পৃথিবী পাল্টানো মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ – পর্ব ১, ২
পৃথিবী পাল্টানো মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ – পর্ব ১
————————————————————– রমিত আজাদ
হামিন মঙ্ঘা মহামারী (Prehistoric epidemic: Circa 3000 B.C.)
তখনও ইতিহাস রচনা শুরু হয়নাই। হলেও আমরা জানিনা। তাই ঐ যুগটা প্রাগৈতিহাসিক। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় যে, আজ থেকে পাঁচ হাজার (৫০০০) বছর আগে চীনের উত্তর-পূর্বঞ্চালে “Hamin Mangha” নামক জায়গায় এক মহামারীর ছড়িয়ে পড়ে। মহামারীতে প্রাণ হারায় আবাল-তরুণ-বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষ। সব মৃতদেহ এক ঘরে জড়ো করে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। ঐ স্থানে পরে আর লোকবসতি করা হয় নি।
বৈশালী মহামারী:
আজ থেকে ২৬০০ বছর আগে, গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় সমৃদ্ধিশালী বৈশালী নগরীতে এক দুর্ভিক্ষ ও মহামারী হয়েছিলো। এতে প্রচুর প্রাণনাশ হয়। কথিত আছে যে বৈশালীর রাজার বিনীত অনুরোধে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ বৈশালী নগরীতে উপস্থিত হয়ে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করে ঐ মহামারী দূর করেছিলেন। ঐ মহামারীর পরে বৈশালীতে সামাজিক ও দার্শনিক কোন পরিবর্তন এসেছিলো কিনা তা আমার জানা নাই। তবে বৌদ্ধ দর্শন যে সমগ্র পৃথিবীটাকে পাল্টে দিয়েছিলো এটা নিঃসন্দেহ।
পেলোপনেশীয় মহামারী:
খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে এথেন্স ছিলো একটি সমৃদ্ধ নগরী। গ্রীসের এথেন্সে হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ প্লেগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন দেশে চলছিলো যুদ্ধ। এই যুদ্ধের নাম পেলোপনেশীয় যুদ্ধ। ঘটনাটি ঘটেছিলো যুদ্ধের দ্বিতীয় বৎসরে, যখন স্পার্টানদের বিরুদ্ধে এথেনীয়দের বিজয় ছিলো আসন্ন! কিন্তু এই মহামারী এথেন্সকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। বিশ্বাস করা হয় যে এটি সমুদ্র বন্দর দিয়েই প্রবেশ করেছিলো, যা ছিলো তখন এথেন্সে খাদ্য ও পণ্য সরবরাহের মূল প্রবেশদ্বার। ইতিপূর্বেই মহামারীটি সংক্রমিত হয়েছিলো ভূমধ্যসাগরীয় লিবিয়া, মিশর এবং আফ্রিকার ইথিওপিয়ায়; সেখান থেকেই জাহাজে চড়ে মহামারীর জীবানু চলে আসে গ্রীসের এথেন্সে। ইতিমধ্যে ঐ দেশগুলোতে মহামারীর প্রকোপ কমে এলেও এথেন্সে তা নতুন মাত্রায় শুরু হয়। মহামারীটি আনুমানিক ৭৫,০০০ থেকে ১০০০০ (এক লক্ষ) এথেনীয়কে হত্যা করেছিলো বলে ধারনা করা হয়। এই বিধ্বংসী মহামারীটি এথেন্সের সমাজ জীবন, মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল, যার ফলে আইন ও প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য চলে যায়; যার ফলে রাষ্ট্র আরো কঠোর আইন প্রবর্তন করে, যার বলি হয় এথেন্সে বসবাসকারী অ-এথেনীয়রা। অ-এথেনীয় ইমিগ্রান্টদের মারাত্মক সব শাস্তি দেয়া হয়। প্লেগ দ্বিতীয়বার ফিরে আসে, খ্রিস্টপূর্ব ৪২৯ সালে এবং তারপর খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ ও ৪২৬ সালের শীতে। এই মহামারীর ফলেই পেলোপনেশীয় যুদ্ধে এথেনীয়রা পরাজিত হয় স্পার্টানদের কাছে।
