প্রকাশ্য চুম্বন – পর্ব ৩
————- রমিত আজাদ
(পূর্ব প্রকাশের পর থেকে)
সেই রোমান্টিক সন্ধ্যায় ডরমিটরির বদ্ধ কামরায় বাংলাদেশী তানভীর ও দক্ষিণ আমেরিকান কার্লার মধ্যে রোমান্স কতটুকু হয়েছিলো সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে ঈষৎ শ্বেতাঙ্গিনী কার্লার পুষ্পতনু যখন তানভীর নামক শ্যামবর্ণ অলির ছো্ঁয়ায় গোলাপের পাঁপড়ি মত মৃদু মৃদু কম্পনে নতুন অনুরণন সৃষ্টি করছিলো তখন তানভীরের মোবাইলে ভাইব্রেশন রূপে কয়েকদফা টেলিফোন কল এসেছিলো ‘মারিতা’ নাম্নী আরেক রূপবতী বিদেশিনী-র। ঐ স্ক্রীনের দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো কার্লার। কার্লা বারবারই বলছিলো, তানভীর থামো থামো, তুমি তো আমার নও, তুমি মারিতার! সম্ভব না, আমার পক্ষে সম্ভব না। একদিকে কঠিন বাহুডোরে, আরেকদিকে, ‘না না, পারবো না, সম্ভব না’। সেই চিরকালীন নারীসুলভ ‘চাই চাই চাইনা’!
আপাততঃ ফিরে আসি তানভীর তাসনুভা প্রসঙ্গে। তাসনুভা সদ্য যৌবনা উনবিংশতি তরুনী, ঢাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড সেমিস্টারের ছাত্রী। আর তানভীর তখন পয়ত্রিশ বৎসর বয়স্ক ম্যাচিয়ুরড পুরুষ। তারপরেও তাসনুভা এই অসম প্রেমে পড়েছে! প্রেমে পড়ার পিছনে কিছু কারণ আছে অবশ্য। তানভীর মূলতঃ দেশের বাইরেই থাকে। তার মায়ের অসুস্থতার কারণে দেশে এসেছে সে, একটু লম্বা সময় নিয়ে এসেছে। অনেকদিন দেশে আসা হয় না, পারিবারিক কিছু কাজও আছে, এই সবকিছু মিলিয়ে তার কিছুটা সময় লাগবেও। দেশে তার এক ধনী বন্ধুর বড় ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসার একটা অংশ রাশিয়ার সাথে। তাই বন্ধুটি তানভীর-কে অনুরোধ করেছিলো, যে কয়দিন সে দেশে আছে তানভীর যেন তাকে ব্যবসার কাজে কিছু হেল্প করে। সেই সুবাদে সে ঢাকার বনানীর একটি অফিসে বসে। বারোতলার ঐ অফিস থেকে নেমে মাঝে মাঝে একটি ক্যাফেতে খাওয়া দাওয়া করে সে। আর সেখানেই তাসনুভার সাথে পরিচয় তার।
তানভীর দেশ ছেড়েছিলো খুব অল্প বয়সে। ঐ বয়সে চোখে থাকে অনেক স্বপ্ন, মনে থাকে অনেক আনন্দ, রঙিন জীবনকে পজিটিভলি-ই নেয়া হয়। ম্যাচিয়ুরড জীবনের মানুষের স্বার্থপরতার বিষয়ে কোন ধারণাই থাকে না তখন। বয়স বাড়ার সাথে চারপাশের জগৎ-টা সম্পর্কে ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। বনের নিসর্গ সৌন্দর্য্য ছাপিয়ে তখন শ্বাপদসংকুলতাই চোখে পড়ে বেশী। এ যাবৎকাল পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার বেশীরভাগই হয়েছিলো মানুষের অর্থহীন স্বার্থপরতার জন্য। মানব চরিত্রের এই ঘৃণ্য দিকটি যখন প্রকট হয়ে ওঠে, তখন মাঝে মাঝে জীবনের অর্থই হারিয়ে ফেলে অনেকে। এই রকম একটি পর্যায়ে অনেকেই আত্মহনন-এর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই