প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে কিছুক্ষণ – পর্ব ৫
————————- ড. রমিত আজাদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
একটি বহুতল ভবনের উপর থেকে মেগাসিটি নামক কংক্রিটের জঙ্গলের আকাশে সূর্যাস্ত দেখতে ভালো না লাগলেও খারাপ লাগেনা। যদিও এ সূর্যাস্তের দৃশ্য কোনভাবেই কক্সবাজারের অথৈ জলরাশির উত্তাল ঢেউয়ের বুকে নেমে পড়া সূর্যাস্তের দৃশ্যের সাথে কোনভাবেই তুলনীয় নয়, অথবা তুলনীয় নয় বান্দরবানের নীলগিরি থেকে অবলোকন করা প্রাণবন্ত পর্বতীয় সূর্যাস্তের। তুষারাচ্ছন্ন পর্বতের চূড়ার উপর সূর্যাস্ত দেখার সুযোগও হয়েছিলো। বিকেলের সোনা রোদ পড়ে কেমন ঝকঝক করে ওঠে চূড়াগুলো! দূর থেকে মনে হয় যেন মধ্যযুগীয় সারাসেন সৈনিকের শাণিত তরবারীর ফলা। শুনেছি বাংলাদেশের পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারশুভ্র চূড়ায় সূর্যাস্ত দেখা যায়। নিজে দেখিনি কখনো, যেতে হবে একবার। আপাততঃ অফিস শেষ হওয়ার আগে আগে ঢাকার বনানীর বাণিজ্যিক ভবনের আঠারো তলায় অবস্থিত আমার রূমের জানালা থেকে দিনের আলো নিভে যাওয়া দেখছিলাম।
বনানীর কমার্শিয়াল বিল্ডিংগুলো এখন উঁচু উঁচু, গড়ে বিশতলা করে সবই। অথচ এই ঢাকা শহরে একসময় একটিই উঁচু দালান ছিলো এগারো তলা বিশিষ্ট দালানটির নাম তখন ছিলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। এরপর তার নাম বহুবার পাল্টেছে। মোগল শাসনামলের নয়ানাভিরাম বাগিচা শাহবাগের মোড়ে দাঁড়ানো ঐ ভবনটির নাম কখনো ছিলো ‘শেরাটন’ কখনো ‘রূপসী বাংলা’। বহুতল ভবনে ঢাকা শহর এখন ছেয়ে গেলেও এই কালচার বেশিদিনের নয়। শোনা যায় গভর্ণর আজম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন উদ্বোধন করতে এসে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, “ক তলার ফাউন্ডেশন দিয়েছেন?” উত্তরে উনাকে জানানো হয়েছিলো যে, ‘ফাউন্ডেশন ছয়তলার’। উনি রেগেমেগে বলেছিলেন, “বিশ তলার ফাউন্ডেশন দেননি কেন?” সেসময় ঢাকা শহরের লোকে তিনতলার উপর দালান দেখেনি তাই ছয়তলা তাদের কাছে অনেকই মনে হয়েছিলো, বিশতলার কথা শুনে তাদের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিলো। আজম খান বলেছিলেন, “জানেন বছর দশক পরে দেশের পড়ালেখার কত উন্নতি হবে? সারা দেশ থেকে কত কত ছাত্র পড়তে আসবে? এসব কথা এখন না ভাবলে চলবে? আর আপনারা কিনা ফাউন্ডেশন দিলেন মাত্র ছয়তলার!” একেই বোধহয় বলে দূরদৃষ্টি। ১৯৮০ সালের দিকে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় আরেকটি ভবন হয় নাম তার ‘শিল্প ভবন’। প্রাইভেট খাতে বহুতল ভবন কেউ নির্মান করার সাহস করছিলো না। মনে মনে ভয় ছিলো, এরকম ভবন নির্মান করা যাবে কিনা? নির্মিত হলেও তা টিকবে কিনা? লোকে সেখানে অফিস ভাড়া নেবে কিনা? এমন হাজারটা ভয় ও প্রশ্ন। তখন সরকারই উদ্যোগ নিলো, দরিদ্র ও পশ্চাদপদ দেশে কোন একটি নতুন কাজ সরকারকেই প্রথম করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়। সেই ভাবনা থেকেই সরকারী উদ্যোগে পচিশ তলা উঁচু ‘শিল্প ভবন’ তৈরী করা হয়। এরপর থেকে মোটামুটি দ্রুত গতিতেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবন গড়ে উঠতে শুরু করে।
অফিসের ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো। এসময় ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করছিলো না। আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হবো ঠিক করে রেখেছি। এখন যদি অফিসের কাজে কেউ ফোন করে থাকে আর তাকে সময় দিতে হয় তাহলে আর বের হওয়া হবে না। ফোনটা ধরবো না ঠিক করলাম। যাবার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য জানালার কাছ থেকে সরে এসে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ফোনটা এখনো বেজেই চলছে। কি করবো ভাবছি। তুষার দেশের বাইরে গিয়েছে, এসময় একটা জরুরী ফোনও আসতে পারে। আর যদি কেউ অফিসের কাজে সময় নিতেই চায় অসুবিধা কি? ঘরে তো আমাকে কিছু টানছে না। ফোনটা তুললাম।
আমি: হ্যালো।
ওপাশ থেকে মোলায়েম কন্ঠস্বর, “চিনতে পেরেছেন?”
