল হাইয়াম-এর কয়েকশত বছর পরে আলোর গতিবেগ মাপতে গিয়ে হিমসীম খেয়ে শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন যে, ‘আলোকের গতিবেগ অসীম’। আজ আমরা জানি যে, গ্যালিলিও-র এই স্টেটমেন্ট সঠিক নয়, আল হাইয়াম-ই ঠিক বলেছিলেন। পরিমাপ করে পাওয়া গেছে যে, আলোকের গতিবেগ ১৮৬০০০ মাইল পার সেকেন্ড। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে যদি একটি আলো ছুঁড়ে মারি তাহলে চাঁদে পৌঁছাতে তার সময় লাগবে মাত্র দেড় সেকেন্ড। এবার স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, গতিবেগ তো আপেক্ষিক, তাহলে আলোকের গতিবেগ ১৮৬০০০ মাইল পার সেকেন্ড কার সাপেক্ষে? উত্তরটি হলো, আলোকের গতিবেগ ১৮৬০০০ মাইল পার সেকেন্ড যে কারো সাপেক্ষেই। মানে? মানে হলো এখানেই ইঙ্গিত আছে, সময়ের আপেক্ষিকতার।
আমি ক্লাসরুমে পড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করে দেখেছি যে, স্কুল-কলেজ জীবনে ক্যালকুলাস পড়ে এসেছে এমন ছাত্র-ছাত্রীদের বেশীরভাগই জানেনা যে ডেরিভেটিভ (Derivative) কি? বিশ্ববিদ্যালয় সমাপ্ত করেছে এমন অনেকের মধ্যেও ঐ বিষয়টি দেখেছি। অথচ এটি ক্যালকুলাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টপিক। আবার ক্যালকুলাস কি, এটাও অনেকে জানেনা, এরকমও লক্ষ্য করেছি। তাদের কাছে ক্যালকুলাস হলো একটি অত্যন্ত দুরূহ ‘ব্রাঞ্চ অব ম্যাথেমেটিক্স’, যার কিছু জটিল সূত্র আছে, এবং ঐ সূত্রগুলোকে আয়ত্ত করে অংকের সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারলেই যথেষ্ট হলো বলে তারা মনে করে। যাহোক, ক্যালকুলাস হলো গণিতের সেই শাখা যা পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে বা পরিবর্তনের হিসাব-নিকাশ করে। আর ডেরিভেটিভ (Derivative) হলো ‘পরিবর্তনের হার’ মানে ‘প্রতি এককে পরিবর্তন’ (rate of change)। প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পরিবর্তন নিয়ে গণিত কাজ করছে কেন? উত্তরঃ গণিতের কাজ চারপাশের প্রকৃতি জগৎটিকে ব্যাখ্যা করা, তাই প্রকৃতি জগতে যা কিছু ঘটে, গণিত তাই নিয়েই কাজ করবে; আমাদের প্রকৃতি জগতে পরিবর্তন একটি সর্বপ্লাবী ঘটনা। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সবই পরিবর্তনশীল। পৌরাণিক কাহিনী থেকে শুরু করে ধর্মগ্রন্থ হয়ে দর্শন এবং আজকের বিজ্ঞান পর্যন্ত এই পরিবর্তনের কথা বলছে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে, এই পরিবর্তনের হিসাব-নিকাশ থাকাটাও জরুরী। পরিবর্তনের ঐ হিসাব-নিকাশই ক্যালকুলাস।
এবার আসি আমাদের সময় সংক্রান্ত আলোচনায়। গ্যালিলিও কোন কায়ার গতিবেগের হিসাবটা শুরু করেছিলেন সময়ের সাপেক্ষে, শোনা যায় তিনি একবার ভেবেছিলেন যে, গতিবেগের হিসাব তিনি ভিন্নভাবে দেখাবেন, যদি তাই দেখাতেন তাহলে ফিজিক্সের সূত্রগুলো আজ হয়তোবা অন্য রকম দেখতে হতো। যাহোক, তিনি শেষ পর্যন্ত সময়ের সাপেক্ষে গতিবেগের হিসাব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এটা তিনি করেছিলেন এই কারণে যে, সময়কে তিনি এ্যাবসলুট মনে করতেন। আরেকটা কথা, আলোর বেগকে কিন্তু তিনি অসীম মনে করতেন। আলোর বেগের সসীমতা যে ভবিষ্যতে একটি ত্রুটির সৃষ্টি করতে পারে, এটা আসলে তিনি ভেবে দেখেননি। গতিবেগের সংজ্ঞা হিসাবে তিনি দেখালেন যে, এটি হলো সময়ের সাপেক্ষে কোন বডির অবস্থান পরিবর্তনের হার, মানে গতিবেগ হলো সময়ের সাপেক্ষে ডেরিভেটিভ। এই করতে গিয়ে তিনি আরেকটি ভুল করলেন আর সেটি হলো স্থান (space)-কেও তিনি পরম (absolute) ধরে নিলেন।
ইউরোপের ইতিহাসে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট-এর সাথে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইউরোপকে পোপ গ্রেগরীর প্রবর্তিত অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে আসতে প্রথমবার সাহায্য করেছিলো মুসলিম-দের কর্তৃক স্পেন বিজয় ও সেখানে একাধিক আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, দ্বিতীয় দফা সাহায্য করেছিলো মুসলিম মণিষী ইবনে রুশদ-এর ‘সেকুলারিজম’ ও ‘র্যাশনালিজম’, আর তৃতীয় দফা সাহায্য করেছিলো ইমানুয়েল কান্ট-এর সাথে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ সংক্রান্ত চিন্তাধারা। ইমানুয়েল কান্ট ১৭৮১ সালে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন যার নাম, ‘Critique of Pure Reason’। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, মহাবিশ্বের একটা শুরু রয়েছে এটার পিছনে যেমন যুক্তি রয়েছে, আবার মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে রয়েছে এটার পিছনেও যুক্তি রয়েছে। মহাবিশ্ব যদি অনন্তকাল ধরে থাকে তাহলে যেকোন ঘটনার আগে একটা অসীম কাল রয়েছে; আবার মহাবিশ্বের যদি একটা শুরু থাকে তাহলে তার আগে অসীম কাল রয়েছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব চিরকাল থাকুক না থাকুক, কাল অসীমতা ছিলো এটাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন। পক্ষান্তরে সেন্ট অগাস্টিন বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্বের কাল (time) ইশ্বরসৃষ্ট। মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কাল ছিলো না। যা বোঝা যায়, গ্যালিলিও ও কান্ট চরম সময়ে বিশ্বাস করতেন, আর সেন্ট অগাস্টিন কাল-কে মহাবিশ্বের গুন বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখেছেন। সময়ের আপেক্ষিকতা বিষয়টি উনাদের কারো চিন্তায়ই আসেনি। খুব সম্ভবত উনারা বৌদ্ধ ফিলোসফি ও পবিত্র লাইলাতুল মিরাজের ঘটনাটি জানতেন না।
(চলবে)
তারিখ: ১২ই মে, ২০১৭
সময়: রাত ১টা ৫৯ মিনিট
(পবিত্র ‘শব-ই-বরাত’-এর রাত্রি)