বিষয়টি নিয়ে বিষদ গবেষণা করেছিলেন সমাজবিদ ও দার্শনিক দুরখাইম। তানভীর-এর জীবনেও তখন এমন একটি সময়কাল চলছিলো। এই সময়ে সে সন্ধান পেলো কোলাহলমুখর স্বল্পবয়স্ক একদল তরুণ-তরুনীর। এদের চোখে অনেক স্বপ্ন, মনে অনেক আনন্দ, জীবন অনেক রঙিন। স্বার্থপর হতে তখনো তারা শেখেনি। তাদের সাথে কথা বলে রিল্যাক্সড হওয়া যায়। মনের অনেক স্ট্রেস ঝরে যায়। ঐ তরুণ-তরুনীদের মাঝে নিজের অতীত-কে খুঁজে পেতে চাইলো সে।
ঢাকার বনানী এলাকায় অনেকগুলো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেই হিসাবে এটি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আবার এখানে রয়েছে পুনর্জাগরিত বাংলার চিরকালীন রাজধানী ঐতিহ্যবাহি ঢাকা নগরীর নব্য ব্যবসা বানিজ্যের অনেক আফিস-দফতর। সেই হিসাবে এটি দেশের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রও। একদিকে ছাত্রছাত্রির মিলনমেলা, আরেকদিকে ব্যবসায়ী ও নির্বাহীদের ছুটাছুটির ব্যস্ততা। সব মিলিয়ে একটা কোলাহলমুখর পরিবেশ! তানভীর যখন দেশ ছাড়ে তখন দেশে কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না। দেশে এসে সে পরিচিত হলো এই নতুন কালচারের সাথে। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ফ্যাশন বা বাহ্যিক সৌন্দর্য্য সচেতনতা খুব একটা ছিলো না। কিন্তু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়-এর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই সচেতনতাটা প্রকট। অবশ্য তানভীর বিদেশে এই কালচার অনেক আগেই দেখেছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের বা অগ্রগামী দেশগুলোর ঐ কালচারের ঢেউ এখন বাংলাদেশেও এসে আছড়ে পড়েছে।
সেই দিনটা তানভীরের এখনো মনে পড়ে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোন একটা সময়, ফসলী সনের হিসাবে ওটা ছিলো শ্রাবণ মাস। শ্রাবণ মানেই তো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। হচ্ছিলোও তাই। বাইরে সেদিন থেকে থেকে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছিলো। অবিরাম তুষারশুভ্র স্নো-ফল দেখে অভ্যস্ত তানভীরের চোখ অনেকদিন বাংলার বর্ষা উপভোগ করেনি। যেটা শৈশবে সে এনজয় করতো একশতভাগ। প্রবল বর্ষণে বিলের জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সাঁতারে সাঁতরে কেটে গেছে সারা বেলা। দুপুরের লাঞ্চটা অফিসে না করে ক্যাফেতে করার সিদ্ধান্ত নিলো তানভীর। জানালার পাশে একটা টেবিলে বসে, খাবারের অর্ডার দিলো সে। একটু পড়েই নামলো ঝুম বৃষ্টি। ক্যাফের ম্যানেজার বোধহয় কোন শিল্পরসিক মানুষ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে চালিয়ে দিলেন কাজী নজরুল ইসলামের একটি স্বল্পপরিচিত গান, ‘আবার শ্রাবণ এলো ফিরে, তেমনি ময়ুর ডাকে, দোলনা কেন বাঁধলে না গো এবার কদম-শাখে।।’ এমন আবেগময় মুহুর্তে আতাতুর্ক এ্যাভিনিউয়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছগুলোর মত তানভীরের মনেও ময়ুর ডাকতে শুরু করলো।
