মেট্রোরেলে প্রেম (পর্ব ৬)
মেট্রোরেলে প্রেম (পর্ব ৬)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)
——————————————– রমিত আজাদ
“উত্তেজনা প্রশমনের জন্য নারী হলেই চলে; তার বয়স-টয়স অত একটা ফ্যাক্টর না।” এরকম কথা নয়নকে বলেছিলো, তার এক মরোক্কান বন্ধু। অবশ্য বয়সে সে নয়নের চাইতে পাঁচ-সাত বছরের বড় হবে। তরুণ-টি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম-বিশ্বাসে মুসলমান হলেও, নিজস্ব বিশ্বাসে একজন কম্যুনিস্ট, মানে নাস্তিক। জার্মান ইহুদী দার্শনিক মার্কস-এর ধ্যান-ধারণার সমর্থক। কথাপ্রসঙ্গে একদিন সে নয়নকে বলছিলো। পুরুষ মানুষ মাঝেসাঝে উত্তেজিত হবে এটাই স্বাভাবিক। নারীরও উত্তেজনা আছে তবে সেটা ভিন্ন রকম। সাধারণতঃ স্পর্শ না করলে নারী উত্তেজিত হয় না। আর পুরুষের উত্তেজনা হতে পারে চোখের দেখায়ও। আর সেই উত্তেজনা প্রশমনের জন্য প্রয়োজন নারী। সেই রূপসী ষোড়ষী থেকে শুরু করে পঞ্চবিংশতি পর্যন্ত হলে ভালোই হয়। তবে তার বেশিও চলে। ত্রিশ বছর বয়সের নারী, নট ব্যাড! পয়ত্রিশ বছর হলেও কাজ চলে! নয়নের বয়স তখন ছিলো, বিশ বছরের মত; তাই পঁচিশ বছর বয়সের একটা মেয়েকে তার কাছে তুলনামূলকভাবে অনেক বয়স্ক মনে হতো। সেখানে পয়ত্রিশ তো বৃদ্ধাই বলা চলে! আনান-এর চয়েজ নিয়ে নয়নের সন্দেহ হয়েছিলো তখন! নয়ন ভাবলো ব্যাটা কি বলে এইসব! এই খোলামেলা দেশে এসে কি ওর মাথা খারাপ হলো নাকি? কথিত আছে যে, ‘এমন দেশে এলে সব মোল্লাই, গোল্লায় যায়!” নয়ন তাকে প্রশ্ন করলো, “এখানে তো কত রকম সুযোগই আছে! তা তোমাদের দেশে তো আর এই সুযোগ ছিলো না, তাই না?” আনান হেসে বলেছিলো, “কেন থাকবে না? সুযোগ সব দেশেই কম-বেশি রয়েছে!”
নয়ন: মরক্কোতে থাকতে কি তোমার এমন সুযোগ ছিলো? সেখানে নারীরা কি এত ফ্রী? সমাজ কি টাইট না?
সুদর্শন আনান, আরেক দফা লাজুক হেসে বললো, “শহরে আমাদের নিজেদের বাড়ী ছাড়াও, আরেকটি এ্যাপার্টমেন্ট ছিলো আমাদের। আর ঐ এ্যাপার্টমেন্ট-এর চাবিটা আমার কাছেই থাকতো। সুতরাং যখন প্রয়োজন পড়তো ও সুযোগ পাওয়া যেত, আমি ফ্লাটটি কাজে লাগাতাম। নয়ন বুঝলো যে, রাবাত শহরে ওর একটি ‘লিটনের ফ্লাট’ ছিলো! এবং রেখে-ঢেকে ঐ দেশেও এসব চলে। নয়ন শুনেছে যে, মরক্কোর জীবনযাত্রায় পাশ্চাত্যের ছাপ বেশী। আনান-এর হাসিটা দেখে নয়নের হ.ম. এরশাদের কথা মনে পড়লো। অবশ্য দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে তখনও আগমণ ঘটেনি বিল ক্লিনটন-এর।
এই দেশের প্রায় সব তরুণীই আবেদনময়ী পোশাক পড়ে! কেন? নয়ন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক কিছুই পেয়েছিলো। এবং এও জেনেছিলো যে, এটা অর্ধ শতাব্দী পূর্বেই ছিলো না। আস্তে ধীরে এই ফ্যাশন-রীতি পেনিট্রেট করে এখানকার সমাজে। এক রুশী বৃদ্ধা একবার নয়নকে বলেছিলো যে, তার ছেলেবেলায় যদি কোন তরুণী অশালীন পোশাকে বাইরে বেরুতো, তাহলে তার পায়ে বেতের বারি মারা হতো! এতটাই রক্ষণশীল যদি থেকে থাকে সেই সমাজ, তাহলে এই রীতি চালু হলো কবে থেকে ও কিভাবে? মূলতঃ ষাটের দশকের পরই অনেকটা জোয়ারের মতই ঢল নামে স্বল্প ও আবেদনময়ী পোশাক পরিধানের। এর পিছনে বিশ্ব-মোড়ল বা ষড়যন্ত্রকারীদের খেল বা মহাপরিকল্পনা আছে বলে শোনা যায়। তারা শুরুটা করেছিলো পর্দার কাহিনী মানে সিনেমা-নাটক দিয়ে। মার্কিন মুলুকের টিভি পর্দায় একটি সায়েন্স ফিকশন সিরিয়াল চালু করা হয় যেখানে প্রথমবারের মত দেখানো হয়েছিলো স্বল্পবসনা অর্ধউলঙ্গ তরুণীদেরকে। প্রথমে এই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও, আস্তে ধীরে চোখ সওয়া হতে শুরু করে। তারপর কিছু মার্কা মারা (তাদের ভাষায় ‘বোল্ড’) অভিনেত্রীদেরকে দিয়ে হলিউড ম্যুভিগুলোতে ক্রমাগত দেখানো হতে শুরু করে এই নগ্নতা-অর্ধনগ্নতা। তারপর একসময় বাস্তবের রাজপথ-বিপণীতেও চলে আসে এই ফ্যাশন!
দক্ষিণ-আমেরিকার দেশগুলোতেও ঐ একই চিত্র ছিলো বলে তাকে জানিয়েছিলো, লাতিন-আমেরিকান বন্ধু-বান্ধব। এবং সেখানে যে পরিস্থিতি দিনদিন ডিটেরিওরেট করছে সেটাও বলেছিলো তারা।
নয়নের মনে পড়ে বাংলাদেশী ওল্ড সিনেমাগুলোতে কোন অশালীন দৃশ্যই থাকতো না। খুব বেশী হলে যা দেখানো হতো তা হলো আটসাঁট বাঁধনে শাড়ী পড়া নায়িকা, অনেক ক্ষেত্রে সাইড-নায়িকাদেরকে দিয়ে এটা করানো হতো। দুই একটি সিনেমায় তাদেরকে জলে ভেজানো হতো, তাও কালো রঙের শাড়ীতে। এইটুকু দৃশ্য দেখার জন্য হলে হুমড়ী খেয়ে পড়তো তরুণরা। কিন্তু একসময় প্রযুক্তির প্রয়োজনে বৈধতা দেয়া হয় ভিসিআর-প্রযুক্তিকে। শুরুতে তাতে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ হলেও, সেই আইন আর ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। বোম্বাইয়া পোষাকী ছবি বানের পানির মত ঢুকতে থাকে ঢাকা সহ সারা দেশে। এই প্রথম রক্ষণশীল বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পেলো অর্ধনগ্ন উপমহাদেশীয় শ্যামাঙ্গিনী নায়িকাদেরকে। যা ছিলো তাদের জন্য নগ্ন শ্বেতাঙ্গিনীদের চাইতেও বেশি আবেদনময়ী। বিশেষত বোম্বাইয়া ছবির নাচের দৃশ্যগুলিতে বাণিজ্যিক প্রয়োজনেই উত্তেজক দৃশ্য দেখানো হতো। শুরুতে এই নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও এক সময় সেটাও চোখ সওয়া হয়ে যায়। যেসব দৃশ্য একসময় পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখা যেত না। যেসব দৃশ্যও পারিবারিক পরিবেশে দেখা শুরু হয়!
