
শিক্ষক বিষয়ক
শিক্ষক বিষয়ক
———— ড. রমিত আজাদ
সত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দী দিচ্ছেন। পাঁচশত জন বিচারক তাঁর জবানবন্দী শুনছেন। আরো আছেন দর্শকেরা। তাদের সংখ্যাও কম নয়। সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ ঐ বৃদ্ধের দিকে। বৃদ্ধের প্রতি অভিযোগ – তিনি দেশের যুবসমাজকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন, আরো গুরুতর অভিযোগ – তিনি প্রচলিত বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। ঐ বৃদ্ধ মূলতঃ একজন শিক্ষক। পাঁচশতজন বিচারকদের মধ্যে অনেকে তাঁর ছাত্র, দর্শক সারিতে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের অনেকেও তাঁর ছাত্র। শাসকদের কেউই সেই বিচারের আদালতে উপস্থিত হননি, তারা পর্দার অন্তরালে অঙ্গুলী হেলন করেন। সেই শাসকদের অনেকেও তাঁর ছাত্র। বার্ধক্যগ্রস্ত কিন্তু দৃপ্ত কন্ঠে বৃদ্ধ তাঁর জবানবন্দী দেয়া শুরু করলেন এইভাবে, “হে এথেন্সবাসীগণ (বিচারের জুরিগণ) আমার অভিযোগকারীদের দ্বারা আপনারা কতটুকু প্ররোচিত হয়েছেন আমি জানিনা। কিন্তু তাদের কথা এতো বেশী প্ররোচনামূলক ছিলো যে, তারা আমাকে প্রায় ভুলে যেতেই বাধ্য করেছে যে, আমি কে। উপরন্তু তারা খুব কমই সত্য বলেছে। কিন্তু তাদের বলা অনেক মিথ্যা কথার মধ্যে একটি আমাকে বেশ বিস্মিত করেছে যা ছিল — আপনারা বিচারকরা যেন যথেষ্ট শক্ত থাকেন এবং আমার বাগ্মিতার প্রভাবে বিহ্বল হয়ে না পড়েন। এই কথা বলে তারা নিজেদেরকে নির্লজ্জ্বই প্রমান করলো, এবং আরো বোঝালো যে, সক্রেটিস মুখ খুললেই প্রমানিত হয় যে তিনি একজন মহান বক্তা। বাগ্মিতার জোর বলতে তারা যদি সত্যের জোরকেই বুঝিয়ে থাকে, তাহলে আমি বলবো যে, আমি বাগ্মি। তবে তাদের মতো করে নয়। যাহোক, আমি যেমনটি বলেছিলাম যে, তারা একফোটাও সত্য কথা বলেনা। বরং আমার কাছ থেকে আপনারা যা শুনবেন তা সবই সত্য: তবে আমি তাদের মতো নানান শব্দ আর প্রবাদে অলংকৃত করে ভাষণ দিতে পারবো না। আমি শপথ করে বলছি, আমি খুব সহজ ভাষায় এই মুহূর্তে আমার মনে যা আসে তাই ব্যবহার করেই ভাষণ দেব। যেহেতু আমি আমার কার্যের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে নিঃসংশয়।” হ্যাঁ, এই অকুতোভয় দৃঢ়চিত্ত বৃদ্ধের নাম ‘সক্রেটিস’। যিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। মানুষকে সুশিক্ষা দেয়ার অপরাধে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুদন্ড হয়েছিলো।
আমাদের দেশে ইদানিং শিক্ষক প্রসঙ্গে যেসব আলোচনা-সমালোচনা চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে এই লেখাটি লিখতে হচ্ছে। আর লেখার ভূমিকায় আমাকে স্মরণ করতে হলো প্রাচীনকালের এক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও তাঁর করুণ পরিনতিকে।
সব সম্প্রদায়, পেশা, শ্রেণী ও রাজনৈতিক দলে ভালো ও মন্দ থাকে। শিক্ষকদের মধ্যেও যে ভালো ও মন্দ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি একক একটি মানুষের ভিতরেও ভালো ও মন্দ থাকে। জগতে চলছেই তো এভিল আর গুড-এর খেলা।