আমি: নাম বলুন।
: নাম বলতে হবে?
: বললে চিনতে সুবিধা হবে।
: আমি শিউলি।
আমি: ও। শিউলি। কেমন আছো?
শিউলি: ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
আমি: ভালো আছি। মোবাইলে ফোন করলে না কেন?
শিউলি: ইচ্ছে করেই। মোবাইলে ফোন করলে তো সাথে সাথেই জেনে ফেলতেন যে এটা আমার ফোন। তাই চমকে দেয়ার জন্য ল্যান্ডফোনে ফোন করলাম। তাতো আপনি চিনতেই পারলেন না! আমি কিন্তু মনে কষ্ট পেয়েছি।
আমি: ও সরি। আসলে ল্যান্ডফোনে তোমার কন্ঠস্বর শুনে অভ্যস্ত না তো। (একটা খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করালাম। আসলে ওর প্রতি কোন আগ্রহ নাই বলেই কন্ঠস্বর মনে রাখার চেষ্টা করিনাই)
শিউলি: এখন কি করছেন?
আমি: কিছুনা। অফিস শেষ। বাড়ী ফিরবো।
শিউলি: বাড়ী গিয়ে কি করবেন? আমি বারিধারাতে এসেছি, চলুন কোথাও বসি।
ওর প্রস্তাবটা খারাপ না। সারাদিনের কাজের শেষে একটু রিলাক্সের প্রয়োজন আছে।
আমি: ওকে। কোথায় বসবে?
শিউলি: আইসক্রীম শপে যাই।
আমি: গুড। গুলশানে একটা ভালো আইসক্রীম শপ আছে ওখানে বসা যাবে। তোমাকে কোথা থেকে পিক করবো?
শিউলি: পিক করতে হবে না। আমার সাথে গাড়ী আছে। আমি নিজেই চলে যাবো। আইসক্রীম শপটার নাম বলেন।
ঢাকার এদিকটায় আজকাল ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট ক্যাফে তৈরী হয়েছে, বাইরের সাথে তুলনা করলে নট ব্যাড! অভিজাত এই এলাকাগুলো নিয়ে এখন একটি আলাদা ঢাকা হয়েছে, এর নাম ‘ঢাকা উত্তর’। মেয়রও আলাদা! এক নগরী দুই মেয়র! ঢাকার দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়ার জন্যেই কিনা কে জানে?
আমি আইসক্রীম শপটার ভিতরে ঢুকে দেখলাম শিউলি এখনো আসেনি। বুঝলাম না। জ্যামে আটকে আছে হয়তো। ফোন করলে জানা যাবে। ফোন করতে চাইলাম না। আরেকটু অপেক্ষা করি। এরমধ্যে দেখি মেনুতে কি আছে। সামনের দিকে যেখানে আইসক্রীম খাবার ইত্যাদি সাজানো আছে, সেদিকে এগিয়ে গেলাম। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম শিউলি আসলে কি কি নেব। তারপর আবার ফিরে আসলাম। আমার পাশের টেবিলে একজন বৃদ্ধ মত ব্যক্তি বসে আছেন। তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, “আপনি কি আমাকে খোঁজ করছেন?”
