ভালোবাসার ইমারত (৮)
ভালোবাসার ইমারত (৮)
——————– রমিত আজাদ
বৃহত্তম ইমারতের একতলায় ছিলো কলেজ ডাইনিং হল। ঐ তলাতেই ছিলো তিতুমীর হাউজ। ঐ হাউজের বর্তমান কমন রুমটিকে ব্যবহার করা হতো ডাইনিং হল হিসাবে। বর্তমান মূল স্থায়ী ডাইনিং হলটি তখনো নির্মিত হয়নি, এটা ১৯৮২ সালের কথা। অতটুকু হলে তিনশত জন ক্যাডেটের চাপাচাপি করেও স্থান সংকুলান হত না, বিধায় একতলার আরো দুইটি রুমকে ডাইনিং-এর জন্য ব্যবহার করা হতো। সবকিছুরই পজেটিভ-নেগেটিভ দিক আছে। ঐ রুমগুলোর একটিতে আমি বসতাম, নেগেটিভ দিক হলো বিচ্ছিন্ন থাকতাম তাই মূল হলে কি হচ্ছে তা দেখতে পারতাম না। আর পজেটিভ দিক ছিলো যে, মূল হলে কিছু হলে, মানে স্যার যদি কোন কিছু চেক করতে বের হতেন এইদিকে আগেই খবর চলে আসতো, আর আমরা আগে-ভাগেই সতর্ক হয়ে যেতাম। একবার তো এক বিশাল হাস্যকর ঘটনা ঘটলো, সেটা ছিলো পরোটা নাইট; মানে রাতের ডিনারে মাংসের সাথে পরোটা খেতে দেয়া হতো। বড় বড় সাইজের তিনটা পরোটা অনেকের প্রয়োজনের তুলনায় বেশীই ছিলো। তাই মাঝে মধ্যে অনেকে দুইটা পরোটা খেয়ে একটা রেখে দিতো। কর্তব্যরত শিক্ষকদের (ডিউটি মাস্টার) সবাই বিষয়টা ধরতেন না। আনফরচুনেটলি ঐদিন ডিউটি মাস্টার ছিলেন শ্রদ্ধেয় চৌধুরী আনিসুর রহমান স্যার (তিনি পরবর্তিতে আর্মী এডুকেশন কোরে চাকুরী করেন, সর্বশেষ ঢাকার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-এর অধ্যক্ষ হিসাবে অবসর গ্রহন করেন)। স্যার একদিকে ছিলেন প্রচন্ড স্নেহপরায়ন, অপরদিকে ছিলেন ভীষণ মেজাজী। স্যার যখন দেখলেন যে অনেকেই তিনটা পরোটা খায়নি, তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন। হুংকার দিয়ে উঠলেন, “দেশের মানুষ খেতে পায়না আর উনারা পরোটা নষ্ট করেন!” দাড়াও দেখাচ্ছি মজা! শুরু করলেন নাম ও ক্যাডেট নাম্বার টোকা, উদ্দেশ্য অফিসিয়াল পানিশমেন্ট ‘এক্সট্রা ড্রীল’ দেবেন। ডাইনিং-এর মূল হলে যখন অভিযান চলছিলো, ততক্ষণে খবর চলে এসেছে পার্শ্ববর্তী রুম দুইটিতে। সবার মনে শংকা যেকোন মুহূর্তে স্যার প্রবেশ করতে পারেন, কি করা যায়? কি করা যায়? হঠাৎ একজনার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেলো। প্লেটের উপর থেকে না খাওয়া পরোটা-টা সরিয়ে ডান হতের তালুর উপর নিয়ে, টেবিলের নীচে ধরে রাখলো। তার দেখাদেখি বাকীরাও একই কাজ করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রবেশ করলেন রুদ্রমূর্তি স্যার। হুংকার দিয়ে উঠলেন, “দেশের মানুষ খেতে পায়না আর উনারা পরোটা নষ্ট করেন!” তারপর তাকিয়ে দেখলেন যে, এই রুমে সবার প্লেট খালি, প্রসন্ন হলেন স্যার, ‘বাহ্ এরা তো ভালোই!’ তারপর আবার বললেন, “দেশের মানুষ খেতে পায়না আর তারা পরোটা নষ্ট করে! ‘এক্স’ পরোটা খেতে কেমন লাগে?” যার নাম বললেন তিনি আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন, প্রচন্ড ভালো মানুষ! লেখাপড়ায়ও দুর্দান্ত। অংক পারতেন যাদুর মত। তাই অংক ও ফিজিক্সের শিক্ষক আনিস স্যার উনাকে বিশেষ পছন্দও করতেন। এদিকে স্যারের প্রশ্ন শুনে হতচকিত হয়ে গেলেন তিনি! তারপর মিনমিন করে উত্তর দিলেন, “মোটামুটি স্যার।” এবার ক্ষেপে উঠলেন স্যার, “হোয়াট ইজ মোটামুটি? হয় ভালো, নয় খারাপ। নো মোটামুটি বিজনেস!” এক্স ভাই উত্তর দিলেন, “ভা ভা ভালো স্যার।” স্যার শান্ত হয়ে বললেন, “গুড। তা সবগুলো পরোটা খেয়েছে?” অত ভালো মানুষ ভাই আর মিথ্যে বলতে পারলেন না। মাথা নীচু করে বললেন, “না স্যার।” আবার রুদ্র মূর্তি হলেন স্যার, “হোয়াট? কটা খেয়েছ?” এক্স ভাই বললেন, “দুইটা স্যার”। স্যার তো হতবাক, প্লেট ফকফকা খালি, আর তিনি বলছেন দু’টা পরোটা খেয়েছেন। হুকার দিয়ে উঠলেন স্যার, “আরেকটা পরোটা কোথায়?” তিনি বললেন, “আছে স্যার”।
স্যার: কোথায় আছে?
এক্স: আছে তো।
স্যার: কোথায় আছে?
এরপর তিনি টেবিলের নীচ থেকে ডান হাত তুলে উঁচু করে পরোটা-টা দেখালেন। বেচারার সুন্দর হাতে না খাওয়া পরোটা-টা ঝুলছে; স্যারের মুখেও ক্রোধ আর ভ্যাবাচেকা ভাব! আমরা কেউ হাসি আটকাতে পারলাম না। ফিক ফিক করে সবাই হাসতে শুরু করলাম!
স্যার বললেন, “মাফ নাই, মাফ নাই, তোমার এক্সট্রা ড্রীল হবে।”
স্যারের এই রায় শোনার পর এক্স ভাই বলেন, “না স্যার আমি খাই, আমি তো পরোটা খাই।” এই বলে দ্রুতগামী মানবের মত এক মিনিটেই পরোটা-টা গলাধঃকরণ করলেন! দৃশ্যটি এতটাই হাস্যকর ছিলো যে আমরা পরপর কয়েকদিন এটা মনে করে হেসেছিলাম।
এদিকে শোনা গেলো যে নতুন ডাইনিং হল নির্মিত হবে। শ্রদ্ধেয় শফিকুল আজম স্যার ট্রান্সফার হয়ে এলেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক তরুণ স্যারকে আমরা প্রথম থেকেই ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। প্রথমতঃ তিনি ছিলেন সুদর্শন ও বিনয়ী, দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন প্রবল সংস্কতিমনা। আমাদের জীবনে ডিবেট, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদির হাতে খড়ি স্যারের হাত ধরেই। কথা বলেন চমৎকার সুন্দর গুছিয়ে! স্যারকে আমরা প্রশ্ন করলাম, “স্যার আর.সি.সি. কেমন?” বিনয়ী স্যার বললেন, “ভালো। এই কলেজও ভালো। তবে তোমাদের ডাইনিং হল-টা ছোট। ওখানে বিশাল বড় ডাইনিং হল!” আমাদের মন খারাপ হলো, তবে আমরা বললাম, “স্যার আমাদেরও বড় ডাইনিং হল নির্মিত হচ্ছে!” আমরা হাউজের গা ঘেসে মূল রাস্তার পাশে নতুন ডাইনিং হলের স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে যেতে দেখলাম, তবে তা বাইরে থেকে; ভিতরে কি অবস্থা জানি না। নির্মানাধীন অবস্থায় ভিতরে ঢোকা নিষেধ ছিলো। একদিন বিকালে সুযোগ পেয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম আমি ও আরো তিনজন সহপাঠি। ভিতরে ঢুকে তো তাজ্জব বনে গেলাম, এত সুন্দর হল! মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম মাননীয় প্রিন্সিপাল ও সরকার-কে। ঐ ডাইনিং হলটি সেই সময়ে আমাদের দেখা সেরা হল ছিলো!