আমাদের দেশে শিক্ষক কথাটিকে বেশীরভাগ সময় জেনারালাইজ করে ফেলা হয়। শিক্ষক নানান ক্যাটাগরির হয় – কিন্ডার গার্টেন স্কুলের শিক্ষক, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, সেকেন্ডারী স্কুলের শিক্ষক, কলেজের শিক্ষক, মাদ্রাসার শিক্ষক, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক, ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আরো অনেক রকম। এদের মধ্যে কিছু কমোন বিষয় অবশ্যই আছে তবে কাজের ধরন, দায়-দায়িত্ব ইত্যাদি বিচারে পার্থক্যও ব্যাপক। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, আমি নিশ্চিত জানি যে কিন্ডার-গার্টেন স্কুলে আমি পড়াতে পারবো না। অতটুকু টুকু ছোট শিশুদের পড়ানোর জন্য যত ধৈর্য্য ও যেসব গুনাগুন থাকা প্রয়োজন আমার সেটা নাই। আবার একজন ক্যাডেট কলেজের শিক্ষককে শুধু ক্লাস নিলেই হয়না, ছাত্রদের সকালে ঘুম ভাঙানো থেকে শুরু করে, ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত অনেক দায়িত্বই পালন করতে হয়।
কোন কোন রাজনৈতিক রথী-মহারথীর বক্তব্য শুনলে তো স্পষ্টই বোঝা যায় যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে আদৌ জ্ঞান রাখেন না। রাখবেনই বা কি করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠওতো মারাতে পারেনি! কেউ কেউ সেই চৌকাঠে পা দিলেও শেষ করার মুরোদ হয়নি। তাই তারা অধ্যাপক বলতে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক মনে করে।
কয়েক বছর আগে আমি শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামোর উপর একটা লেখা দিয়েছিলাম। http://www.somewhereinblog.net/blog/ramit/29651636
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর এরকম একটা আশ্বাস দিয়েছিলো, পরে কি হলো?
আমার একজন প্রিয় শিক্ষক অবসর নেয়ার কয়েকদিন আগে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই বিষয়ে আমার একটি লেখা আছে
http://www.somewhereinblog.net/blog/ramit/29505388
‘অভিমান করে চলে গেলেন দেলোয়ার হোসেন স্যার’
আমি এই সমাজে বিভিন্ন সময়ে শোনা শিক্ষকদের সম্বন্ধে কয়েকটি মন্তব্যে তুলে ধরছি –
‘শিক্ষকরা আবার কঠিন কি কাজ করে? একই পড়া বারবার পড়ায়, তার জন্য তাকে আবার কত টাকা দিতে হবে?” – একজন মাস্টার ডিগ্রী হোল্ডার গৃহিনী।
‘শিক্ষকদের এত টাকা-পয়সার দরকার কি? উনাদের লোভ-লালসাই তো সমাজটাকে শেষ করে দিলো’ – একজন পদস্থ আমলা।
‘কোন ভালো চাকরী না পেয়ে এই স্কুল মাস্টারীর চাকরীটা নিয়েছিলাম। আমি নিজেই বা কি জানি? আর তোদেরই বা কি পড়াবো?’ – একজন স্কুল শিক্ষক।
‘শিক্ষকরা ব্যাচে ব্যাচে পড়িয়ে কোটি-কোটি টাকা কামাই করে ফেলে!’ – একজন উচ্চশিক্ষিত চাকুরীজীবি।
‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তো পকেট ভরা টাকা। যে পরিমান টিউশন ফী নেয়!’ – একজন আমলা (তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘আপনি কি জানেন ঐ টিউশন ফী-র কত পারসেন্ট টিচাররা পায়?’ ‘উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘না জানিনা’;) না জেনে মন্তব্য করাটাও আমাদের স্বভাবজাত।
‘ইউনিভার্সিটির টিচারদের কি ক্লাস নেয়া ছাড়া আর কোন কাজ আছে? সেটাও তো ঠিকমতো করেনা’ – এস. এস. সি. পাশও নন এমন একজন গৃহিনী। (তাকে বলা হয়েছিলো যে, ‘ইউনিভার্সিটির টিচারদের একটা মেজর কাজ রিসার্চ’, উত্তরে গৃহিনী বলেছিলো ‘সেটা আবার কি? দরকার আছে কোন?’ )
(টেলিফোনে) শিক্ষকের স্ত্রী: তোমার তো ক্লাস নেয়া শেষ, এখনো কি করো ইউনিভার্সিটিতে, তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো।
শিক্ষক: তোমার কি ধারণা, ক্লাস নেয়া ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ নেই?
শিক্ষকের স্ত্রী: আর কি কাজ থাকতে পারে? চলে আসো তাড়াতাড়ি।
জন ১: শিক্ষদের প্রাইভেট পড়ানোটা এত চোখে পড়ে! ডাক্তাররা যে একটা প্রেসক্রিপশন লিখে এতগুলো টাকা ভিজিট নেন, প্রতি দশ মিনিট অন্তর অন্তর রুগী দেখে দিনে এতগুলো টাকা কামাচ্ছেন, সেগুলো চোখে পড়ে না?