আমি: না। আমি অন্য একজনার জন্য অপেক্ষা করছি।
বৃদ্ধ: ও।
তারপর ভাবলাম মুরুব্বী মানুষ, একা একা বসে আছেন। কথা বলে সঙ্গ দেই উনাকে একটু।
আমি: জ্বী, আপনার নাম কি?
বৃদ্ধ: আমার নাম ‘এক্স ওয়াই জেড’।
আমি একটু থমকালাম। ‘এক্স ওয়াই জেড’ নামে একজন মন্ত্রী এরশাদের মন্ত্রী সভায় ছিলেন। উনার সাথে চেহারা মিলাবার চেষ্টা করলাম। নাহ, মিলাতে পারছি না। তিনি আসলে তখন খুব ইয়াং ছিলেন। এখনকার এই বৃদ্ধ চেহারার সাথে আমি পরিচিত নই। ইনিই তিনি কিনা শিওর হওয়ার জন্য প্রশ্ন করলাম।
আমি: জ্বী, আংকেল আপনি কি করেন?
তিনি আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন চিড়িয়া দেখছেন। আমি প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য উনার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি আরেকবার আমার দিকে তাকালেন, এবারের দৃষ্টিটি আমাকে পরিমাপের দৃষ্টি। তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন
বৃদ্ধ: আমি ব্যবসা করি।
এখন আমার মনে হলো, তাহলে ইনি হয়তো তিনি নন। একই নাম তো কতজনারই থাকতে পারে।
আমি: জ্বী, ভালো ভালো। ব্যবসা করা তো ভালো। আপনার অফিস কোথায়?
বৃদ্ধ: এই গুলশানেই।
আমি: বাহ। বেশ। আমার অফিস বনানীতে।
বৃদ্ধ: কি করেন আপনি?
আমি: জ্বী, চাকরী করি। একটা কর্পরেশনে। আসলে আমি অনেকগুলো বছর বিদেশে ছিলাম। দেশে এসে বর্তমান চাকরীতে ঢুকেছি।
বৃদ্ধ: ও, আপনি বিদেশে ছিলেন। তাই বলি!
এর মধ্যে শিউলি চলে এলো। আমাকে দেখে বললো।
শিউলি: সরি জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম। আপনি কি অনেকক্ষণ ওয়েট করছেন?
আমি: না, বেশিক্ষণ নয়। এই মুরুব্বীর সাথে কথা বলে সময় কাটছিলো। উনি ঢাকায় ব্যবসা করেন। গুলশানেই অফিস। শিউলি উনাকে সালাম দিলো। তারপর আমি শিউলিকে নিয়ে সরে আরেকটা টেবিলে বসলাম।
এর মধ্যেই কয়েকজন লোক এসে ক্যাফেতে ঢুকলো। তারা সরাসরি ঐ বৃদ্ধের কাছে এসে সালাম দিলো। তাদের মধ্যে একজনকে আমি চিনি, তিনি ইয়াং নামজাদা রাজনীতিবিদ। এবার আর আমার কোন সন্দেহ রইল না যে, এই এক্স ওয়াই জেড-ই সেই এক্স ওয়াই জেড, এরশাদের মন্ত্রী। নামজাদা রাজনীতিবিদ। উনার ইয়াং বয়সের চেহারার সাথে আজকের চেহারা মিলাতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো।
এবার আমার মনে প্রশ্ন জাগলো। আচ্ছা, উনি নিজেকে রাজনীতিবিদ পরিচয় না দিয়ে, ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেন কেন? উনি কি উনার রাজনীতিবিদ পরিচয়টাকে পছন্দ করেন না? নাকি উনি মনে করেন জনতা রাজনীতিবিদদের পছন্দ করেনা?
শিউলি: কি ভাবছেন?
আমি: তুমি আসার আগে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে।
শিউলি: কি ঘটনা?
শিউলিকে ঘটনাটা বললাম। শিউলি হেসে অস্থির। বললো
“উনি ভুল তো কিছু বলেন নি। এই জমানায় রাজনীতিতো ব্যবসাই। হি হি হি।
শিউলিরা সাথে ঘন্টাদেড়েক কাটালাম ক্যাফেতে। ক্যাজুয়াল কিছু কথাবার্তা বললাম। বেশিরভাগ সময় ওর কথাই শুনতে হচ্ছিলো। বেশ উচ্ছল মেয়ে, অনেক কথা বলে।
খাওয়া শেষ করার পর ওয়েটারকে বললাম বিল আনতে। বিল আনার পর দুটা নোট দিলাম।
শিউলি: আপনার ক্রেডিট কার্ড নেই?