এথেনীয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার (Athenian hegemony) যুগ থেকে পেলোপনেশীয় যুদ্ধে স্পার্টা ও তার মিত্রবাহিনীর কাছে হেরে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই সক্রেটিস বেঁচে ছিলেন। পরাজয়ের গ্লানি ভুলে এথেন্স যখন পুনরায় স্থিত হওয়ার চেষ্টা করছিল তখনই সেখানকার জনগণ একটি কর্মক্ষম সরকার পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রের সঠিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছিল। সক্রেটিসও গণতন্ত্রের একজন সমালোচক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাই অনেকে সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যুটিকে রাজনৈতিক টানাপোরনের বহিঃপ্রকাশ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
এই মহামারীটি এথেন্সের সমাজ জীবন, রাজনৈতিক জীবন ও দার্শনিক জীবনে কি ধরনের প্রভাব পরিবর্তন এনেছিলো। এই নিয়ে পরবর্তি পর্বে আলোচনা করা হবে।
(চলবে)
——————————————————————————
(ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অনুরোধ এসেছে,
বিভিন্ন মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বড় যুদ্ধ, ইত্যাদির পর
কি ধরনের বৈশ্বিক (রাজনৈতিক, দার্শনিক) পরিবর্তন অতীতে এসেছে
তাই নিয়ে লেখার।
আইডিয়াটা দেয়ার জন্য ছোট ভাইকে ধন্যবাদ।
আসলে বিশ্ব ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে,
যেকোন বড় মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বড় যুদ্ধ, ইত্যাদির পর
জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক ফিল্ডে রাজনৈতিক অথবা দার্শনিক পরিবর্তন এসেছে।
যেমন রাশিয়ায় নেপোলিয়নের যুদ্ধের পর অভিজাত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যবধান কমে এসেছিলো,
এবং ভূমিদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফল হিসাবে ইংরেজরা আমাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। এবং সারা বিশ্বেই উপনিবেশবাদের পতন হয়েছিলো।
এমন আরো অনেক।)
————————————————————————————-
রচনাতারিখ: ৩১শে মার্চ, ২০২০ সাল।
দুপুর: ০১টা ৫০ মিনিট
XXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXX
পৃথিবী পাল্টানো মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ – পর্ব ২
————————————————————– রমিত আজাদ
পেলোপনেশীয় মহামারী:
খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে এথেন্স ছিলো একটি সমৃদ্ধ নগরী। গ্রীসের এথেন্সে তখন রাজনৈতিক-সামাজিক জীবন ও কাঠামো কেমন ছিলো তা একটি দীর্ঘ আলোচনা। তবে সংক্ষেপে বলতে পারি যে সেখানকার ধর্মীয় বিশ্বাস ছিলো মিথ নির্ভর প্যাগান পলিথেইজম (বহু ঈশ্বরবাদ, মূর্তিপূজা)। খ্রীষ্টপূর্ব ছয় শতকে গ্রীসে জন্ম নেন থেলিস। থেলিসই ছিলেন গ্রীসে দর্শনের প্রথম প্রবক্তা। দর্শনের জন্ম গ্রীসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলো ও নবযুগের সূচনা করেছিলো। (তবে আমাদের বাংলাদেশে দর্শনের উদ্ভব আরো অনেক আগেই হয়েছিলো)। দর্শনের উদ্ভব মানেই মিথ-এর অন্ধকার দূরিভুত করা। তবে সেই অন্ধকার একদিনে দূরিভুত করা যায় না, সময় লাগে। তবে থেলিসের দর্শন যে অন্ধকার দূরিভুত করনের সূচনা করেছিলো এটা নিঃসন্দেহ। তারপর ধীরে ধীরে দর্শনের বিকাশ হতে শুরু করে। এটা যেমন হয়েছিলো এথেন্সে তেমনি হয়েছিলো, তার প্রতিবেশী নগর-রাষ্ট্র সমূহেও। অর্থাৎ পুরো গ্রীস জুড়েই একটা চাঞ্চল্য এসেছিলো। তাবে পাশাপাশি একথাও ঠিক যে প্রচলিত প্যাগান ধর্মে বিশ্বাসী পলিথেইস্ট-রা এইসব দার্শনিকদের নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখিও করেছিলো। যাহোক, দর্শন বিকাশের একেবারে পিক-এ এসে জন্ম হয়
