
মহাবিশ্ব এত বড় কেন?
মহাবিশ্ব এত বড় কেন?
———————— ড. রমিত আজাদ
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র (ইউরোপে), তখন একদিন আমার এক সহপাঠী প্রশ্ন করেছিলেন,
সহপাঠী: তোমার কি মনে হয়, এই মহাবিশ্বে কি আমরাই একমাত্র চৈতন্যসম্পন্ন সত্তা?
আমি: আমরা তো সঠিক জানিনা। এখন পর্যন্ত তো অন্য কোন চৈতন্যসম্পন্ন সত্তা-দের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয় নাই।
সহপাঠী: এই এত বড় মহাবিশ্বে কি আর কোন চৈতন্যসম্পন্ন সত্তা থাকার সম্ভাবনা নাই?
আমি: থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে।
সহপাঠী: আমরা ছাড়া যদি আর কোন চৈতন্যসম্পন্ন সত্তার অস্তিত্ব না থাকে তাহলে এত বড় মহাবিশ্বটার দরকার কি?
আমি: কেন? এত বড় মহাবিশ্বটা কি কেবল আমাদের জন্যই হতে পারে না?
সহপাঠী: মনে করো যে সৃষ্টিকর্তা শুধুই আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এই আমাদের ভালো-মন্দ পরীক্ষা করার জন্য। তাহলে তো শুধু সৌরজগৎটা হলেই হতো, এত বড় মহাবিশ্বের তো আর প্রয়োজন হয় না।
ওর প্রশ্নে আমি একটু ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। তাই তো, শুধুই আমাদের জন্য হলে এত বড় মহাবিশ্বের দরকার টা কি?
আমার চিরটাকালই মনে হয়েছে যে, আমাদের চারপাশে যা ঘটছে ও ঘটেছে তার সবটাই যৌক্তিক। তাই এই বিশাল বড় মহাবিশ্বটাও যৌক্তিক। কিন্তু তার ব্যাখ্যাটা আমার কাছে নেই। তবে সেই ব্যাখ্যাটা আমাকে জানতে হবে। যদি কোন বিজ্ঞানী/দার্শনিক সেটা ইতিমধ্যেই খুঁজে বের করে থাকেন, তাহলে উনাদের লেখা পড়ে জেনে নেব। আর যদি তা বের না হয়ে থাকে তাহলে নিজেকেই সেটা বের করার চেষ্টা করতে হবে।
পরবর্তিকালে আমি কসমোলজি নিয়ে পড়েছিলাম এবং আমার মাস্টার্স-এর থিসিসও ছিলো কসমোলজি-র উপরে। এর চাইতে ইন্টারেস্টিং কিছু হতে পারে বলে আমার মনে হয়নি।
যাহোক, সেই সময়ে ও পরবর্তিকালে আমি ঐ বিষয়টির/প্রশ্নটির একটি ব্যাখ্যা পেয়েছি।
মাল্টি ডিসিপ্লিনারী বা interdisciplinary studies বলে একটা কথা আছে। ওমার খৈয়াম বা ইবনে সিনা-র মত পৃথিবী জাগানো/কাঁপানো পন্ডিতরা শুধু শুধুই পলিম্যাথ হননি। আসলে বিশ্বটাকে জানতে গেলে, একটা সাবজেক্ট যথেষ্ট নয়, অনেকগুলো সাবজেক্ট-এর জ্ঞানই প্রয়োজন পড়ে।
থিসিস করার সময় জানতে পেরেছিলাম সম্প্রসারনশীল মহাবিশ্বের কথা (যদিও এই বিষয়ে আগেই পপুলার বুকে পড়েছিলাম, তবে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সাথে পরিচিত ছিলাম না)। মহাবিশ্ব ছিলো না। যা ছিলো তাকে বলে ‘ফিজিকাল ভ্যাকিউম’। সেটা হঠাৎ ফ্লাকচুয়েট করলো। ছোট্ট একটা বিন্দু বিষ্ফোরিত হলো (যার নাম বিগ ব্যাং)। আমরা আতশ-বাজি পোড়ানো হলে দেখে থাকি যে, একটি বোমা বিষ্ফোরিত হওয়ার পর তা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হতে হতে ছোট থেকে বড় হয়। