
মানুষের কোন নিষ্ক্রিয় অঙ্গ নেই
মানুষের কোন নিষ্ক্রিয় অঙ্গ নেই
দাবীটি ভ্রান্ত। মনবদেহে অজস্র নিষ্ক্রিয় অঙ্গের (vestigial organ) অস্তিত্ব আছে, যেগুলো একসময় আমাদের পূর্বপুরুষদের কাজে লাগলেও এখন আর লাগে না। এখন এগুলো একান্ত অবান্তর। মানুষের দেহেই এমন শতাধিক বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গাদির অস্তিত্ব আছে।
১) এপেনডিক্স
ভারমিফর্ম এপেনডিক্স আসলে সিকাম নামক একটি অঙ্গের অবশিষ্টাংশ, যা মূলত তৃণভোজী প্রাণীদের দেহে অবস্থিত থাকে এবং এই অঙ্গে বসবাসকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলো উদ্ভিদ কোষের সেলুলোস প্রভৃতি উপাদান পরিপাকে সাহায্য করে। এই অঙ্গ মূলত সেসব মাংসাশী প্রাণীর দেহে পাওয়া যায় যারা একটু হলেও উদ্ভিদ ভক্ষণ করে।মানুষের তৃণভোজী পূর্বপুরুষেরা এই অঙ্গকে উদ্ভিদ হজম করার কাজে ব্যবহার করত। প্রাচীন নরবানর যেমন অস্ট্রালোপিথেকাস রবাস্টাস তৃণ সহ সেলুলোজ জাতীয় খাদ্য প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করত। এখনো শিম্পাঞ্জীরা মাংশাসী নয়। কিন্তু মানুষ খাদ্যাভাস বদল করে লতা পাতার পাশাপাশি একসময় মাংশাসী হয়ে পড়ায় দেহস্থিত এই অংগটি ধীরে ধীরে একসময় অকেজো এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাই এখন অ্যাপেন্ডিক্স আমাদের কাজে না লাগলেও রেখে দিয়ে গেছে আমাদের জন্য ‘বিবর্তনের সাক্ষ্য’। এটি এখন আমাদের কোন উপকারে আসে না, বরং, এপেন্ডিক্সের প্রদাহজনিত এপেন্ডিসাইটিস রোগের বড় উৎস হচ্ছে এই এপেন্ডিক্স। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এপেন্ডিক্স নামের প্রত্যঙ্গটি না থাকলে মানুষের কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু এপেন্ডিক্স থাকলে সারা জীবনে অন্ততঃ ৭% সম্ভাবনা থেকে যায় এপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্ত হবার।
চিত্রঃ অ্যাপেন্ডিক্স দেহের কোনই কাজে লাগে না, বরং বর্তমানে অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগের বড় উৎসই হল এই অ্যাপেন্ডিক্স।
২) পুচ্ছ অস্থি
Coccyx অথবা পুচ্ছ অস্থি হারানো লেজের অবশিষ্টাংশ। প্রত্যেক স্তন্যপারী প্রাণীরই তাদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার কোন না কোন পর্যায়ে এই লেজ ধারণ করে; মানুষের এমব্রায়োজেনেসিসে ১৪ থেকে ২২তম পর্যায়ে ৪ সপ্তাহ ধরে মানবভ্রুণে এই লেজ পরিলক্ষিত হয়। ৩১-৩৫ দিন বয়স্ক মানবভ্রুণে এই লেজ সবচেয়ে সুপ্রত্যক্ষ হয়। মানবদেহের মেরুদন্ডের একদম নীচে থেকে যাওয়া এই হাড়টি আমাদের কোন কাজেই আসে না। আমাদের আদি প্রাইমেট পূর্বপুরুষেরা গাছের ডালে ঝুলে ভারসাম্য বজায় রাখার কাজে একে ব্যবহার করত। মানুষের জন্য এটি এখন আর ভারসাম্য রক্ষা আর চলিষ্ণুতার কাজে ব্যবহৃত হয় না, তবে পেশির সাথে হাড়ের সংযুক্তি স্থাপনের স্থান হওয়ার কারণেই হয়ত এই অস্থিটির আর অধঃপতন ঘটেনি।
পুচ্ছ অস্থি ছাড়াও, লেজবিশিষ্ট মানব শিশু প্রকৃতিতে মাঝে মধ্যেই জন্ম নিতে দেখা যায়। এটা বিবর্তনের কারনেই ঘটে। কারণ, কোন অংগ লুপ্ত হয়ে গেলেও জনপুঞ্জের জীনে ফেনোটাইপ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ডিএনএ সেই তথ্য রেখে দেয়। তার পুনঃপ্রকাশ ঘটতে পারে বিরল কিছু ক্ষেত্রে। ব্যপারটিকে বিবর্তনের পরিভাষায় বলে । ১৮৮৪ সাল থেকে চিকিৎসা সাহিত্যে এরকম তেইশটি ঘটনা প্রতিবেদিত হয়েছে।
চিত্রঃ মানবদেহের মেরুদন্ডের একদম নীচে থেকে যাওয়া এই হাড়টি আমাদের কোন কাজেই আসে না।
৩) আঁক্কেল দাঁত