পুরুষ আর নারীর যৌন উত্তেজনা কি একইরকম? এই প্রশ্নের উত্তরে নয়নের এক সহপাঠিনী নয়নকে বলেছিলো, “নারীর কাছে উত্তেজনার চাইতে রোমান্টিকতার প্রায়োরিটিই বেশী। সে আসলে এমন একজন পার্টনার খোঁজে যার কাছ থেকে সে অপরিসীম আদর-সোহাগ পাবে। প্রয়োজনে সেখানে মিলন-এর বিষয়টিও আসে, তবে সেটা একজন নারীর কাছে মূখ্য নয় গৌণ। বোঝাবুঝি, ভালোবাসাবাসি যদি হয়েই যায়, তাহলে অনেকটা কর্তব্য হিসাবেই প্রেমিকের সাথে দৈহিক মিলনে রাজী হয়ে নিজেকে আত্মসমর্পন করে নারী।”
জীবনে প্রথম মেট্রো দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো নয়ন। এই আধুনিক যুগে মানবজাতির যে কয়টি এ্যাচিভমেন্ট রয়েছে, তার মধ্যে মেট্রো একটি বলে তার কাছে মনে হয়েছে। কয়েক মিনিট পরপরই ট্রেন আসছে। ঝটপট মানুষ উঠছে, নামছে। মস্কোর ট্রেনে কোন নাম্বারের ঝামেলা নাই। ঐ লাইনের সব ট্রেন একই দিকে যাচ্ছে। মেট্রো-ম্যাপে লাইন গুলি বিভিন্ন রঙে দেখানো হচ্ছে। কারোর ট্রেন মিস করার ভয় নাই, একটার পর একটা ট্রেন চলে আসছে। পরিসংখ্যান জ্ঞান প্রয়োগ করে হিসাব করাই আছে যে, কোন লাইনে কোন সময়ে কতগুলি ট্রেন দিতে হবে। তাই ট্রেন সংখ্যার অপ্রতুলতা বা যাত্রী সংকট কোনটাই নাই। তবে পিক আওয়ারে ট্রেনের ভিতরে যাত্রী-ঘনত্ব বেশি হয়, অনেক সময় গাদাগাদিও হয়! এই নিয়ে পরে লেখা যাবে। তবে শহরের ব্যস্ততা মনে হয় মেট্রোরেলে এলেই বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
এখানে অনেক স্টেশনই দোতলা, তিনতলা। উপরে ও নিচে ট্রেন লাইন আছে। প্রত্যেকটা স্টেশন ঝকঝকে। প্রতিটি স্টেশনে রয়েছে আর্ট ও বিজ্ঞানের অপূর্ব সমন্বয়! কত কত শিল্পী ও বৈজ্ঞানিকদের মেধা যে এখানে সমন্বিত, কারুকার্যময় ও অত্যাধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
এইদেশের আরেকটি বৈশিস্ট্য হলো মেট্রোতে বই পড়া। ইয়াংদের মধ্যে এই প্রবণতা কিছুটা কম, তবে মাঝ বয়স থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত বেশিরভাগই মেট্রোরেলে বসে নিশ্চিন্ত মনে বই পড়ছেন। শিশু-কিশোররাও বসে বসে কমিক পড়ে আর হাসে।
দিনের কিছু সময় ও রাতে মেট্রোট্রেনগুলোতে যাত্রীর ঘনত্ব থাকে হালকা। তবে সকালে মানে পিক আওয়ারে, মানে যখন নগরীর সবাই একযোগে যাচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিসে, ব্যবসায়, ইত্যাদি; অথবা কর্মস্থল থেকে যখন ফিরে আসছে সবাই; তখন মেট্রোতে যাত্রীর ঘনত্ব থাকে অনেক অনেক বেশী। কখনো কখনো একেবারে গাদাগাদি-ই হয়ে যায়। সো-কলড সমঅধিকারের