জন ২: ভাই ঐ একটা প্রেসক্রিপশন লিখতে তাকে অনেকগুলো বছর পড়ালেখা করতে হয়েছে।
জন ১: শিক্ষকদের কি পড়ালেখার পিছনে অনেকগুলো বছর ব্যায় করতে হয়নি?
জন ২: ভাই, প্রেসক্রিপশন লিখতে যোগ্যতা লাগে।
জন ১: অংক কষতে যোগ্যতা লাগেনা?
জন ২: (আমতা আমতা করে) না, মানে, যা এতকাল হয়ে আসছে আরকি। ডাক্তাররা তো অনেক টাকা নেবেই।
জন ১: সরকারী ইউনিভার্সিটিতেও পড়াবে, আবার প্রাইভেটে গিয়েও ক্লাস নেবে। বড়ই মজায় আছে তারা।
জন ২: ভাই, প্রাইভেটে ক্লাস নিয়ে উনি কি কোন খারাপ কাজ করেন?
জন ১: ক্যান, ক্লাস নেবে ক্যান?
জন ২: প্রশ্ন করছি, ক্লাস নেয়াটা কি খারাপ? উনি তো চুরি-ডাকাতি করেন না। একদল মানুষকে জ্ঞানের আলো বিতরণ করছেন। এতে কি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? এটা কি খারাপ?
জন ১: এতো এতো টাকা কামিয়ে ফেলছে!
জন ২: কত টাকা কামায় একটা ক্লাস করে?
জন ১: জানিনা, তবে কম না নিশ্চয়ই।
জন ২: তারা কি ক্লাস নিয়ে টাকার পাহাড় করে ফেলছে? চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন তো। এই যে এত এত অট্টালিকা-বাগান বাড়ী এইগুলোর মালিক কি শিক্ষকরা?
‘সেই সময় সিএসপি অফিসারের চাকরী পেয়েছিলাম। ঘুষের চাকরী করবো না বলে, শিক্ষকের চাকরীটা প্রেফার করলাম। এখন তো মনে হচ্ছে ভুল করলাম।’ – একজন ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক।
একজন অধ্যাপকের প্রতি একজন অ-অধ্যাপক, ‘এত জাহির করলে অসহ্য লাগে!’
‘না জেনে কথা বলবেন না তো।’ – অধ্যাপকের প্রতি একজন প্রাক্তন সচিব।
‘এইসব প্রফেসররা পি.এইচ.ডি. করা ছাড়া আর কি করছে? কি জানে তারা?’ – বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী
‘না না প্রফেসর বিয়ে করবো না, প্রফেসরের কি টাকা আছে? তার চাইতে আমলা বিয়ে করা ভালো, তাদের অনেক উপরি আয় আছে, ঐটাইতো আমার দরকার।’ – একজন বিবাহযোগ্যা তরুণী।
‘বাবা তুমি বিজনেসম্যান না হয়ে টিচার হলে কেন? এই জন্যই তো আমরা এতো গরীব’ – একজন শিশু
অনেকেই মনে করে শিক্ষকদের কাজ খুবই সহজ, ক্লাসরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করলেই হলো। আসলেই কি তাই? এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি —
আমার এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম ক্লাস নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। উনার এ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার ভালো। নিয়ে গেলাম ডিপার্টমেন্ট-এর চেয়ারম্যানের কাছে। আমার বন্ধুর ক্যারিয়ার ও স্মার্টনেস দেখে তাকে পছন্দ হলো চেয়ারম্যান স্যারের। বললেন, “আপনাকে সিলেবাস দিচ্ছি, আপনি লেকচার নোট তৈরী করে আমার কাছে নিয়ে আসেন, ক্লাস দিয়ে দেব।” খুশী হলেন আমার বন্ধু, শিক্ষক হিসাবে একটা পরিচয় তৈরী করতে পারবেন তাই। এর দু’দিন পর আমাকে ফোন দিলেন বন্ধু, “শোন, স্যার তো আমাকে লেকচার নোট তৈরী করতে বললেন।”
আমি: তাতো বলবেনই। ক্লাস নিতে হলে লেকচার নোট রেডী থাকতে হবে না?
বন্ধু: ও আচ্ছা।
তার দু’দিন পর আবারো আমাকে ফোন দিলেন বন্ধু –
বন্ধু: শোন, স্যার তো আমাকে লেকচার নোট তৈরী করতে বললেন।
আমি: অবশ্যই, লেকচার নোট ছাড়া পড়াবে কি করে?
বন্ধু: এ তো অনেক কাজ!
আমি: হ্যাঁ, অনেকই তো।
বন্ধু: কাজতো অনেক! হিউজ!