আমি: আছে একটা, ক্যারি করিনা।
শিউলি: কেন?
আমি: ক্রেডিট কার্ড পছন্দ করিনা আমি।
শিউলি: কিন্তু আপনার লেভেল-এর সবাইইতো ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে।
আমি: হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আমি ওটা পছন্দ করিনা। ক্রেডিট মানে ধার। বাইরে ধারের উপর একটা ইকোনমি চলে। দেশের জনগণকেও তারা ধার করা শেখায়। এর ফলাফল একদিন হবে ভয়াবহ।
শিউলি: কি ভয়াবহ?
আমি: দেশের অর্থনীতিতে যেকোন সময় ধ্বস নেমে আসতে পারে।
শিউলি: কি রকম?
আমি: দেশের কথা থাক। আমি ব্যক্তির কথা বলি। এরকম অনেক ঘটনাই আছে যে ক্রেডিট কার্ড থাকার কারণেই একটা লোকের খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। কারণ সে ভাবছে, এখন টাকা নেই তো কি হয়েছে, আসবে, আপাতত খরচ করে ফেলি।
শিউলি: ও, যাক। ওসব জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে চাইনা।
আমি: এছাড়া ক্রেডিট কার্ড ক্যারি করলে ছিনতাইকারীরও ভয় আছে। আমার এক কলিগ রিসেন্টলি ছিনতাইকারী পাল্লায় পড়েছিলো। কার্ডের সব টাকাই খোয়া গেছে।
শিউলি: ও বাবা! সেদিক থেকে চিন্তা করলে তো আপনি সেইফ থাকবেন।
আমি: বাসায় যাবে?
শিউলি: উঁ, না থাক। আজ আর যাব না। কাল অফিস আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে সমস্যা।
আমি: ওকে।
শিউলি: উইক-এন্ডে আসি?
আমি: আসো।
শিউলিকে গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। তারপর ভাবলাম আরেক কাপ কফি খেয়ে বাসায় যাই। ক্যাফেটায় আরেক বার ঢুকলাম। আর এখানেই ঘটলো অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি।
আমার দিকে এগিয়ে এলেন একজন বয়স্কা মহিলা।
:তুমি না?
আমি: জ্বী?
: হ্যাঁ, তুমিই-ই।
আমি: আমিতো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
: আরে আমাকে চিনলে না? অবশ্য অনেকদিন পরে, আবার বয়সও হয়ে গেছে।
আমি: আপনি কে জানতে পারি কি?
: আমি যুঁথি। তোমার যুঁথি আপা।
ধড়াস করে উঠলো বুকটা! আমি আসলে কখনো আশা করিনি, আরো ভালোভাবে বললে চাইইনি উনার সাথে আদৌ দেখা হোক। ফেসবুকে উনার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট-টা এখনো ঝুলিয়ে রেখেছি। আর এখানে কিনা সামনাসামনি উনার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে গেলো। কোন কূক্ষণে যে আবার ফেরৎ এসেছিলাম! আমার সাথে শিউলিকে দেখে ফেলেনি তো? আবার যদি তানিয়াকে বলে দেয়! হে ধরনী দ্বিধা হও।
আমি: (খুব উৎসাহ দেখিয়ে বললাম) ও যুঁথি আপা। আপনি! এভাবে দেখা হয়ে যাবে আশাই করিনি। খুব ভালো লাগছে আপনাকে দেখে। (আমার অভিনয়টা উনি ধরতে পারলেন কিনা বুঝলাম না)
যুঁথি আপা: আমারও তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। আসলে আমি তোমাকে অনেকক্ষণ যাবৎই দেখছি।
আমি মনে মনে আরেকবার বললাম, ‘হে ধরনী দ্বিধা হও’!
আমি: আমাকে এতগুলো বছর পরে চিনলেন কি করে?