জ্ঞানী সক্রেটিস-এর। আগেই লিখেছি যে, এথেনীয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার (Athenian hegemony) যুগ থেকে পেলোপনেশীয় মহামারী ও পেলোপনেশীয় যুদ্ধে স্পার্টা ও তার মিত্রবাহিনীর কাছে হেরে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই সক্রেটিস বেঁচে ছিলেন।
সক্রেটিস-এর সময়ে এথেন্সের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিলো, এবং কেন সক্রেটিস ঐ সমাজব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন দাবী করেছিলেন তা বোঝাতে গেলে কিছু প্রাক কথানের প্রয়োজন রয়েছে।
(প্রাক কথন)
ড্রাকোনের সংবিধানঃ
সপ্তম শতাব্দীর শেষাংশে (৬০০ – ৭০০ খৃষ্টপূর্ব) এথেন্সে বিদ্রোহ দানা বেধে উঠতে শুরু করে। এই বিদ্রোহে শুধু দরিদ্র কৃষকেরা এবং শ্রমিকরাই শামিল ছিল না বরং অনেক ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া ব্যক্তিরাও ছিল। তখনকার সময়ে সম্ভ্রান্ত বংশীয়রা অন্য সবাইকে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বিরত রাখত। তারা সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করত। এবং বিচারকরাও ছিল সম্ভ্রান্ত বংশীয় । ৬২১ খৃষ্টপূর্বাব্দে গণ অভ্যুত্থান যখন আসন্ন তখন বিপদ টের পেয়ে সম্ভ্রান্ত বংশীয়রা ড্রাকোন নামে তাদেরই একজন কে নিয়োজিত করে একটি লিখিত আইন ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য। ড্রাকোন তার আইন ব্যবস্থায় ছোটখাটো অপরাধের জন্যও শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা রাখে। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, কেন তার আইনে শাস্তি এত কঠোর? ড্রাকোন উত্তর দিয়েছিলেন, “যে কোন ছোট অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড হল উপযুক্ত শাস্তি।” কিন্তু আরও বড় অপরাধের শাস্তি কি হতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তরে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোন শাস্তির কথা তার জানা ছিল না। আর এখান থেকেই Draconian Law হিসাবে বোঝানো হয় ছোট অপরাধের জন্য যখন অতিরিক্ত শাস্তির প্রয়োগ করা হয়। ড্রাকোনের আইন ব্যবস্থাই ছিলো এথেন্সের প্রথম লিখিত সংবিধান।
গ্রীসে গণতন্ত্রের উত্থান
সেই সময়ের গ্রিক সমাজকে দুইভাগে ভাগ করা যায় aristos ও demos। Aristos মানে অভিজাত (qualified citizens), এবং demos মানে সাধারণ মানুষ (আমজনতা)। এই থেকে দুটি ধারণার তৈরী হলো Aristrokratia (aristrocracy) ও Democratia (democracy) Aristrokratia মানে হলো সমাজের অভিজাত বা যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষদের শাসন। আর Democratia মানে হলো সাধারণ মানুষের শাসন, গ্রিক Democratia শব্দটি থেকেই ইংরেজী democracy শব্দটি এসেছে। ৫০৮ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স নগরটি ইউরোপের প্রথম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিনত হয়। এ সময় মুক্ত স্বাধীন পুরুষেরা নগর পরিচালনার সিদ্ধান্তের জন্য ভোট দানের অনুমতি লাভ করে। অবশ্য নাগরিকরাই ভোট দিতে পারত। ইতিপূর্বে লিখেছি, যে কোনও এথেন্সবাসীই গ্রিক নাগরিক ছিল না। ওই সময়ে অনেক গ্রিক পরিবারে দাস ছিল। বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দিদের-কে দাসে পরিণত করা হত। দাসদেরকে এথেন্সের নাগরিক মানা হতো না। তাদের ভোটাধিকার ছিল না। প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রে নারীদেরও ভোটদানের অধিকার ছিল না।