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও অমনটিই ঘটেছে। এবার প্রশ্ন জাগবে, এখন আমরা মহাবিশ্বের কোন পর্যায়ে আছি? হ্যাঁ, একজন জ্ঞানতাপস আল হাইয়াম আমাদের উপহার দিয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞান, আরেকজন জ্ঞানতাপস আলবার্ট আইনস্টাইন আমাদের উপহার দিলেন কসমোলজি, যার বাংলা নাম ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’, কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন-এর তত্ত্ব ছিলো থিওরেটিকাল (কাগজে কলমে গণিতের ভাষায়), আর আল হাইয়াম বলেছেন যে যতক্ষন পর্যন্ত কোন জ্ঞান ইমপিরিকালী প্রমাণিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ জ্ঞান বিজ্ঞান বলে স্বীকৃতি পাবে না। তাই আইনস্টাইন-এর তত্ত্বটির ব্যবহারিক প্রমাণের প্রয়োজন ছিলো। সেই কাজটিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন আরেকজন জ্ঞানতাপস এডউইন হাবেল। তিনি তার বিশালাকৃতির টেলিস্কোপটি নিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে ছিলেন তার অপার রহস্য উদ্ধার করতে। সেই তিনিই আবিষ্কার ও প্রমাণ করলেন যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিতই হচ্ছে। এবার প্রশ্ন কত বছর ধরে তা সম্প্রসারিত হচ্ছে? উত্তর পাওয়া গিয়েছে – প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর ধরে। আবার প্রশ্ন, কি করে নির্ণয় করলেন এই সময়? হ্যাঁ, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাকে কিছুটা রসায়ন বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো ‘পিরিয়ডিক টেবিল’ যেটা বানানোর জন্য মানবজাতিকে বহু বছর সাধনা করতে হয়েছিলো, অবশেষে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফ কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। মৌলিক পদার্থগুলির (হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন, তামা, সোনা, রুপা, লোহা, ইত্যাদি) অনেকগুলির সাথেই মানবজাতি পরিচিত সেই সভ্যতার শুরু থেকেই। তবে তারা যে মৌলিক পদার্থ তা জানতে ও তাদের ভিতরের গঠনটা জানতে অনেক সময় লেগেছিলো আমাদের। ধারনা করা হয় যে, স্বর্ণ তৈরী করার প্রচেষ্টা থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিলো রসায়ন বিজ্ঞানের। কোন একটা কিছু তৈরী করতে গেলে তার ভিতরের গঠনটা জানা খুব জরুরী। স্বর্ণের ভিতরের গঠন যতদিন জানা হয়নি ততদিন কৃত্রিম উপায়ে স্বর্ণ তৈরী করাও সম্ভব হয়নি। পরমাণুর কথা আজ থেকে ২৬০০ বছর আগে প্রথম বলেছিলেন, এই উপমহাদেশের দার্শনিক কণাদ। বৈজ্ঞানিকভাবে তাকে আবিষ্কার করেছিলেন মাত্র দুশো বছর আগে জন ডালটন। আর তারপর পরমাণুর ভিতরের খোঁজ দিলেন বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড। আমাদের সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন যে, যেকোন পরমাণু মানেই তার ভিতরে তিন ধরনের কণিকার সমাহার – ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। অর্থাৎ, তামা, সোনা, রুপা, লোহা, যাই বলি না কেন তার ভিতর ঐ তিন ধরনের কণিকা থাকবেই।