এই দেশটিতে, নারী-পুরুষ মিলেমিশে ওঠে মেট্রোতে, এখানে নারীদের জন্য পৃথক কোন বগি বা সীট নাই। তাই ঐ পিক আওয়ারে নারী-পুরুষ দেহগুলিও গাদাগাদি হয়ে যায়! সে সময়ে কি কিছু ঘটে? কেউ কি সুযোগ নেয়? কেউ কি সুযোগ দেয়? গ্রোপিং (groping) কি? কোন কাপল কি এই সুযোগেই কিছু করে? কেউ কি এখানেই তার পছন্দের ব্যাক্তিটিকে প্রথম শারিরীক নিবেদন করে (নারী ও পুরুষ উভয়েই)? এই নিয়ে আলোচনা হবে। তবে আপাতত: সত্যি ঘটনা অবলম্বনে একটা কৌতুক শোনা যাক:
পিক আওয়ারে মেট্রোতে চড়েছে নির্মলা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরছে ডরমিটরিতে। আজ যাত্রী ঘনত্ব আরো বেশী মনে হল. যাত্রীদের গাদাগাদি এতই বেশি যে নড়াচড়া করাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে! নির্মলা দাঁড়িয়েছিলো দরজা থেকে একটু দূরে। এর মধ্যে গন্তব্য স্টেশন এসে গেলো নির্মলার। সে তার সামনে, একেবারে মুখোমুখী দাঁড়ানো তরুণীটিকে বললো, “আমাকে একটু পথ দিন, আমি এই স্টেশনে নেমে যাবো। মেয়েটি অসহায় সুরে বললো, “না, বোন আমি সড়তে পারবো না, নড়তৈ পারছি না, আমি আপনাকে পথ দিতে পারবো না। আমার পিছনটাতে কিছু একটা ঘটছে!” এমন সহসা ও দ্রুত হলো কথাগুলো যে, নির্মলা থ মেরে গেলো! সে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিলো না।
হয়তো ভীড়ের চাপে মেয়েটি নড়তে পারছিলো না। তার পিছন দিকে যে ক্রাউড মেট্রো থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলো তাদের সম্মিলিত ধাক্কায় হয়তো সে চাপে পড়ে গিয়েছিলো! তাই নড়াচড়া করতে, বা কাউকে পথ দিতে অসুবিধা হচ্ছিলো। কিন্তু মেয়েটির সেই কথাগুলো বলার ঢংয়ে একটা ভিন্ন মিনিং তৈরী হলো! একেবারে রসালো কৌতুকের মত! নির্মলা বহুদিন এই কথা মনে করে হেসেছে!
মেট্রোর ভীড় ঠেলে নির্মলা ঢুকলো,
আজ লোক খুব বেশী নির্মলা বুঝলো।
যাত্রীরা এত বেশী গাদাগাদি বগিতে,
অবিচল তারা সব ট্রেনটির গতিতে।
পড়ে যাবে সেই ঝুঁকি নেই আজ ঝাঁকিতে;
চলছিলো নির্মলা আনমনা আঁখিতে।
হঠাৎ কি পরশন টের পেলো চকিতে,
অনুভূতি কোন এক বোধ হলো কটিতে!
তরুণের হাত, নাকি বাহু কোন তরুণীর?
নাকি কোন অশরীরী নির্বাক ধরণীর?
হতে পারে চেনা কেউ, ছুঁয়ে দিয়ে নিশ্চুপ।
যেই হোক, কটিদেশে অনুভূতি অদ্ভুত!
——————————– রমিত আজাদ
(চলবে)
রচনাতারিখ: ২৫শে অক্টোবর, ২০২১ সাল
রচনাসময়: রাত ১২টা ২০মিনিট
Love in Metrorail (6)
——————- Ramit Azad
আগের পর্বগুলি
https://www.facebook.com/ramit.azad/posts/10225400017443828