আঁক্কেল দাঁত মানুষের পূর্বপুরুষেরা উদ্ভিদ কলা চর্বণে ব্যবহার করত।সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে মানুষের পূর্বপুরুষের বহু দন্ত বিশিষ্ট দীর্ঘকায় চোয়াল ছিল, উদ্ভিদ কোষের সেলুলোস হজমের দুর্বলতার জন্য এই বড় বড় চোয়াল খেসারত দিত। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হলে প্রাকৃতিক নির্বাচন ছোট চোয়ালকেই নির্বাচিত করেছিল, তবুও এই বাড়তি দাঁতগুলো এখনো বিদ্যমান রয়ে গিয়েছে।
৪) কান নাড়ানোর পেশী
Macaque বানর সহ অনেক বানরের কর্ণপেশী মানুষের থেকে উন্নত, তাই তারা তাদের কান নাড়িয়ে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে। মানুষ, ওরাংওটাং এবং শিম্পাঞ্জীর মত অন্য প্রাইমেটদের কর্ণপেশী যৎসামান্য উন্নত এবং অকার্যকর।যে পেশী কর্ণের সাথে যুক্ত কিন্তু কান নাড়াতে পারে না, সেই পেশী নিঃসন্দেহে অকার্যকর। মানুষের ক্ষেত্রে কেউ কেউ বিবর্তনীয় ধারাবাহিকতায় বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ হিসেবে তাদের কান যেকোন দিকে নাড়াতে পারেন। যেমন, বাংলাদেশের কৌতুক শিল্পী রবিউল কান নাড়াতে পারতেন। এ ছাড়া প্রাইমেটের একটি নতুন বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত হয়েছে আর সেটা হল আণুভূমিক তলে মাথা ঘোরানোর ক্ষমতা।এক কাঠামোর কাজ এভাবেই আরেক কাঠামোর কাছে হস্তান্তরিত হয়।
৫) চোখের নিক্টিটেটিং ঝিল্লি
চোখের ভেতরে এক কোণায় plicasemilunarisনামক একটি পেঁচানো কলা রয়েছে। এটা nictitating membrane বা “তৃতীয় নেত্রপল্লব” এর অবশিষ্টাংশ যা পাখি, সরিসৃপ ও মৎস্যের চোখে উপস্থিত রয়েছে।এই ঝিল্লি দৃষ্টিশক্তিকে অক্ষুন্ন রেখেই চোখকে রক্ষা করে ও আর্দ্র করে।এটা স্তন্যপায়ীদের মধ্যে খুবই দুর্লভ, প্রধানত মনোট্রিম এবং মারসুপিয়ালদের মধ্যে পাওয়া যায়। এর সাথে সংযুক্ত পেশিগুলোও অবশিষ্টাংশ। আফ্রিকান ও আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের plicasemilunarisঅন্যদের থেকে খানিকটা বড়। শুধুমাত্র CalabarAngwantibo প্রজাতির প্রাইমেটদের কার্যকরি নিক্টিটেটিং ঝিল্লি রয়েছে।
৬) পুরুষের স্তনবৃন্ত
স্তন এবং স্তনবৃন্ত মূলতঃ দরকার মেয়েদের। পুরুষদের এটা কোন কাজে আসে না। অথচ সকল পুরুষদের দেহে বিবর্তনের সাক্ষ্য হিসবে রয়ে গেছে স্তনবৃন্তের চিহ্ন।
৭) পুরুষদের ইউটেরাস
পুরুষদেহের অভ্যন্তরে সুপ্ত এবং অব্যবহার্য অবস্থায় স্ত্রী-জননতন্ত্রের অস্তিত্ব আছে।
৮) ঘ্রাণসংক্রান্ত
শিকারী প্রাণীদের হাত থেকে পালানো এবং খাদ্য অনুসন্ধানের জন্য ঘ্রাণশক্তি অনেক প্রাণীর কাছে প্রয়োজনীয় হলেও মানুষের জন্য তা তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ না, মানুষকে খুব কম সময়ই শিকারী প্রাণী নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছে এবং প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ কৃষিকাজের মাধ্যমে খাদ্য আহরণ করে এসেছে। ঘ্রাণের প্রতি সংবেদনশীলতা মানুষ থেকে মানুষে ভিন্ন হয়, যা সাধারণত অবশিষ্টাংশ বৈশিষ্ট্যগুলোর ক্ষেত্রে ঘটে। দক্ষিণ আমেরিকা, আমেরিকান ইন্ডিয়ান এবং আফ্রিকান মানুষদের ঘ্রাণশক্তি অনেক তীব্র, অনেকে অন্ধকারে গায়ের গন্ধ দিয়ে পরিচয় শনাক্ত করতে পারে। ঘ্রাণশক্তিকে অবশ্যই অবশিষ্টাংশ বলা যায় না কারণ এটি মানুষকে বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে, তবে এত উন্নত ঘ্রাণশক্তি আসলেই মানুষের দরকার নেই। এখানে লক্ষণীয় যে কোন বৈশিষ্ট্য উপকারী হওয়া সত্ত্বেও তা ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যেতে পারে যদি তার সাথে সংস্লিষ্ট জিনগুলোর উপর কোন নির্বাচনী চাপ কাজ না করে।
৯) ব্যবহার সংক্রান্ত : লোমকূপ ফুলে ওঠা কিংবা হিক্কা তোলা