সোলোনের সংষ্কার ও গণতন্ত্রঃ
সোলোনের জন্ম ৬৩৮ খ্রীষ্টপূর্বে আর মৃত্যু ৫৫৮ খ্রীষ্টপূর্বে । সেই সময়টাতে গ্রীকদের বুদ্ধিবৃত্তিক চমৎকারিত্বের শুরু হয়ে গেছে। আর সে কারণেই হয়ত তিনি পুরাতন ধ্যান-ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করতে পিছপা ছিলেন না । তার নীতি ছিল Meden Agan বা “কোনকিছুরই অতিরিক্ত নয়”। সোলোন একজন কবি ছিলেন, তার রচিত কবিতাগুলো বর্তমানকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন কবি আরেকদিকে ছিলেন আইন-প্রনেতা। তাই আবেগ ও যুক্তির এক অদ্ভুত সমন্বয় ছিলো তার মধ্যে। এথেন্সের সবচাইতে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলির একটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অন্য ছয়জনের মধ্যে একজন ছিলেন মিলিটাসের থেলিস, ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে তিনি ছিলেন গ্রীসের তথা ইউরোপের প্রথম দার্শনিক ।
৫৯৪ খৃষ্টপূর্বে অসম্ভ্রান্ত বংশীয়রা সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। সম্ভ্রান্তদের ঘোড়া এবং দেহ-রক্ষাকারী বর্ম ছিল কিন্তু অসম্ভ্রান্তদের ছিলও তীর ধনুক এবং স্লিংশট। আর সংখ্যায়ও ছিল তারা অনেক বেশী। এরকম পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষ একটা দুর্লভ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়, যা কিনা ইতিহাসে বিরল। সোলোনকে তাদের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে মনোনয়ন দেয়। সোলোনকে তাদের মতানৈক্যর অচলাবস্থা দূর করার জন্য দেয়া হয় পূর্ণ ক্ষমতা। এবং তারা তাকে Archor বা সরকার প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয়।
এই দুই পক্ষের বিবাদ মেটাতে সোলোন সচেষ্ট হন।
সোলোন প্রথমেই ড্রাকোনের সেইসব নির্মম আইন কানুন বাতিল করে দেন যা কিনা মূলত: সম্ভ্রান্ত বংশীয় বিচারকরা অ-সম্ভ্রান্তদের উপর প্রয়োগ করত। সকল প্রকার ধারদেনা বাতিল করে দেন। যে সমস্ত মানুষেরা ঋণ শোধ করতে না পারার জন্য দাসে পরিণত হয়েছিলো তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও মুক্ত করে দেন। দূরবর্তী দেশে কিংবা শহরে যাদের বিক্রি করা হয়েছিলো তাদেরকেও তিনি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন এবং পুনর্বাসিত করেন। তিনি কোন মানুষকে জিম্মা রেখে ধার দেয়ার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেন এবং সেটাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এর পরে গ্রীসে ঋণ শোধ না করার অপরাধে আর কাউকে কখনও দাসে পরিণত হতে হয়নি।
তবে তিনি ধনীদের জমি দখল করেননি। তিনি তাদের ধন-সম্পদ রাখতে দেন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তাদের প্রতিভাকে ব্যবহার করে অবদান রাখার সুযোগ রাখেন। কিন্তু তিনি যে কাজটি করেন তা হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেন ফলে তারা নিজেদেরকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হবে। যা কিনা গণতন্ত্রের একটি মূলমন্ত্র।
সরকারী উচ্চ পদগুলো শুধুমাত্র সম্ভ্রান্তদের জন্য আর রইল না। বস্তুত:পক্ষে সোলোনের রিফর্ম অনুযায়ী জনগণকে আর সম্ভ্রান্ত আর অ-সম্ভ্রান্ত এই ভাবে ভাগ করা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্ট্যাটাসের বদলে আয়ের উপর ভর করে জনগণকে চারটি ভাগে ভাগ করলেন। একে Timocracyব লা হয়।