হঠাৎ কলকাকলী করতে করতে একঝাক তরুণ-তরুনী প্রবেশ করলো ক্যাফেতে। বয়স আঠারো থেকে বিশ-এর মধ্যে হবে। তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ব্যাগ। তানভীর বুঝলো, ওরা আশেপাশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। ছেলেরা মোটামুটি ফিট-ফাট ড্রেস আপ করা, তবে মেয়েদের সকলেই খুব সুন্দর সেজেগুজে আছে। যেমন পোষাকের ছটা তেমনি তাদের মেক-আপ। এই জমানার মেয়েরা খুব সুন্দর করে সাঁজতে পারে! ইন্টারনেটে বিদেশী সিনেমা-টিনেমা দেখে সাঁজগোজ শিখেছে হয়তো। পাখীর ঝাঁকের মত কিচিমিচি করতে করতে ওরা ঢুকলো ক্যাফেতে। অগোছালোভাবে বসে পড়লো যে যেখানে পারে। সবার শরীরই আধভেজা ছিলো। আসার পথে বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলো হয়তো। আবার ঐ বয়সের অনেকেই বৃষ্টির ধারায় ইচ্ছে করেই ভেজে। তানভীর নিজেও ঐ বয়সে অনেকবার মনের সুখে ভিজেছে। একবার মনের সুখ মিটিয়ে পুরো দুইঘন্টা আকসানার সাথে ভিজেছিলো ইউক্রেণের খারকোভ শহরে। ‘ঝুম বৃষ্টিতে চুম’, তানভীর খুব উপভোগ করেছে বরাবরই।
“এক্সকিউজ মি, এই চেয়ারটা কি আমি নিতে পারি?” সেতারের সুর যেন বেজে উঠলো তানভীরের কানের ঝিল্লী-তে। মায়েস্ত্রো রবিশংকরের তৃতীয় স্ত্রী-র ঘরে একটু মেয়ে আছে নাম অনুষ্কা শঙ্কর, সেও সেতার বাজায়। কোন এক অদ্ভুত কারণে তানভীরের কাছে অনুষ্কা শঙ্কর-এর সেতারের ধ্বনিই বেশী মিষ্টি মনে হয়। আজ হঠাৎ যেন সেই সেতারের ধ্বনি মুর্ছিত হলো কার কন্ঠস্বরে। চোখ তুলে তাকালো তানভীর, এ যেন অনেক দিনের চেনা! উর্বশী-র মত রূপসী না হলেও হেলা-ফেলা করা যাবে না। পিঙ্ক কালারের সালোয়ার-কামিজ পড়া প্রস্ফুটিত যৌবনা এক তরুণী। যেন সদ্য অঙ্কুরিত একটি সতেজ তৃণতরু। অদ্ভুত এক গভীরতা তার ডাগর দুটি আঁখিতে! একি জীবনানন্দ দাশের সেই কাকচক্ষু জলের দীঘি? আধভেজা মেয়েটির কাজলমাখা চোখের পাতায়ও ছোঁয়া লেগেছিলো বৃষ্টিছটার। ক্যাফের রঙিন আলোয় সেই জলফোটাও জ্বলছিলো মুক্তোর দানার মত! ব্যাকগ্রাউন্ডে এখন ঐ গানটি হলে বেশ মানাতো,
‘বৃষ্টি এসে আছড়ে পড়ুক কাজলে, চোখেরই কাজল মুছবো না আঁখি জলে, মেঘেরই মত মুখ লুকাবো না অভিমানে।’
ঐ ছিলো তানভীরের চোখে তাসনুভা-কে প্রথম দেখা।
(চলবে)
বৃষ্টি এলো ভিজিয়ে দিলো অশ্রুজলের রেখা,
কাজল মাখা সজল আঁখির মাতাল বাদল দেখা!
বিষাদ থেকে সুখ যদি হয় নতুন ফুলের গন্ধে,
প্রসাদ মেখে মুখ রাঙাবো কদম তরুর ছন্দে!
———————————————————————
সময়: সন্ধ্যা সাতটা একত্রিশ মিনিট
তারিখ: ২৯শে জুলাই, ২০১৮