যুঁথি আপা: তোমার চেইঞ্জ আসলে খুব বেশি হয়নাই। আর তোমার ছবি তো ফেসবুকে দেখেছিই।
আমি: ও, আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি তো ভালোই।
যুঁথি আপা: আচ্ছা ঐ মেয়েটি কে ছিলো?
আমি: (এবার প্রমাদ গুনলাম, যুঁথি আপা এবার না হাঁড়ির খবর নিয়ে ছাড়ে, মহিলারা এটা বেশ পারে) কোন মেয়েটি?
যুঁথি আপা: ভণিতা করোনা। এতক্ষণ একটা মেয়েকে নিয়ে বসে ছিলে না? তোমার বৌ যে না, এটা বেশ বুঝতে পেরেছি। অত ইয়াং মেয়ে তোমার বৌ হবার কথা নয়।
আমি: ও। ঐ মেয়েটি? (ভাবছি কি বলবো, কলিগ বললে আবার আরেক সমস্যা হতে পারে) অফিসের কাজে আরকি।
যুঁথি আপা: অফিসের কাজে ক্যাফেতে কি? অফিসের কাজ তো অফিসে বসেই করা যায়।
আমি: না মানে ও আমার অফিসের নয়।
যুঁথি আপা: তাহলে।
আমি: অন্য অফিসের। আমাদের অফিসের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে ঐ অফিসের। সেই ব্যবসার কথা বলতেই বসেছিলাম।
যুঁথি আপা: ব্যবসার কথা তো তো তুমি তোমার বয়সী কারো সাথে বলবে। অত ইয়াং সুন্দরী মেয়েকে তোমার কাছে পাঠানোর কি আছে?
আমি: ব্যবসার ব্যাপার-স্যাপার। ব্যবসায় অনেক কিছুই হয়।
যুঁথি আপা: অবশ্য আজকালকার কর্পোরেট ওয়ার্লেডে কত কিছুই তো হয়। আর সবকিছু পান্তাভাত শুধু প্রফিট-টাই আসল! কি যে দিনকাল আসলো!
আমি: থাক যুঁথি আপা। ব্যবসার কথা থাক। আপনার কথা বলেন।
যুঁথি আপা: আমার কথা। আমার আর কোন কথা নাই রে ভাই।
আমি: কি যে বলেন যুঁথি আপা। পাড়ার এতগুলো বড়ভাইয়ের মনে ঝড় তোলা নারী কিনা আজ হতাশ সুরে বলছে যে, উনার আর কোন কথা নাই!
যুঁথি আপা: তুমি তো, আমার বোনটার মনে কষ্ট দিয়ে বিদেশে চলে গেলে। আমরা রয়ে গেলাম দেশে।
তানিয়ার প্রসঙ্গে উনার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাইছিলাম না। উনি সেটাও টেনে আনলেন। মনে মনে যেমন উনার উপরে, তেমনি নিজের উপরেও রাগ হতে লাগলো। কেন যে, এই ক্যাফেতে এলাম! এলামই যখন তখন কেন আবার কফি খেতে ফিরে এলাম? একেই বোধহয় বলে ‘যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়’!
যুঁথি আপা: আমি পাশ করার পর একটা সরকারী চাকরী পাই। তারপর আমার বিয়ে হয়ে যায়।
আমি: ভালো তো। তা দুলাভাইজান কি করেন?
যুঁথি আপা: জান বলছো কাকে? পুরো ছ্যাঁচোর!
(নিজের স্বামীকে এভাবে কেউ উপাধী দিয়ে অন্যকে বলতে পারে ভাবিনি)
আমি: কি বলেন আপা? কি করেন উনি?
যুঁথি আপা: লেখাপড়া ভালোই আছে। ডাক্তার। বাবা আমার বিয়েটা ঠিক করে দিয়েছিলেন। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা মেধাবী ছেলে। বাবা ভেবেছিলেন রত্ন ছেলে হবে। উঁচুতলার ছেলেদের তো স্বভাব-চরিত্র ভালো হয়না।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। প্রথম দেখাতেই যুঁথি আপা কি সব কথা বলতে লাগলেন! উনার জামাই কি তবে……..। যুঁথি আপা বলে যেতে লাগলেন।
যুঁথি আপা: তানিয়ার জামাইটাও ছ্যাঁচোর! তারপরেও তানিয়ার জামাই তো ওকে টাকা-পয়সা দিয়ে সুখী রাখে, আমার জামাই তো আমাকে একটা টাকাও দেয়না। আমার কামানো টাকায় সংসার চলে। ও যা কামায় সব ওর মা-বাবা, ভাই-বোনদের দিয়ে দেয়।
আমি: আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?