ধনী গরীব নির্বিশেষে সবার একটি ভোট সোলোন চালু করেন। সংখ্যার আধিক্যের কারণে দরিদ্ররা খুব সহজেই ধনীদের ভোটে পরাজিত করতে পারত। Heliaea অবধারিত ভাবেই দরিদ্রদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। Heliaea নামক প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হত জনসম্মুখে। কি ঘটছে তা প্রতিটি নাগরিকই দেখতে এবং শুনতে পেত। Th Boule তাদের সিদ্ধান্ত গোপনে নিতে পারত তবে সেই সিদ্ধান্ত এবং পরামর্শ Ekklesia’ -য় উপস্থিত সবার সামনে প্রকাশ করতে হত। সোলোনের গণতন্ত্রের এটি একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ছিল। সোলোনের আইন কানুন ড্রাকোনের চেয়ে অনেক বেশী নমনীয় ছিল। সোলোন এই সমস্ত নিয়ম কানুন কাঠের কলামে লিখে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে সবাই সেগুলো পড়তে পারে। তিনি চেয়েছিলেন এথেন্সের নাগরিকদের মধ্যে একটি শক্তিশালী নাগরিক দায়িত্ববোধ গড়ে উঠুক।
সোলোন বিয়েতে যৌতুক ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করেন। তিনি বলেন, “বিয়ে হতে হবে দুজন মানুষের ভালবাসার পরিণতি এবং তাদের ভালবাসার ফসল হিসাবে জন্ম নেবে তাদের সন্তান। টাকার জন্য বিয়ে হওয়া উচিৎ না।” সোলোন বৃদ্ধ পুরুষ আর অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করেন। কারণ তাদের মধ্যে নিবিড় ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি নাও হতে পারে। তিনি বয়স্কা মহিলা এবং তরুণ পুরুষদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করেন কারণ কোন তরুণ স্ত্রীর টাকার জন্য বয়স্কা মহিলা বিয়ে করতে পারে।
সোলোনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো তিনি কি এথেন্স বাসীদের জন্য সবচাইতে ভাল আইন ব্যবস্থা দিতে পেরেছেন কিনা? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “না – শুধুমাত্র সর্বোত্তম আইন যা তারা গ্রহণ করতে রাজী আছে।” এর সাথে তিনি আরও যোগ করেন এই বলে যে, “এমন কোন আইন সৃষ্টি করা উচিৎ না, যা প্রয়োগ করা সম্ভব না।” যা এখনও আমাদের বর্তমান সময়ের গণতন্ত্রের মূল ভাব; আইন প্রণেতারা জানে যে একটা সময়ে এসে জনগণ তাদের বিপরীতে ভোট প্রদান করবে।
সোলোন পরিষ্কার ভাবেই গণতন্ত্রের আরেকটি মূল জিনিস বুঝতে পেরেছিলেন আর সেটি হল যে কোন একটি বিষয় দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সঠিক-বেঠিক হতে পারে। একদলের জন্য যেটা সঠিক অন্য দলের জন্যে সেটাই হয়ত অবিচার। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাধান তাই কম্প্রোমাইজ করার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে।
যদিও সোলোনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ম-নীতি আজও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত এবং পরিচালিত করে তবে তার সেই সব চিন্তা চেতনাকে তার বিরোধীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দমিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। আর এটা করতে যেয়ে তার বিরোধীরা যার দর্শন এবং চিন্তা ভাবনার সাহায্য নিয়েছিলো তিনিও ছিলেন এথেন্সের আরেক গর্ব যার বেশির ভাগ অনুসারীর মতেই তিনি হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক; যাকে আমরা সবাই চিনি প্লেটো নামে। উল্লেখ্য যে প্লেটো জ্ঞানী সক্রেটিসের শিষ্য এবং সক্রেটিসের চিন্তাধারা দ্বারাই প্রভাবিত। এর মধ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ছিলো ‘গণতন্ত্রের বিরোধিতা’।
—————————————————————————————–
রচনা তারিখ” ৩১শে মার্চ, ২০২০ সাল
সময়: সন্ধ্যা ৮টা ২৫ মিনিট