
বিলুপ্তির পথে বাংলাদেশের হাতি
বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। তার পরও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে আছে আমাদের বন্য প্রাণী। যদিও সরকারিভাবে বলা হয়, আমাদের বনের পরিমাণ মোট আয়তনের ১৬ শতাংশ; কিন্তু গবেষণা গ্রন্থ ‘স্টোলেন ফরেস্ট’ থেকে জানা যায়, আসলে মাত্র ৬ শতাংশ বন কার্যকরভাবে টিকে আছে। তাও আবার বছরে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। বনের যখন এ করুণ অবস্থা, সে তুলনায় বন্য প্রাণীর সংখ্যা এখনো আশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশের আবহাওয়া, বিশেষ করে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুর চাপ, ঋতুচক্র, পানি ও মাটির উপাদান বন্য প্রাণীর জন্য উপযোগী হওয়ায় ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের ছোট এ দেশটি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। জীববৈচিত্র্যের তালিকায় স্তন্যপায়ী হাতির উপস্থিতি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপ, ব্যাপক হারে বন উজাড়, বন্য প্রাণী শিকার, নদীর নাব্যতা এবং ভারসাম্যহীন পরিবেশই বন্য প্রাণীকে বিপন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এসব কারণে অন্য বহু প্রাণীর মতো বাংলাদেশে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে হাতি। বাংলাদেশের বনাঞ্চলে হাতির সংখ্যা মাত্র ১৯৬ থেকে ২২৭টি। আর এদের বিচরণ দেশের ১১টি বন বিভাগে। একসময় ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রামে হাতি দেখতে পাওয়া যেত; কিন্তু হাতির সেই বিস্তীর্ণ বিচরণস্থল ক্রমেই সংকুচিত হয়ে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আইইউসিএনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বন বিভাগের চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলে হাতি আছে ৩০ থেকে ৩৫টি, কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগ মিলিয়ে আছে ৮২ থেকে ৯৩টি, বান্দরবানে আছে ১২ থেকে ১৫টি এবং লামা বিভাগে আছে ৩৫ থেকে ৪০টি। এ ছাড়া কক্সবাজার উত্তর বিভাগে আরো ৭ থেকে ৯টি এবং দক্ষিণ বিভাগে ৩০ থেকে ৩৫টি হাতি রয়েছে। আর অভিবাসী হাতির সংখ্যা ৮৪ থেকে ১০০টি। হাতি কমে যাওয়ার ৯টি কারণও আইইউসিএনের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, খাদ্যাভাব, চলাচলের রাস্তা কমে যাওয়াসহ নানা কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের হাতি। হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে চোরা শিকারিদের অপতৎপরতা। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শুধু পার্বত্য বান্দরবান ও কক্সবাজারের ছয়টি উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দাঁত ও হাড়গোড়ের জন্য ৩২টি হাতি হত্যা করা হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই হত্যার তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। গহিন অরণ্যে ফাঁদ পেতে, বিষ খাইয়ে সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা হাতির দাঁত ও হাড় সংগ্রহ করে তা উচ্চমূল্যে বিদেশে পাচার করছে। বাংলাদেশের অনেক বন্য প্রাণী হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক প্রাণী। হাতি এসব প্রাণীর মধ্যে প্রধানতম। আর নির্বিচার শিকার হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মূল কারণ। বাংলাদেশ হাতিসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনুকূল বিচরণ এলাকা হলেও বর্তমানে প্রাকৃতিক বনের এ প্রাণীগুলোর সবই দেশ থেকে নিদারুণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে শুরু করেছে। স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের এই সর্বনাশা বিলুপ্তি আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হতে চলেছে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির।
আজিজুর রহমান (কালেরকণ্ঠ)