ভালোবাসার ইমারত (৭)
ভালোবাসার ইমারত (৭)
——————– রমিত আজাদ
প্রেমে বিরহ বা বিচ্ছেদ এলে প্রথম কিছুকাল প্রিয়জনকে প্রতি রাতেই স্বপ্নে দেখে বিরহী/বিরহীনী। এটা হবেই হবে। যার সেই অভিজ্ঞতা আছে সে শতভাগ একমত হবে আমার সাথে। তেমনি কলেজ ছাড়ার পরপর প্রায় প্রতি রাতেই ঐ ইমারতগুলোকে স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্নের ইমারত ও বাস্তবের ইমারত কি এক, না দুই? প্রশ্নটা কঠিন! চাঁদের যে প্রতিচ্ছবি হ্রদের জলে দেখা যায়, তা কি এক না দুই? মোবাইলে প্রিয়জনার যে কন্ঠস্বরটি শোনা যায়, তা কি প্রিয়জনার কন্ঠস্বর, নাকি মোবাইলে কোন ডিভাইসের কম্পনে সৃষ্ট শব্দতরঙ্গ? কেমন ধাঁধাঁয় ফেলে দিলাম দেখলেন? উত্তর হ্যাঁ না যেটাই হোক, ঐ ভালোবাসাটা কিন্তু খাঁটি!!!
ইমারতগুলোকে সত্যিই স্বপ্নে দেখতাম। ওদের সাথে মায়া ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিলো যে! তিনটি তলায় তিনটি হাইজ। প্রতিটি হাউসে একটি করে টিভি রুম ছিলো। আমাদের অন্যতম বিনোদনের জায়গা ছিলো ওগুলো। প্রথমে ছিলো সাদাকালো টিভি। যদিও সেই ১৯৮০ সাল থেকেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়েছিলো, কিন্তু রঙিন টিভি কলেজে তখনও চালু হয়নি। ১৯৮৪ সালে মাননীয় প্রিন্সিপাল প্রফেসর নজরুল ইসলাম স্যারের কাছে ক্যাডেটরা আবদার করলো, “স্যার রঙিন টিভি দেখতে চাই।” গুরুগম্ভীর স্যার বলেছিলেন, “হবে”। স্যার কথা এম্নি এম্নি বলতেন না, যা বলতেন তাই করতেন। কিন্তু এবার যে এত বেশী করবেন তা আশা করিনি। শুনেছিলাম অন্যান্য কলেজে একটা করে রঙিন টিভি কেনা হয়েছিলো, পুরো কলেজের জন্য। প্রফেসর নজরুল ইসলাম স্যার ঝম করে তিনটি বড় বড় রঙিন টিভি কিনে আনলেন তিনটি হাউজের জন্যে আলাদা আলাদা, তাও আবার সেরা ব্র্যান্ডের! আমরা তো আহ্লাদে আটখানার উপর ষোলআনা হলাম। ব্যাস যায় কোথায়? প্রতি উইকএন্ডে গেড়ে বসে থাকলাম সাধের টিভি রুমে। বসার ব্যবস্থা ছিলো, জুনিয়ররা সামনে কার্পেটের উপর আর সিনিয়ররা পিছনে বেঞ্চিতে। আমি আর রেজোয়ান ভাই সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও একেবারে সামনে উত্তর পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে আরামে বসে টিভি দেখতাম স্পেশাল অনুষ্ঠানগুলো। প্রিফেক্টরা আমাদের সামনের আসন নিয়ে কিছু বলতেন না। কারণ আমি টিভি-টা অপারেট করতে পারতাম ভালো! কেউ কেউ ভাবতো, আমাদের বাড়ীতে ঐ ব্র্যান্ডের টিভি আছে বলেই আমি ভালো পারি, তারা আসলে জানতো না যে, হাউজের টিভিটাতেই এক্সপেরিমেন্ট করে আমি ওটা অপারেট করা শিখেছিলাম! তখন বৃহষ্পতিবার ও শুক্রবার রাতে এবং শুক্রবার দিনে ছিলো টিভি টাইম, অন্যান্য দিন/রাতে টিভিরুম বন্ধ থাকতো। তবে আমরা আবার লুকিয়ে চুরিয়ে টিভি দেখার ব্যবস্থাও করতাম! ‘ছায়াছন্দ’ নামে তখন একটা অতি জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান হতো। অনুষ্ঠান-টি ছিলো সিনেমার গানের। ঐ বয়সে নায়ক-নায়িকাদের নাচ-গান দেখতে ভালো-ই লাগতো! আমি বলতাম বয়সের দোষ! রেজোয়ান ভাই বলতেন বয়সের গুণ! পরীক্ষার সময় টিভি দেখা হারাম ছিলো। তাই টিভি রুম বন্ধ থাকতো। একবার পরীক্ষার সময়, ছোঁচা বিড়ালের মত খবর পেলাম টিভিতে ‘ছায়াছন্দ’ হচ্ছে; এদিকে কোন এক তিলিসমাত বিশেষ কেরামতিতে দোতলার টিভি রুমটি খোলার ব্যবস্থা করে ফেলেছে! পরীক্ষার পড়া-টড়া রেখে সোজা দৌড় দিলাম ঐদিকে। আমার মত যারা গোপন সংবাদ পেয়েছে, তাদের অনেকেই উপস্থিত; জনা তিরিশেক কাবিল চুপচাপ বসে গেলাম সিনেমার নাচ-গান দেখতে। কায়দা করে টিভি রুমের সামনের মূল দরজাটি বন্ধ রাখা হলো, বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে; যাতে স্যার দেখে মনে করেন টিভি রুম তো বন্ধই আছে। আর পিছনের ছোট দরজাটি ভেজিয়ে খোলা রাখা হলো, যাতে কোন আওয়াজ পেলেই শট করে ঐদিক দিয়ে পালানো যায়। তিনটার মত গান বেশ রসিয়ে রসিয়ে দেখলাম! লুকিয়ে টিভি দেখা জমে উঠেছে, এমন সময় শ্রদ্ধেয় অমিতাভ বিশ্বাস স্যার যমদূতের মত উপস্থিত হলেন; তাও আবার পিছনের দরজা দিয়ে। এদিকে সামনের দরজা বন্ধ, অতএব পালানোর পথ নেই, পড়লাম ফান্দে!
কমনরুম ছিলো আরেকটি বিনোদনের জায়গা। তবে সেটা যারা ইনডোর গেম পছন্দ করতো তাদের জন্য। বিশেষত টেবিল টেনিস বা পিংপং খেলাটা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। আমাদের ব্যাচের মাহমুদ, রিমন এবং ওয়াদুদ দুর্দান্ত খেলতে পারতো পিংপং। একপাশে ক্যারাম চলতো। আরো ছিলো দাবা খেলা। আমি দাবা ভালো খেললেও মিল্কীর সাথে সবসময় হেরে যেতাম। রিডিং রুমটা পছন্দ করতাম আমি। ওখানে অনেকগুলো বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা আসতো। খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম সবগুলো। ক্যাডেটদের সাধারণ জ্ঞান সমৃদ্ধ করার পিছনে ঐ রিডিং রুমগুলির অবদান ছিলো।
আমরা যখন ক্লাস এইটে, শ্রদ্ধেয় নুরুল হক স্যার এলেন আমাদের ‘সাধারণ জ্ঞান ও কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স’ ক্লাস নিতে। প্রথম দিনের ক্লাসে স্যার বললেন, ” আমি তোমাদের সাধারণ জ্ঞান ও কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স’ ক্লাস নিবো। তোমরা হাউজের সব পত্রিকাগুলো মনযোগ দিয়ে পড়ে আসবে, তারপর ক্লাসে এসে আমাকে সব বলবে, কেমন?” আমরা বললাম, :না স্যার, আমরা ছাত্র, আপনি হলেন শিক্ষক; আমরা পত্রিকা পড়বো কেন? আপনি সব পত্রিকা পড়ে আসবেন, তারপর আমাদেরকে বলবেন, এভাবে আমরা শিখবো।” দুষ্টু বিচ্ছুদের কথা শুনে স্যার সরু চোখে তাকালেন। তবে স্যারের মনেও কৌতুক খেলা করছিলো!!!
(চলবে)
রচনাতারিখ: ১০ই অক্টোবর, ২০১৯
সময়: রাত ১০টা ১৯ মিনিট
—————————————————————————-
স্বপ্নপূরীর দিন ফুরালো, হারিয়ে যাবে সে,
স্বপ্নপূরীর বিদায় বেলায় কান্না চাপে কে?
আমরা সবাই স্বর্গশিশু, ফুলে ফুলে মধুকর,
স্বপ্নগৃহ ডাকছে আবার, যেতেই হবে বাজিকর।