যুঁথি আপা: একটা ছেলে আছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। জানো ওর পড়ার খরচও আমাকে যোগাতে হয়।
আমি: ও। (এর বেশি আমার আর কিছু বলারও ছিলো না)
যুঁথি আপা: ছোট ঘরে বিয়ে করলে যা হয় আরকি। আমার জামাইয়ের টাকার দিকেই তাকিয়ে থাকে ওর বাড়ীর লোকজন।
আমি: (প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম) কফি খাবেন যুঁথি আপা?
যুঁথি আপা: তুমি খাবে? ওকে, আনাও কফি।
কথা আর বেশি আগানো ঠিক হবেনা মনে করে, আমি কফি খেয়েই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার আগে যুঁথি আপা বললেন, তোমার মোবাইল নাম্বারটা তো নেয়া হলো না। আচ্ছা ফেসবুকে আমার ইনবক্সে দিয়ে দিও।
বাসায় ফিরে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। আজ দু’জন রমণীর সাথে একই জায়গায় সাক্ষাৎ হলো। দুজন দুই বয়সের দুই জমানার মানুষ। একজনার জীবন এখন শুরু হবে হবে করছে, তবে সেই আগত জীবন নিয়ে তার কোন সিরিয়াস চিন্তাভাবনা নাই, আপাততঃ উপভোগ করছে জীবনকে বর্তমানকে। আরেকজন তিল তিল করে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন একটা সুন্দর জীবন পাওয়ার উদ্দেশ্যে আজ সেই জীবনের অনেকটা পার করে তিনি কেবল অসন্তোষই প্রকাশ করছেন! যুঁথি আপা যখন তরুনী ছিলেন, উনার সেই সময়ের পোষাক-আশাক প্রসাধনের সাথে আজকের শিউলির পোষাক প্রসাধনের কোন মিল নেই। শিউলির মত এতটা আঁট-সাট পোষাকের কথা তখন ভাবাই যেতনা। এত উগ্র প্রসাধনও তখন ছিলনা। আজ এটাই স্মার্টনেস। শিউলি আজ যে লাইফ লীড করছে, এর সাথে কেবল পাশ্চাত্যের ব্যক্তিস্বাধীনতার অযুহাতে বাঁধনহীন জীবনেরই তুলনা করা চলে।
ডিনারের পর কফির কাপ হাতে কম্পিউটারে বসলাম। ফেসবুকটা এখন একটা নেশা, একসময় টেলিভিশন ছিলো নেশার মত। এখন আর টেলিভিশন খুব একটা দেখা হয়না। ফেসবুকই ইন্টারেস্টিং। আমি তো অনেক সংবাদ এখন ফেসবুকেই আগে পাই। একটা সংবাদ নতুন পেলাম কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো খুব অসুস্থ। বয়স হয়ে গিয়েছে নব্বইয়ের কাছাকাছি, আর কত? এভাবে বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছেনা, হায়াত-মৌত যিনি জীবন দিয়েছেন তার হাতেই। আয়ু না থাকলে কেউ অনেকে আগেই চলে যায়, আবার আয়ু থাকলে শত বর্ষও বাঁচা হয়। ক্যাস্ত্রো মারা গেলে উনার সময়কার সব নেতারই বোধহয় চলে যাওয়া হবে। মার্শাল টিটো থেকে শুরু করে ইয়াসির আরাফাত পর্যন্ত সবাইইতো একে একে চলে গেলেন। এরপর আমার খেয়াল হলো রাণী এলিজাবেথ এখনো বেঁচে আছেন। উনার বয়সও নব্বই বৎসর। উনার ছেলে চার্লস-এর দাঁড়ি-গোফ সব পেঁকে খরখরে হয়ে গেলো অথচ রাজত্বি এখনো মিললো না! এলিজাবেথের প্রসঙ্গ আসতে একটা মজার কথা মনে পড়লো এই রাণীর জন্মদিন দুইটি, একটি একুশে এপ্রিল আর আরেকটি তিনি জুন মাসে পালন করেন। হা হা, আমাদের দেশে প্রায় সবারই দুটা জন্মদিন থাকে