পরিসংখ্যান-জ্ঞানের অভাবে
——- ড. রমিত আজাদ
ইউরোপ মহাদেশে পরিসংখ্যান সাবজেক্ট-টির উদ্ভব খুব বেশীদিন না হলেও আমাদের বাংলাদেশে এই সাবজেক্ট-টির জন্ম ও ব্যবহার অনেক আগে থেকেই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ অর্থাৎ আজ থেকে ২ হাজার তিনশত বছর আগেই জৈব পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহ এবং জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধীকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মুগল শাসনামলেও বাংলায় পরিসংখ্যান উপাত্ত সংগ্রহ করা হতো এবং তা প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো। মুগল আমলের পরিসংখ্যানগত তথ্যের দুটি প্রধান দলিল হচ্ছে তুজকে-বাবরী এবং আইন-ই-আকবরী। সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) তাঁর ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী রাজা তোদারমাল সাম্রাজ্যের ভূমি ও কৃষি পরিসংখ্যান সম্পর্কিত তথ্যাদি অত্যন্ত চমৎকারভাবে সংরক্ষণ ও নথিভুক্ত করতেন।
বৃটিশ শাসকরা আর সবকিছুর মতন আমাদের পরিসংখ্যান-জ্ঞানটিকেও ধ্বংস করেছিলো। তারপর নতুন করে পরিসংখ্যান-জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিলেন প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিস (১৮৯৩ – ১৯৭২)। উনার আবিষ্কৃত ‘Mahalanobis distance’ বিশ্বখ্যাত। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন বোস কোয়ান্টাম মেকানিক্সে নতুন পরিসংখ্যান ব্যবহার করে আলবার্ট আইনস্টাইনের অসমাপ্ত কাজ সমাধান করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সমগ্র বিশ্বে। সেই পরিসংখ্যানের নাম আজ ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’।
আধুনিক যুগে এই সাবজেক্ট-টির গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমি দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই সাবজেক্ট-টি তেমন গুরুত্ব পায়না। আমাদের সময়ে স্কুলের জেনারেল কারিকুলামে পরিসংখ্যান শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিলো ‘ফ্রিকোয়েন্সী ডিস্ট্রিবিউশন টেবিল’ নির্মান ও ‘মেজারস অব সেন্ট্রাল টেন্ডেন্সী’-র মীন-মিডিয়ান-মোড পর্যন্ত। বর্তমানেও খুব ভালো অবস্থা বলে মনে হয়না। আমাদের দেশে গণিতের অন্তর্নিহিত অর্থ ও দর্শন যেমন কোথাও পড়ানো হয় না, গণিত বলতে ছাত্র-ছাত্রীরা কেবল ক্যালকুলেশনের বাইরে কিছু বোঝেনা, পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, ক্যালকুলেশনের বাইরে আর কিছুই পরিসংখ্যান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয় না।
এই কারণেই আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও পরিসংখ্যান জ্ঞানের অভাব স্পষ্ট লক্ষ্যণীয় (আমার অবসার্ভেশন অনুযায়ী)। আর যারা কিছুটা হলেও পরিসংখ্যান পড়েছেন, তাদের মধ্যে আমি লক্ষ্য করেছি পরিসংখ্যানের প্রয়োগ জ্ঞানের অভাব। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি, আমার এক বন্ধু ঢাকার অভিজাত এলাকায় তার মালিকানাধীন একটি এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিতে চাইলেন। আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনার এ্যাপার্টমেন্ট কি ভাড়া হয়েছে?” তিনি উত্তর দিলেন, “না ভাড়া হয় নাই। ভাড়া দিতে সমস্যা হচ্ছে”। (ঘটনা কয়েক বৎসর আগের। এখন পণ্যদ্রব্যের মূল্য মিনিমাম দ্বিগুন হয়েছে)
আমি: কেন ভাড়া হচ্ছে না?
বন্ধু: ভদ্রলোক পাচ্ছিনা।
আমি: আপনার এ্যাপার্টমেন্ট-এর ভাড়া কত?
বন্ধু: ‘এক্স’ টাকা।
টাকার অংক শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। অংকটি মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে ও বাংলাদেশের এভারেজ বেতনের কয়েকগুন বেশী।
আমি: ‘এক্স’ টাকা!!! এত হিউজ! এই টাকা দিয়ে যে বাড়ী ভাড়া নেবে সে একজন ভদ্রলোক হবে, তা আপনি এক্সপেক্ট করলেন কি করে?
বন্ধু: (একটু দমে গেলেও) কেন কেন?
আমি: বাংলাদেশে কোন ভদ্রলোকটার ঐ পরিমান আয় আছে (ভদ্রলোক বলতে তিনি যাদের মীন করছিলেন আমি তাদের হিসাব করে কথাটা বলেছি)?
