ভালোবাসার ইমারত (২)
——————– রমিত আজাদ
ইমারতের সাথে মানুষের ভালোবাসা হয়। সেটা হয়তো একতরফা। একতরফা কারণ ইমারতের প্রাণ নেই। প্রাণ থাকলে ইমারতও মানুষকে ভালোবাসতো, যেমনটি মানুষকে ভালোবাসে গৃহপালিত প্রাণীগুলি।
আমি একজনকে মাঝবয়সী গৃহকর্মী-কে চিনতাম। তিনি খুলনার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে এক দালান বাড়ীতে উঠেছিলেন গৃহকর্মী হিসাবে। তারপর তিনি আর ঐ বাড়ী ছাড়তে চাইতেন না। একবার অন্য এক বাড়ীতে তার চাকুরী হলো, ২৪ ঘন্টাও তিনি অন্যবাড়ীটিতে টিকতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলেন, বললেন, “এই বাড়ী ছাড়া আমি অন্য কোথাও থাকতে পারবো না!” এরপর আমি দেখেছি যে তিনি বহু বছর ঐ বাড়ীটিতেই কাটিয়ে দিলেন, এর মধ্যে একবার বাড়ীর মালিক পরিবর্তন হয়েছিলো, কিন্তু গৃহকর্মী ঐ বাড়ীতেই রয়ে গেলেন! ইমারতের প্রতি মানুষের ভালোবাসার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ!
রাজধানীর ছেলে আমি। রাজধানীতে অনেক বড় বড় ইমারত দেখে অভ্যস্ত ছিলাম। ১৯৭৯ সালের দিকে ঢাকার সর্বচ্চো বহুতল অট্টালিকা (২৫ তলা) ‘শিল্প ভবন’ নির্মিত হয়ে গেছে। এছাড়া ডাউন টাউন মতিঝিলের বাণিজ্যিক এলাকায় তো বড় বড় ইমারত ছিলোই। তার তুলনায় সিলেট ক্যাডেট কলেজের ঐ ইমারতগুলোকে বড় বলা যাবে না অবশ্যই। কিন্তু বিদ্যালয় হিসাবে ঐগুলি বড় ইমারত নিঃসন্দেহে!
তিনতলা বিশাল ছাত্রাবাসটিই ছিলো ক্যাম্পাসের সব চাইতে বড় ইমারত। শুনেছিলাম, পুরাতন ক্যাডেট কলেজগুলিতে আছে পৃথক পৃথক ছোট ছোট হাউজ। সেই তুলনায় আমাদের একটি বিশাল ইমারত। তবে তার তিনটি তলায় তিনটি হাউজের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। নভিস ক্যাডেট হিসাবে আমার স্থান হয়েছিলো ‘হজরত শাহ্জালাল (র.) হাউজ’-এ, যার অবস্থান ছিলো দোতলায়। আমাকে যখন সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো, লম্বা করিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে যেতে থাকলাম তো থাকলাম, তারপর পৌঁছালাম দক্ষিণ দিকে একেবারে প্রান্তে সর্বশেষ (বা সর্বপ্রথম) রুমটিতে। উপরে তাকিয়ে দেখলাম রুমের নাম্বার লেখা ৩৪ (চৌত্রিশ) আমার সাথে সেখানে আরো জায়গা পেলো আসিফ ও মঈনুল, আর ছিলেন আমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের মশিয়ুর ভাই। তিনি ছিলেন আমাদের রুম লীডার। তিনজন আনকোড়া নতুন কিশোর ক্যাডেট, আর তাদের দেখভাল করার জন্য একবছরের বড় আরেকজন কিশোর। বাহ্! চমৎকার ব্যবস্থা।
আমি তাকিয়ে দেখলাম রুমের ভিতরটা যথেষ্ট প্রসস্ত! খাট, আলমারী, রিডিংটেবিল সহ ষোলটি আসবাবপত্র ও চারজন প্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা। পশ্চিম পাশে করিডোর ও ঢোকা-বের হওয়ার দরজা, পূর্ব পাশে কোন করিডোর নাই, সেখানে দুইটি জানালা। দরজা-জানালা সবই কাঁচের। সেই সময়ে কাঁচের দরজা-জানালা বিলাসিতাই ছিলো। জানালা দিয়ে তাকালে নীচেই কলেজ ক্যাম্পাসের মূল রাস্তাটি, আর তার ওপাশে খেলার মাঠ, পানির ট্যাংক ভাইস-প্রিন্সিপাল