ভালোবাসার ইমারত (১০)
——————– রমিত আজাদ
প্রেম তো প্রেম-ই! সে কিশোর বয়সের প্রেম হোক, আর ভরা যৌবনের প্রেম হোক। তবে কোন প্রেমটা মনে বেশী দাগ কাটে, কিশোর বয়সের প্রেম নাকি ভরা যৌবনের প্রেম? সেটা একটা জটিল প্রশ্ন হতে পারে। আমি অনেক ক্যাডেট-কেই জানি যাদের প্রথম প্রেম, প্রথম দৃষ্টি বিনিময়, প্রথম হৃত্স্পন্দন হয়েছিলো কলেজ ক্যাম্পাসেই। কখনো ঐ মাতৃসম ইমারত-গুলোর করিডোরে, কখনো তাদের সম্মুখের পথে, অথবা দৃষ্টিনন্দন কলেজ গার্ডেনে। বেশীরভাগ সময়েই ওটা হতো সহপাঠির বোনের সাথে বা অন্য কোন ক্যাডেটের বোনের সাথে। বেশীরভাগ সময়ই দিনটা হতো ‘প্যারেন্টস ডে’। আমি নিশ্চিত যে, এই কয়েকটি পংক্তি পড়ে অনেকের চোখেই ভেসে উঠছে সেই প্রথম দৃষ্টি ও প্রথম হাসি বিনিময়ের স্মৃতি!
পাঠকগণ আবার ধরে নেবেন না যে, কলেজ ক্যাম্পাসে আমারও অনুরূপ মধুস্মৃতি রয়েছে। না, কলেজ ক্যাম্পাসে কোন প্রাণ আমার হৃদয়ের বীণা বাজায়নি। তবে হ্যাঁ, আর দশজনার মত আমারও একটি টীন-এজ্ড প্রেম ছিলো। ভ্যাকেশনের পর কলেজে ফিরে, হাউজ ইমারতে বসে আমার রুমমেটের সাথে শেয়ার করতাম এমন কিছু অনুভূতি! আমার সহপাঠি রুমমেট-টি ছিলো খুব নরম প্রকৃতির। সে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনতো আমার সেই আবেগ-অনুভূতির কথা। এরপর যদিও পদ্মা-মেঘনা, ভলগা-মিসিসিপি দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, বহুবার বদলেছে আকাশ ও হৃদয়ের রঙ, তারপরেও আমার সেই রুমমেট এখনো মনে রেখেছে সেই নায়িকার নাম।
সিক্সথ ব্যাচে আমার খুব ঘনিষ্ট এক বড় ভাইকে একবার দেখলাম, উনার ডায়েরীর পাতায় কি যেন দেখছেন। দিনটি ছিলো ছুটির দিন। আমি করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ খোলা জানালা দিয়ে দৃশ্যটি চোখে পড়লো। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, তিনি ডায়েরীর কোন পাতায় ডুবে নেই। ডায়েরীটির একটি লেদার মলাট ছিলো, সেই মলাটের ভিতর লুকানো ছিলো উনার প্রিয়তমার রঙিন ছবিটি। তিনি মন ভরে দেখছিলেন ছবিটি। দেখা শেষ হলে আবার মলাট গুটিয়ে লুকিয়ে ফেললেন ছবিটি। একদিন সুযোগ বুঝে ধরলাম উনাকে; “কি ভাইয়া? ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে? বলেন তো ঘটনা কি?” তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন, “কোন ঘটনা বলো তো?!” আমি বললাম, “ক্লাস ইলেভেনে উঠে গেছেন, এখন তো হৃদয়ের ঘন্টা একটু-আধটু বাজবেই! ডায়েরীর মলাটে কার ছবি লুকানো?” এবার তিনি হেসে ফেললেন, “তুমি জেনে গেছো তাহলে!” ভাইয়া ছিলেন ভীষণ স্মার্ট! অত আর রাখঢাক করলেন না, সব কথা সোজাসুজি বলেই দিলেন। কোন ঈদের দিনে কোথায় তাদের দেখা, কোন সূত্রে কিভাবে পরিচয়, সবই খুলে বললেন। সব শুনে বললাম, “আপনার প্রিয়তমার ছবি কি দেখতে পারি?” তিনি কোন সংকোচ না করে বললেন, “চলো দেখাই”। অতঃপর তিনি আমাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে ডায়েরীটির মলাট খুলে দেখালেন তার প্রিয়তমার ছবি। ভাইয়া ছিলেন দারুণ হ্যান্ডসাম! তরুণী সুন্দরী না হলে উনার পাশে মানাবে না। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখলাম, ইটস ওকে, ভাইয়ার চয়েজ ভালো, যথেষ্ট সুন্দরী উনার প্রিয়তমা! দুজনকে ভালো-ই মানাবে!
আমার একজন শিক্ষকও একবার আমার সাথে শেয়ার করেছিলেন উনার প্রাকবিবাহ প্রেমের কথা। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, ঐ তরুণীর সাথে স্যারেরও পরিচয় হয়েছিলো কলেজ ক্যাম্পাসেই; এবং তিনি ছিলেন কোন এক ক্যাডেটের আত্মীয়া। ও ইমারত, তুমি যে কত কিছুর স্বাক্ষী!!!