এই পর্যায়ে জন্ম হয় নতুন প্রশ্নের – তাহলে নানান রকম মৌলিক পদার্থের রহস্য কি? রাইট, এই পর্যায়ে আসবে ফিলোসফি। একটি দর্শন হলো, ‘পরিমানগত পরিবর্তন থেকে গুনগত রূপান্তর’। মানে হলো পরিমানের পরিবর্তন থেকে গুনেরও রূপান্তর হতে পারে। আর ওটাই ঘটেছে মৌলিক পদার্থগুলোর রূপ ভিন্নতার ক্ষেত্রে – সবচাইতে হালকা ও সরল মৌলিক পদার্থ-এর নাম হাইড্রোজেন (এটাই মহাবিশ্বের প্রথম মৌলিক পদার্থ)। যার গঠনে রয়েছে মাত্র একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন। দ্বিতীয় অবস্থানে হিলিয়াম সেখানে রয়েছে দুইটি প্রোটন দুইটি নিউট্রন ও একটি ইলেকট্রন। এভাবে প্রোটন সংখ্যা বাড়ালে মৌলিক পদার্থও পাল্টে যায়। যেমন লিথিয়ামে তিনটি প্রোটন, বেরেলিয়ামে চারটি, বোরনে পাঁচটি, কার্বনে ছয়টি প্রোটন রয়েছে, ইত্যাদি।
এবার আসা যাক বায়োলজিতে। আমরা মানুষেরা এক জাতীয় প্রাণী। পাতিশিয়াল বা খাটাসও প্রাণী। তাহলে মানুষ, পাতিশিয়াল ও খাটাসের মধ্যে কোন না কোন মিল থাকবেই। এদিকে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করেছিলেন যে গাছেদের অনুভূতি রয়েছে, সেই গাছেরা প্রাণী না হলেও জীব। তাহলে প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যেও কোন না কোন মিল থাকবে। শেষমেশ বিজ্ঞানীরা সেই মিলটি খুঁজে পেয়েছেন। মিলটি হলো – যেকোন জীবের শরীরেই কার্বন থাকে, কার্বন ছাড়া কোন জীব হতে পারে না।
তাহলে জীবের জন্ম হওয়ার আগে এই মহাবিশ্বে হাইড্রোজেন থেকে কার্বন ফর্মেশন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে পেয়েছেন যে, মহাবিশ্বে কার্বন ফর্মেশন হতে সময় লেগেছে মিনিমাম ১০ বিলিয়ন বছর। আবারো প্রশ্ন – এই হিসাবে বের করা হলো কি করে? সহজ উত্তর, ম্যাথমেটিক্স ব্যবহার করে। ক্যালকুলাসে একটি টার্ম আছে ‘ডেরিভেটিভ’ – সংজ্ঞানুযায়ী যা হলো ‘রেট অব চেইঞ্জ’, অতএব রেট বের করা গেলে, ওটা ব্যবহার করেই টোটাল টাইমটা বের করা যায়। ইতিমধ্যেই ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজী ও ম্যাথমেটিক্স চারটি সাবজেক্ট ব্যবহার করা হয়ে গেছে। এই করতে গিয়ে একজন বিজ্ঞানীর পলিম্যাথ না হয়ে উপায় আছে?
যাহোক এবার ফিরে আসি মহাবিশ্বের সাইজে।
দীর্ঘ দশ বিলিয়ন বছর লেগেছে শুধু কার্বন ফর্মেশন হতে, তারপর অন্যান্য মৌলিক পদার্থের ফর্মেশন এবং সেখান থেকে ইন-অর্গানিক ও অর্গানিক কেমিকাল ফর্মেশন তারপর এককোষী প্রাণী, সেখান থেকে বহুকোষী প্রাণী আর বিবর্তনের সর্বশেষ ধাপে চৈতন্যসম্পন্ন মানুষ তৈরী হতে সময় লেগেছে প্রায় চৌদ্দ বিলিয়ন বছর। এই এতগুলো বছর ধরে মহাবিশ্বকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। শুধু বেঁচেই নয়, তাকে সম্প্রসারিত হতে হয়েছে, নিঁখুতভাবে (যা নাও হতে পারতো)। এতগুলো বছর ধরে যদি সম্প্রসারিত হতেই থাকে তাহলে মহাবিশ্বের এই বিশাল আকৃতি হওয়াটা অতীব স্বাভাবিক। ঠিক এই কারণেই মহাবিশ্ব এত বিশাল!
তারিখ: ২২শে অক্টোবর, ২০১৭
সময়: ভোর চারটা দশ মিনিট
খুবই তথ্যবহুল এবং চমৎকার লেখা । ইজি পাবলিকেশনসের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর লেখনীর জন্য ।