স্যারের ডুপ্লেক্স বাংলো, তার পিছনে একটি টিলার উপর মাননীয় অধ্যক্ষের দ্বিতল বৃহৎ বাংলো। তারও ওপাশে সিলেট এয়ারপোর্ট রোড, রোডের ওপাশে আরেকটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নাম তার ‘বাংলাদেশ বন বিদ্যালয়’। এর পিছনে সবুজে ঢাকা গাছ-গাছালি ও পাহাড়; তারপর দিগন্ত। পশ্চিম পাশের করিডোরে দাঁড়ালে দিগন্ত দেখা যায় না, কারণ একটু দূরেই খুব উঁচু পাহাড়। তার উপরেই নীল আকাশ। একেবারে সেই গানটির মত, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। কিছুদিন পরে এই ‘হাউজ’ নামক ইমারতের মধ্যে একটা ভয় আমাদের ঘিরে ধরেছিলো; আর তা হলো ভুতের ভয়। তবে এই বিষয়ে পরে বলবো।
দ্বিতীয় যে ইমারতটির সাথে পরিচয় হয়েছিলো দুদিন পরে, তার নাম ‘এ্যাকাডেমিক ব্লক’। স্যারকে আমাদের একজন বলেছিলো, “স্যার আজকে স্কুলে যাবো?” পিতৃতুল্য স্যার বলেছিলেন, “স্কুল না কলেজ। কলেজে পড়ো তুমি”। আমি মনে মনে ভাবলাম, ক্লাস সেভেনেই কলেজে পড়ি আমি!!! যাহোক, সেই কলেজে যখন গেলাম, দেখলাম যে, সেটা দোতলা একটা ইমারত, ইউ শেইপড বলা যেতে পারে। ইউ-এর মাঝখানে তখন ছিলো একটা বাস্কেটবল গ্রাউন্ড। এই ইমারতটির অবস্থানও ছিলো কলেজ ক্যাম্পাসের মূল সড়কটির পশ্চিম পাশে। ইউ-এর একটা বাহু ছিলো পূর্বদিকে আরেকটি বাহু পশ্চিম দিকে। ভবনটি মূলত সাদা রঙের তবে মেরুন রঙের কিছু স্ট্রাইপ উপর থেকে নীচে লম্বালম্বিভাবে টানা আছে। রঙের এই কম্বিনেশন ও ডিজাইন ভবনটিতে একটি ধ্রুপদী সৌন্দর্য্য এনে দিয়েছে। এই ভবনের জানালা দরজাও সব কাঁচের। ‘এ্যাকাডেমিক ব্লক’ ইমারতটির পূর্বপাশে ফুটবল খেলার মাঠ। তবে সেই সময়ে প্যারেড গ্রাউন্ড না থাকার কারণে, মাঝে মাঝে ঐ গ্রাউন্ডেও প্যারেড হতো। পশ্চিম পাশে পেয়ারা বাগান ও তারপর ক্যাম্পাসের একেবারে দেয়াল ঘেঁসেই উঁচু পাহাড়। তবে হ্যাঁ পরে আবিষ্কার করেছিলাম যে, ঐদিকটায় দেয়াল ও পাহাড়ের মাঝে একটা সরু ছড়া আছে, যার মধ্য দিয়ে কুলকুল করে অবিরাম বয়ে যায় টলটলে পাহাড়ী পানি। ঐ ছড়াটির নামই মালিনীছড়া। আর ঐ মালিনীছড়ার নামেই বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান ‘মালিনীছড়া টি এস্টেট’। ভনটিতে যা ছিলো তা মূলত: শ্রেণীকক্ষ। ত্রিশজন ছাত্রের চেয়ার-ডেস্ক নিয়ে বসার জন্য যথেষ্ট বড় সাইজের কক্ষ। এছাড়াও ছিলো বিজ্ঞান গবেষণাগার, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট, স্যারদের অফিস, একটি বায়োলজি মিউজিয়াম ও স্টাফ লাউঞ্জ। এর ছাদে তখন পতপত করে উড়তো দুইটি পতাকা, একটি কলেজের চৌরঙ্গা পতাকা আর অপরটি ছিলো বাংলাদেশের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা। সকাল-সন্ধ্যা বিউগলের গুরুগম্ভীর সুরের সাথে সাথে পতাকাদ্বয় উঠতো ও নামতো।
(চলবে)
————————————————–
রচনাতারিখ: ৫ই অক্টোবর, ২০১৯
সময়: রাত ১০টা ৪০ মিনিট
অট্টালিকাও ঊর্বশী হয়, প্রেমের টানে ডাকে,
ইমারতও দ্রৌপদী হয়, আবেগ ঢেলে রাখে!
দালান-কোঠার প্রেমের ভাষা কজন বোঝে বলো?
উথলে যদি ওঠে সে প্রেম, দেখবে তাকে চলো।