আমি: হ্যাঁ, অবশ্যই। কাজ তো অনেকই। তুমি কি শিক্ষকের কাজ কম ভেবেছিলে?
বন্ধু: না, মানে আমি তো ভেবেছিলাম ……………..।
আমি: তুমি লেকচার নোট তৈরী করে স্যারকে দাও, উনি তোমাকে ক্লাস দিয়ে দেবেন।
বন্ধু: আচ্ছা, দেখি।
এরপর আমার ঐ বন্ধু আর কোনদিন, ক্লাস নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।
আমি ক্লাসরুমে কয়েকবার জরীপ করে দেখেছিলাম, একজন অধ্যাপকের কাছ থেকে বত্রিশটা গুনাগুন ছাত্ররা আশা করে থাকে। যেমন – জ্ঞান, মেধা, সততা, কর্তব্যপরায়নতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, সময়ানুবর্তিতা, বিনয়, বোঝানোর অদ্ভুত গুন, সুবক্তা, সুবেশ, স্মার্ট, স্নেহশীলতা, বাংলা-ইংরেজী দুটি ভাষায় সমান দক্ষতা পারলে আরো ভাষা জানা, সব বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান রাখা, ভালো রিসার্চার হওয়া, লেখালেখিতে দক্ষ হওয়া, এমন আরো অনেক কিছু। প্রশ্ন করেছিলাম, “আর কোন পেশায় কি এতো গুনাগুন আশা করা হয়?” উত্তরে তারা সমস্বরে বলেছিলো, “না না, কি দরকার?”
বেশীটাকার কথা যদি বলেন, আমি অনেক শিক্ষককেই জানি যারা সরকারী আমলার চাকুরী সহ অনেক বেশীটাকার চাকুরী পেয়েও সেটা না করে অথবা ছেড়ে শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেছেন। আমি নিজেও বিদেশে কয়েকগুন বেশীটাকা বেতনে চাকুরী করতাম।
শিক্ষকদের কাছ থেকে বরাবরই স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে এসেছি, সে দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক। আমার প্রাইমারী স্কুলে এক শিক্ষিকা ছিলেন, রাগী বলে উনার খ্যাতি ছিলো, সবাই উনাকে জমের মত ভয় পেতাম। কয়েক বছর পরের কথা, প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। হঠাৎ একদিন রাস্তায় শিক্ষিকা আপার সাথে দেখা। মায়ের মত আমাকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “এত বড় হয়ে গেছিস তুই!” বিদেশে যখন লেখাপড়া করছি তখনকার একটা ঘটনা বলি, শীতের দেশে সামার খুব সুন্দর হয়, তাই সামার টাইমটায় আমি যানবাহন কম ব্যবহার করে হাটাহাটি বেশী করতাম। একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে হেটে হেটে ডরমিটরিতে যাচ্ছি। কিলোমিটার দুয়েক হাটার পর, হঠাৎ পিছনে কার যেন ডাক শুনতে পেলাম। আমার নাম ধরে বিশুদ্ধ ডাক। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে গেলাম, ‘কে ডাকে আমাকে? নজরুল ইসলাম স্যার? নাকি আবুল আশরাফ নূর স্যার? এই বিদেশ বিঁভুয়ে উনারা আসবেন কোত্থেকে?’ পিছনে তাকিয়ে দেখি পাপোভ স্যার। আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। নামজাদা বিজ্ঞানী। অবাক হলাম স্যার আমার নাম জানেন! আর ডাকটাও অবিকল আমার বাংলাদেশের শিক্ষকদের ডাকের মত! পরে বুঝলাম, দেশ-বিদেশ বলে কথা নয়, পৃথিবীর সব দেশের শিক্ষকদের ডাকটা একই রকম স্নেহার্দ্র। পাপোভ স্যার সেদিন একটি বাস স্ট্যান্ডে আমাকে পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। জ্ঞানী মানুষ তিনি, উনাকে আমি আর কি বলবো! উনার কথা মনযোগ দিয়ে শুনে কিছু শেখার চেষ্টা করলাম।
শিক্ষকদের সম্মান বিষয়ে বলি। আমরা ছাত্রদের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পাই, সম্মানও পাই। কিন্তু সমাজে সব সময়ই কি তাই? একবার আমাকে একজন মফস্বলের কলেজ শিক্ষক বলেছিলেন, “ভাই, আমরাও তো বিসিএস দিয়ে কলেজের শিক্ষক হয়েছি, কিন্তু আমাদের প্রতি আচরণ ভালো নয়। পান্ডারা আমাদেরকে আঙুল উঁচিয়ে বলে যে, তাদের ছেলেপেলেদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, তা নইলে ফল ভালো হবেনা। ভাই, অনেক সময় ঘুষামুষা দিয়া বয়! আবার প্রশাসনের কাউকে দেখলে কথা কয় না, ডরায়।”/ আমার প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন শ্রদ্ধেয় বাকিয়াতুল্লাহ স্যার। এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক দেশের অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষকে গড়েছেন। অথচ স্বৈরাচারী এরশাদ ব্যক্তিগত আক্রোশে তাঁকে চাকুরীচ্যুত করেছিলেন।