একটা তার আসল জন্মদিন, আরেকটি তার সার্টিফিকেটের জন্মদিন। একবার এক রাজনৈতিক নেতার জন্মদিনে গেলাম। বেশ সুন্দর আয়োজন করেছিলেন তিনি। আমি একফাঁকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, এটা কি আপনার রিয়েল জন্মদিন?” তিনি একটু চুপসে গিয়ে বললেন, “না, সার্টিফিকেটেরটা। কি করবো বলে? এভাবেই তো চলছে!” আমি বললাম, “স্যার এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, ইংল্যান্ডের রাণীরও দুটি জন্মদিন।” তিনি যেন পালে হাওয়া পেলেন, “তাই নাকি? এই বিষয়ে কোন আর্টিকেল থাকলে আমাকে ফেসবুকে ইনবক্স করো।”
আজ তানিয়াকে মেসেজ দিবো কিনা ভাবছি। যুঁথি আপার সাথে আজ যেভাবে দেখা হলো। এরপর আর পালে হাওয়া পাচ্ছি না। যুঁথি আপার কথা মনে হতে উনার ঝুলে থাকা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট-টা একসেপ্ট করে নিলাম। এরপর আর উনার কাছ থেকে পালিয়ে থাকা যায়না।
ফেসবুকে কোন মেসেজ নাই। অন্যদের কথা বলছি না। তাদের মেসেজ নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমি তানিয়ার মেসেজের কথা বলছি।
মোবাইল-টা বেজে উঠলো, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন খুঁজি তারে আমি আপনায়, আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি আমারও পিয়াসী বাসনায়।’ আবারো রিংটোনটা পাল্টেছি, আমার আরেকটি প্রিয় গান। অবাক হলাম, তানিয়ার ফোন, কোন মেসেজ না দিয়েই সরাসরি ফোন।
আমি: হ্যালো তানিয়া।
তানিয়া: কেমন আছো?
আমি: ভালো।
তানিয়া: ভালো তো থাকারই কথা।
আমি: একথা কেন বলছো?
তানিয়া: আজ যুঁথি আপার সাথে দেখা হয়েছিলো তোমার?
আমি: (মনে মনে বলছি ‘হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি তার ভিতর প্রবেশ করি’, কে জানে যুঁথি আপা ওকে কি কি সব বলেছে!) হ্যাঁ, গুলশানে একটা ক্যাফেতে দেখা হয়েছিলো।
তানিয়া: কি বললেন আপা?
আমি: তেমন কিছু না মামুলি কথাবার্তা আরকি।
তানিয়া: এই যুঁথি আপা তো আর সেই যুঁথি আপা নেই। পরিমিত মার্জিত এক যুঁথি আপাকে তুমি দেখেছিলে, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে তিনি আজ অনেকটাই পাল্টে গিয়েছেন। লক্ষ্য করোনি?
আমি: হ্যাঁ, মানে মনে হলো কিছুটা। (আমি চাইছিলাম যে, তানিয়া যুঁথি আপা প্রসঙ্গটি পাল্টাক)
তানিয়া: কিছুটা কেন, অনেকটাই তো। উনার স্বামী উনাকে অনেক কষ্ট দেয়। উনি বলেননি তোমাকে সব পাট পাট করে?
আমি: হু, কিছুটা বললেন।
তানিয়া: উনার একটা ছেলের সাথে প্রেম হয়েছিলো। কিন্তু উনার বাবা রাজী হয়নি। পরে এখনকার জামাইয়ের সাথে বিয়ে হয়।
আমি: উনার বাবা ঐ ছেলেটার সাথে বিয়েতে রাজী হয়েছিলেন না কেন?
তানিয়া: সমাজের উঁচুতলার ছেলে। ধনীর সন্তান। যুঁথি আপার বাবা বলেছিলেন যে, এরা ভালো হয়না, বৌকে কষ্ট দেয়।
আমি: ও
তানিয়া: দেখো কান্ড। যুঁথি আপাকে সেই কষ্টই করতে হচ্ছে।
আমি: সবই ভাগ্য!