মানুষের মধ্যে কিছু ভেসটিজিয়াল ব্যবহার এবং প্রতিবর্তী ক্রিয়া রয়েছে। শীতে বা ভয়ে আমাদের শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। তখন আমাদের দেহের লোমকূপ ফুলে ওঠে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের গায়ের কেশর, লোম বা পালক ফুলিয়ে বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করার উপায় খুঁজত। এই আলামত বিবর্তনের কারণেই আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে।
চাপের মধ্যে থাকলে মানুষের রোম খাড়া হয়ে যায়, যা আসলে একটা অবশিষ্টাংশ প্রতিবর্তী ক্রিয়া। মানুষের রোমশ পূর্বপুরুষ লোম খাড়া করলে তাদেরকে বিকটাকার ও ভয়ংকর দেখাত, এতে করে শিকারী প্রাণীরা সহজেই ভয় পেয়ে যেত। লোম খাড়া করে বাড়তি বায়ুর স্তর আটকে ফেলা যায়, এতে করে দেহকে গরম রাখা যায়। মানুষের শরীরে লোম যেহেতু অনেক কম, তাই ঠান্ডা লাগলে লোম খাড়া হয়ে যাওয়াটাকে অবশিষ্টাংশ বলা যায়।
Palmer grasp reflexকে মানবশিশুদের অবশিষ্টাংশ প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলা হয়। মানবশিশু হাতের কাছে যাই পায় তাই ব্যাপক শক্তির সাথে আকড়ে ধরে।১৯৩২ সালের একটি গবেষণা মতে ৩৭% শিশু রড থেকে ঝুলতে পারে, যে কাজটা একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সম্পন্ন করতে বেশ অনুশীলন করা লাগে। এসব শিশুরা কিন্তু তাদের মায়ের শরীর আঁকড়ে ধরতে ব্যর্থ হয়। এই আঁকড়ে ধরার প্রবনতাটা পায়ের মধ্যেও লক্ষিত হয়। শিশুরা যখন বসে থাকে, তাদের পরিগ্রাহী পা প্রাপ্তবয়স্ক শিম্পাঞ্জীদের মত ভেতর দিকে বেঁকানো অবস্থায় থাকে। প্রাচীন পূর্বপুরুষদের গায়ে আঁকড়ে ধরার মত যথেষ্ট লোম ছিল যার কারণে মা শিকারীদের হাত থেকে পালানোর সময় শিশুটি ঠিকই তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারত।
শুধু রোমকূপ ফুলে ওঠা কিংবা শিশুদের হাতের রিফ্লেক্সই নয়, বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন আমরা যে খাবার দ্রুত খেতে গিয়ে অনেক সময়ই হিক্কা তুলি সেটাও আসলে আমরা মৎস জাতীয় পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছি তার একটি উজ্জ্বল সাক্ষ্য। সেই ব্যাপারটিই স্পষ্ট করেছেন অধ্যাপক নীল সুবিন তার সায়েন্টিফিক আমেরিকানে লেখা ‘দিস ওল্ড বডি’ (জানুয়ারি, ২০০৯) নামের একটি প্রবন্ধে।
চিত্রঃ দ্রুত খেতে গিয়ে অনেক সময়ই হিক্কা তুলি সেটা আসলে মৎস জাতীয় পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
১০) বিলুপ্তপ্রায় বংশগতীয় ধারা
মানুষের মধ্যে এখনও অনেক অবশিষ্টাংশ আণবিক কাঠামো রয়েছে যা এখন অকার্যকর হলেও অন্য প্রজাতির সাথে সাধারণ উত্তরসূরিতা নির্দেশ করতে পারে। উদাহরণস্বরুপ, L-gulonolactone oxidase জিনটি বেশিরভাগ স্তন্যপায়ীদের মধ্যে কার্যকর, এটি একটি এনজাইম উৎপন্ন করে যা ভিটামিন সিকে সংশ্লেষ করে। মানুষ এবং অন্যসব প্রাইমেটদের মধ্যে একটি পরিব্যক্তি(mutation) এই জিনটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। জিনটার অবশিষ্টাংশ মানব জিনোমে “ছদ্মজিন” নামক এক বিলুপ্তপ্রায় বংশগতীয় ধারা (ভেসটিজিয়াল জেনেটিক সিকোয়েন্স) হিসেবে বিদ্যমান রয়ে গিয়েছে।
উপরে উল্লিখিত অঙ্গগুলোর বাইরেও মানব দেহে বহু বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের অস্তিত্ব রয়েছে। Robert Wiedersheim ১৮৯৩ সালে মানবদেহে ৮৬টি বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গ শনাক্ত করে The Structure of Man: an index to his past history শিরোনামের একটি বই প্রকাশ করেন। বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গগুলো বিবর্তনের পক্ষে অত্যন্ত জোরালো সাক্ষ্য।