তারপর নতুন ডাইনিং হল চালু হওয়ার পর দিনে পাঁচবার সেখানে খাওয়া-দাওয়া। সৃস্টিকর্তার নামে আহার শুরু হতো, এবং আহার শেষে পরম করুণাময়-এর শোকর গুজারি করা হতো। সিনিয়র-জুনিয়র হৃদ্যতার পরিবেশে ভোজন। স্যারদের ঘুরে ঘুরে আমাদের খাওয়া দেখা ও কার্টেসী শেখানো, ইত্যাদি। এ ছাড়াও ছিলো বিভিন্ন ভোজসভায় বড় বড় ব্যাক্তিদের আগমন। ঐ শিশু-কিশোর বয়সেই সৌভাগ্য হয়েছিলো নামী-দামী ব্যাক্তিদের সাথে এক টেবিলে এক হলে বসে ভোজন করার। উনারা নানা অকেশনে ভোজসভার অলংকার ও মধ্যমণি হয়ে আসতেন আমাদের উৎসাহ দিতে, অনুপ্রেরণা দিতে ও ভবিষ্যতের সাহস জোগাতে। আজ ম্যাচিয়ুরড জীবনে আবারো উনাদের সাথে এক টেবিলে এক সভায় বসতে পারছি, এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের। তবে ঐদিনের প্রশিক্ষণ-টাই যে এইদিনে টেনে এনেছে সেটা অকপটে স্বীকার করছি।
ডাইনিং হলের বাইরে ছিলো একটি নোটিশ বোর্ড। সেখানে মাঝে মাঝে নোটিশ ঝোলানো হতো। উদ্দেশ্য ছিলো, যাতে নোটিশ পড়ে আমরা জ্ঞাতব্য বিষয়টি জানতে পারি। আমাদের ব্যাচের ‘এস’ ছিলো মজার মানুষ! ও মাঝে মাঝে ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে ইচ্ছে করেই নোটিশ বোর্ড-এর সামনে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতো। এমন ভাব করতো যেন খুব মনযোগ দিয়ে কিছু পড়ছে। ঐ দেখে অন্যরা ভাবতো নিশ্চয়ই নতুন কোন নোটিশ এসেছে! ধীরে ধীরে ওর চারদিকে বিশাল ভীড় জমে যেত। সবাই উৎসুক হয়ে উঁকি-ঝুঁকি দিতো। ‘এস’ তারপর আস্তে করে কেটে পড়তো! কিছুক্ষণ উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে ঠক খেয়ে সবাই চলে যেত, কিন্তু বুঝতে পারতো না যে, ঠিক কে ওদেরকে ঠক খাওয়ালো!!!
ডাইনিং হলে আমার একটি কাকতালীয় স্মৃতি মনে পড়ে।
আমাদের পূর্ববর্তি ব্যাচের বিদায়ের দিন, বিদায়ী ভোজসভায় এই ডাইনিং হলেই আমাকে প্রেজেন্ট ক্যাডেটদের পক্ষ থেকে বিদায়ী ব্যাচ-কে বিদায় জানাতে ভাষণ দিতে ও অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে হয়েছিলো। আবার ঠিক এক বৎসরের মাথায়, আমাদের ব্যাচের বিদায়ের দিন, বিদায়ী ভোজসভায় এই ডাইনিং হলেই আমাকে আমাদের ব্যাচের পক্ষ থেকে ‘বিদায় ভাষণ’ দিতে হয়েছিলো। সেদিন আবেগ ছিলো ভরা নদীর মত! আমাদের শ্রদ্ধেয় উপাধ্যক্ষ আল-আমীন স্যার বলেছিলেন, ক্যাডেট কলেজে একজন প্রবেশ করে বাল্যের চঞ্চলতা নিয়ে, আর বেরিয়ে যায় যৌবনের উদ্দামতা নিয়ে! দেয়া-নেয়া, আসা-যাওয়া এই ধরণীর চিরন্তন!!! আমাদের মতন, আমাদেরকে বুকে ধরে রাখা ইমারতগুলোকেও বিদায় নিতে হচ্ছে!!!
(চলবে)
রচনাতারিখ: ১৩ই অক্টোবর, ২০১৯
সময়: রাত ১২ টা ৪৭মিনিট
—————————————————————————-
আসলে যখন যেতেই হবে, এই তো ধরণী রীতি!
মাঝের সময় উচ্চ শিরে, গাইবে চলার গীতি।
যাবো বলে করবো না কাজ, এমন ধারা চলবে না,
হোক ইনসান, হোক ইমারত, জগৎ বিধি ভাঙবে না!