তানিয়া: (আবার ক্ষেপে গেলো মনে হয়) ভাগ্য না? ভাগ্য? আমাদের কোন দোষ নেই?
আমি: (ওকে শান্ত করার জন্য) আমরাও কিছুটা দায়ী।
তানিয়া: আচ্ছা, তোমাকে একটা প্রশ্ন কখনোই করা হয়নি।
আমি: কি প্রশ্ন? (মনে মনে ভয়ে আছি, শিউলি প্রসঙ্গে না আবার কিছু বলে)
তানিয়া: তোমার বাসায় কে কে আছে?
আমি: (যাক, তাও কঠিন প্রশ্ন নয়) আমার বাসায় কয়েকজন।
তানিয়া: কারা বলো, নাম বলো।
আমি: একটা বিড়াল আছে, একটা টিয়া পাখী, দুটা খরগোশ আর একটা কচ্ছপ। কচ্ছপও আসলে দুটা ছিলো, কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎ একটা মরে গেছে।
তানিয়া: (বিস্মিত কন্ঠে। ওর টোন শুনে মনে হলো, আমার কথা বিশ্বাস করে নাই) কি বললে?
আমি: বিড়ালটা ধবধবে সাদা তাই নাম দিয়েছি ব্লাংকা। স্পেনিশ ভাষায় ব্লাংকা সাদা। টিয়া পাখীটার নাম চৈতি। খোরগোশ দুটির নাম মিশা আর নিশা। কচ্ছপ দুইটির নাম বাহাদুর আর রুসালকা। রুসালকা-টা কয়েকদিন আগে মরে গেছে।
তানিয়া: তুমি কি আমার সাথে ফাজলামি করছো?
আমি: (আমি এবার সিরিয়াস কন্ঠে বললাম) না একদম নয়।
তানিয়া: তোমার বৌ কোথায় গেলো?
আমি: কোথাও যায়নি তো।
তানিয়া: তাহলে তোমার সাথে থাকে না কেন?
আমি: তানিয়া। বৌ থাকলে তো আমার সাথে থাকবে, তাইনা?
তানিয়া: তার মানে?
আমি: আমি বিয়ে করিনি।
তানিয়া: (চরম বিস্ময় ঝড়ে পড়লো ওর কন্ঠ থেকে) এত বছর বয়স হয়ে গেলো, অথচ এখনো বিয়ে করোনি?
আমি: না।
তানিয়া: কেন করলে না বিয়ে?
আমি: হয়ে ওঠেনি। যৌবনের পুরোটা আর ভাটা বয়সের প্রথম দিকটা তো বিদেশেই কেটে গেলো।
তানিয়া: ক্যারিয়ার, তাই না। তুমি তো বিশাল ক্যারিয়ারিস্ট! তোমার ক্যারিয়ারের চিন্তার কাছে তো আর সবকিছু মূল্যহীন। (আবার ক্ষেপে উঠলো ও)
আমি: তুমি ঠিকই ধরেছ। ঐ ক্যারিয়ার চিন্তাই আমাকে আর ঘর বাঁধতে দেয়নি।
তানিয়া: তারপরেও পুরুষের জীবনে নারী আসে না, এমন তো হয়না। তোমার জীবনে নিশ্চয়ই এসেছিলো। তাদের কেউ কি তোমাকে বাধ্য করতে পারেনি?
আমি: এসেছিলো অনেকেই। তবে তারা প্রেমিকা ছিল না, গার্ল-ফ্রেন্ড ছিলো।
তানিয়া: প্রেমিকা আর গার্ল-ফ্রেন্ডে পার্থক্য কি?
আমি: প্রেম শব্দটি স্বর্গীয় এর সাথে পবিত্রতার সম্পর্ক থাকে। গার্ল-ফ্রেন্ড মূল্যহীন এক ভোগের সামগ্রী। সেখানে কোন পবিত্রতা নেই, যা আছে তার পুরোটাই দেহজ! দেহ আর মন তো এক নয়!
তানিয়া: কিন্তু ………………….।
কোন একটা আওয়াজ শোনা গেলো ফোনে, ওর পাশ থেকে।
তানিয়া: আমার জামাই চলে এসেছে। আরেকদিন কথা হবে।
(চলবে)
তারিখ: ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৬ সাল
সময়: রাত ৭ টা বেজে ২৭ মিনিট