বন্ধু: না মানে। ইউ. এন., ইউ.এন.ডি.পি. এই জাতীয় কিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠানে তো ভালোই বেতন দেয়।
আমি: ওরকম অফিস ঢাকায় কয়টা আছে? আর সেখানে ঐ পরিমান বেতনে চাকুরী করেন কতজন বাঙালী? যারা ঐ মোটা অংকের বেতনে চাকুরী করেন, তাদের বেশীরভাগেরই নিজস্ব বাড়ী আছে। তাদের মধ্যে কতজন বাড়ী ভাড়া করতে পারে? এইসব উপাত্ত দিয়ে একটু কষ্ট করে প্রোবাবিলিটি হিসাব করে নিন যে, হাতে গোণা ঐ কয়জনের কেউ আপনার এ্যাপার্টমেন্ট-টি ভাড়া নিতে আসবে সেই সম্ভাবনা কত? সেটা শূণ্যের কাছাকাছি হবে এটাই কিন্তু স্বাভাবিক।
বন্ধু: (বন্ধু অসহায় চোখে আমার দিকে তাকালেন)
আমি: আপনার ঐ এ্যাপার্টমেন্ট-টি একজন অভদ্রলোককেই ভাড়া দিতে হবে, এই বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত থাকেন।
আরেকদিন আরেকজন বলছিলেন, “ঢাকা শহরে এত জ্যাম, এর প্রধান কারণ যে, দেশের বেশীরভাগ লোকেরই এখন গাড়ী আছে।”
উনার কথা শুনে আমি তো হতবাক! আমি বললাম। “ভাই, আমাদের দেশে সতের কোটি মানুষ। এক পরিবারে গড়ে ছয়জন করে আছে ধরলে প্রায় তিনকোটি পরিবার। বেশীরভাগ বলতে মোর দ্যান ফিফটি পারসেন্ট। আমাদের দেশে কি দেড় কোটি পরিবারের বাড়ীতে গাড়ী আছে?”
অন্যদিন আরেকজন বলছিলেন যে, “মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য কিছু মুসলিমপ্রধান দেশে এখন অাভ্যন্তরীন কোন্দলে যে পরিমান মানুষ নিহত হচ্ছে তা ইতিপূর্বে কখনো হয়নি।” আমি বললাম, “ভাই কি বলছেন? আপনি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান জানেন? মাও সেতুং কর্তৃক চীনে ও স্তালিন কর্তৃক রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে গণহত্যার পরিসংখ্যান জানেন? খোদ আমাদের দেশেই দেখেন, ইংরেজরা ক্ষমতায় আসার পরপরই হত্যা করেছিলো সোয়া কোটি মানুষ, যা ছিলো সেই সময়ের জনসংখ্যার তেত্রিশ পারসেন্ট। তারা চলে যাবার সময় ‘৪৬-‘৪৭ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে হত্যা করেছিলো চল্লিশ লক্ষ মানুষ, এইসব খোঁজ রাখেন?”
তারপর আমি আরো বললাম যে, ইংরেজ কর্তৃক সাজানো একটি মিথ্যাচার ছিলো আমাদের নবাব কর্তৃক অন্ধকূপ হত্যাকান্ড, কিন্তু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় অন্ধকূপহত্যার সাথে ইংরেজ কর্তৃক গ্লেনকোর হত্যাকাণ্ড ও সিপাহিবিদ্রোহকালে অমৃতসরের নিদারুণ নিধন-ব্যাপারের তুলনা করেছিলেন। পরিসংখ্যানের এই অপূর্ব প্রয়োগে ইংরেজ শাসকরা ক্ষিপ্ত হয়েছিলো।
একবার পরিসংখ্যান ও অর্থনীতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন এমন একজন বয়স্ক অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন যে, “পত্র-পত্রিকায় পরিসংখ্যানগত যে সকল ফিগার ও তথ্য প্রকাশিত হয় তার মধ্যে যথেষ্ট অসঙ্গতি রয়েছে।” আর একই বিষয়ের পরিসংখ্যানগত তথ্য যে এক এক প্রতিষ্ঠানে এক একরকম পাওয়া যায়, এই অভিযোগ অনেকবারই শুনেছি।
যাহোক, পরিসংখ্যানজ্ঞান ও তার প্রয়োগজ্ঞানের অভাব আমাদের দেশের সর্বত্রই বিরাজমান বলে আমার মনে হয়। অথচ দেশের উন্নয়নের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সঠিক পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিসংখ্যানজ্ঞান। পরিসংখ্যান যত নির্ভুল হবে নীতি নির্ধারকদের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত সহজতর হবে। আশা করি অবহেলিত ও উপেক্ষিত এই সাবজেক্ট-টির দিকে সবাই নজর দিবেন।
তারিখ: ১৫ই এপ্রিল, ২০১৭
সময়: ভোর পাঁচটা আটচল্লিশ মিনিট