শিক্ষকদের রাজনীতি করা নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করে, বেশীরভাগই এটার বিপক্ষে। কেন? রাজনীতি কি খারাপ কিছু? রাজনীতি যদি খারাপই হয়, তাহলে রাজনীতিবিদরা তো সবাই খারাপ কাজ করছে! শিক্ষকরা রাজনীতি করেছিলেন বলেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়েছিলো, ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো, মহান মুক্তিযুদ্ধেও শিক্ষক রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। খান আতা পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নামে একটি সিনেমা রয়েছে, সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের উদ্ধুদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। সাহিত্য-চলচ্চিত্র ইত্যাদি জীবনের দর্পন। অনেকে বলেন স্বাধীন দেশে আর শিক্ষক রাজনীতির প্রয়োজন নাই। তাই কি? স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষকদের ভূমিকার কথা উল্লেখযোগ্য। রাজনীতি না করলে দেশ এগুবে কি করে? তবে দাবী হয়তো, সুস্থ রাজনীতির। সে দাবী তো সমাজের সবার কাছেই।
অনেকে বলে, ‘জাতির মাথা শিক্ষকরা’। তাই তো হওয়া উচিৎ, কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এটা কতটুকু সত্যা? আমাদের সমাজে কি থিংক ট্যাংক আছে? দেশে পলিসি মেকার কারা? শিক্ষকরা না আমলারা? না কি রাজনীতিবিদরা?
এই জমানার শিক্ষদের মেধা-মান ইত্যাদি নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আমিও প্রশ্ন করবো, “যে সমাজ শিক্ষকদের যথাযথ মান-মর্যাদা (অর্থনৈতিক ও সামাজিক) দিতে জানেনা, সেই সমাজে মেধাবীদের এই পেশা বেছে নেয়ার আগ্রহ কতটুকু হতে পারে?”
কয়েকদিন আগে ঢাকার একটি ভবনে একটি সায়েন্স কনফারেন্স হচ্ছিলো। অনেক নবীন ও প্রবীন বিজ্ঞানীরা সেখানে তাদের পেপার প্রেজেন্ট করেছিলো। কনফারেন্স-এর মাঝখানে ব্রেক টাইমে আমি তিনতলা থেকে নীচে নেমে এলাম। সেখানে দেখি প্রচুর পরিমানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। ভবনের বাইরে নেমে দেখি সারি সারি টিভি ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে। জানতে চাইলাম, কি বিষয়? একজন বললেন যে, সামনে ইলেকশন তাই নির্বাচন কমিশন ও আমলাদের একটা মিটিং হচ্ছে। তাই এতো আয়োজন। জাতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভালো নিউজ কাভারেজ হবে এটাই স্বাভাবিক। আমার প্রশ্ন হলো, একটা সায়েন্স কনফারেন্স কি জাতির জন্য অগুরুত্বপূর্ণ? সেখানে তো একটা টিভি ক্যামেরাও দেখলাম না!
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমার জীবনে আমার অভিভাবকের পরপরই যারা সবচাইতে বেশী অবদান রেখেছেন তারা হলেন আমার শিক্ষকরা। তাদের অনেকে আছেন দেশে, অনেকে আছেন বিদেশে। অনেকে আবার এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন। যারা আজ আর এই পৃথিবীতে নেই, তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আর যারা বেঁচে আছেন তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম। তাঁদের দীর্ঘ জীবন কামনা করি, যেন তাঁরা আরো বহুকাল জ্ঞানের আলো বিতরণ করে যেতে পারেন।
(ইতোঃপূর্বে প্রকাশিত)
chotobelay amar baba amake shikhiesilo kivabe likhtehoy portehoy monervab prokash korte hoy. jatir pita jodi hoy tahole akjon adorsho shikkhok ke e jatir pita bola uchit. oshadharon likha. thank you sir.
Thank you also.
Nice presentation. you have criticized severely in some points. I must say our teachers are the backbone of our nation but they also have to be passionate to their profession. It is high time govt. took step to the development of our teachers. thank u.
Right