কলেজের তরফ থেকে আমাদের জন্য কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ-এর পাশাপাশি কিছু এ্যাকাডেমিক পুরষ্কারেরও ব্যবস্থা ছিলো। আবার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাও কিছু পুরষ্কার দিতেন। ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণের শিক্ষক জনাব রকিবুল হাসান স্যার (বর্তমানে মরহুম) ক্লাসরুমে ঘোষণা দিলেন, যেই ছাত্র উল্লেখ্য পঞ্চাশটি বাগধারা নির্ভুল মুখস্থ বলতে পারবে তাকে স্যার পুরষ্কৃত করবেন। তবে পাঁচটা ভুল হলেও চলবে। আমি সাথে সাথে উঠে জবাব দিয়েছিলাম; আটচল্লিশটি বাগধারা আমি নির্ভুল মুখস্থ বলেছিলাম, দুইটি ভুল হয়েছিলে। স্যার উচ্ছসিত হয়েছিলেন ও পুরষ্কারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আসলে স্যারের প্রশংসা-ই ছিলো আমাদের জন্য সবচাইতে বড় পুরষ্কার। রকিবুল হাসান স্যার আজ আর আমাদের মাঝে নেই, উনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। স্যার ছিলেন আমাদের অন্যতম প্রিয় শিক্ষক। উনার সম্পর্কে পৃথক একটা লেখা লেখার ইচ্ছে আছে।
২৮শে নভেম্বর ১৯৮৫ সাল তারিখে রাতে ছিলো পূর্ণচন্দ্রগ্রহণ। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ন্যাচারাল ফেনোমিনা অবশ্যই। ক্যাডেটদের বেশীরভাগ-ই ছিলো সায়েন্স-এর ছাত্র, তাই সবার কাছেই ফেনোমিনা-টি ইন্টারেস্টিং ছিলো। ঐ রাতে ইমারতের ছাদের দরজা খোলা রাখা হয়েছিলো, যাতে ক্যাডেটরা চন্দ্রগ্রহণ উপভোগ করতে পারে। আমরা বিজ্ঞান ও প্রকৃতিপ্রেমিকরা সবাই যথাসময়ে ছাদে চলে গেলাম। গ্রহণ শুরু হলো রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে, আর শেষ হলো রাত ১টা ৩০ মিনিটে। বিশাল ইমারতের ছাদে দাঁড়িয়ে, রহস্যময় পাহাড়ী পরিবেশে, প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলাটি আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছিলাম মন-প্রাণ দিয়ে!
৩০শে নভেম্বর ১৯৮৫ সাল তারিখে হঠাৎ ইন্তেকাল করলেন স্বনামধন্য সাংবাদিক ও উপস্থাপক জনাব ফজলে লোহানী। ষাটের দশকে তিনি প্রবল জনপ্রিয় সাংবাদিক ছিলেন সমকালীন সমাজে। তারপর তিনি বিলেতে প্রবাসী হন। এরপর আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন আশির দশকে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইন্ট্রোডিউস করেছিলেন ‘টেলিভিশন সাংবাদিকতা’। উনার পরিকল্পিত ও উপস্থাপিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ছিলো প্রবল জনপ্রিয় কালজয়ী একটি অনুষ্ঠান, তারই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। উনার অকাল মৃত্যুতে শক্ড হয়েছিলো পুরো জাতি। সকাল বেলা এই শোক সংবাদটি আমাদের-কে জানিয়েছিলেন আমাদের ফর্ম মাস্টার অধ্যাপক বদরুদ্দোজা স্যার (বর্তমানে মরহুম)। এই দুঃসংবাদে আমরা সকলেই শোকাহত হয়েছিলাম! তার কয়েকদিন পরে মরহুম ফজলে লোহানী-র সম্মানে একটি স্মরণ-অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলো বিটিভি। ঐরাত ছুটির রাত ছিলো না। কলেজের নিয়মে টিভি নাইট নয়, তারপরেও কলেজ কর্তৃপক্ষ বিশেষ আদেশে টিভি রুম খুলেছিলো ও ক্যাডেট-রা যাতে স্মরণ-অনুষ্ঠানটি দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছিলো। ক্যাডেটদেরকে সংস্কৃতানুরাগী করে গড়ে তোলা ও গুণিজনদের সম্মান দেখানো শেখানো হয়েছিলো এইভাবে।
(চলবে)
রচনাতারিখ: ১৭ই অক্টোবর, ২০১৯
সময়: সন্ধ্যা ৫টা ৪৩ মিনিট
—————————————————————————-
প্রেমের ভাষা ইমারতের দেয়াল জুড়ে দাও লিখে,
প্রেম কাহিনীর সাক্ষী দালান, নীরব চোখে সব দেখে।
রবি-শশীর গ্রহণ জ্বলন, তারই ছাদে ঝলমলে,
ছয় বছরের একটি জীবন, লিখবো রেখে মখমলে।