
সিজার ও ব্রুটাস
সিজার ও ব্রুটাস
—- রমিত আজাদ
জুলিয়াস সিজার নামটি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে না কখনো। সিজার যখন যুবা, প্রবল প্রতাপশালী রোম তখন নিজেকে প্রজাতন্ত্র বলে দাবী করে। দেশ চালায় আইনসভার সিনেটরেরা। তারপরেও ব্যাপক অরাজকতা! স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাসদের বিদ্রোহ রোমের ঐদ্ধত্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। এইসব রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে সেনাপতি সিজার রোমে প্রবেশ করে গল, মিশর, ফার্নাসেস ও জুবা লুন্ঠন শেষে। রোমানরা জানতো যে, লুন্ঠনের চাইতে লাভজনক আর কিছু নাই, ইতিপূর্বে তাদের এই পথ দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো ইউরোপের আরেক লুটেরা ‘আলেকজান্ডার’। যদিও প্রাচীন বাংলা ‘গঙ্গাৃঋদ্ধি’-র সৈন্যদের কাছে মার খেয়ে লুটেরা আলেকজান্ডার আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি! তদুপরি গ্রীসের দরবারী ইতিহাসে আলেকজান্ডার-কে হিরো হিসাবেই দেখানো হয়েছে। যাহোক, সিজারের লুন্ঠনের অর্থ-সম্পদ কাজে লাগানো হবে রোমের বিলাসিতায়, এই কারণে রোমানরা সিজারকেও বিজয়ীর মর্যাদা দিয়ে কাউন্সিলারের পদে বসিয়েছিলো। কিন্তু কয়েকমাস পরেই অভিযোগ শুরু হলো, সিজার সিনেট-কে গুরুত্ব দিচ্ছেনা, তার খেয়াল-খুশী মতো দেশ চালাচ্ছে। ক্ষিপ্ত সিনেটররা প্রকাশ করলো যে সিজারের কার্যকলাপ ভালো নয়, এতে রোমের চেতনা ভুলুন্ঠিত হবে, রোম প্রজাতান্ত্রিক রূপ বদলে সাম্রাজ্যে পরিণত হতে পারে। তবে সিজার কারো কথায়ই কর্ণপাত করছিলো না। একসময় একদল অসন্তষ্ট সিনেটর ষড়যন্ত্র করলো সিজারকে হত্যা করার। একে একে অনেকেই ঐ দলে ভিড়লো, তবে একজনকে তারা কিছুতেই কনভিন্স করতে পারছিলো না, নাম তার ‘ব্রুটাস’। কে এই ব্রুটাস? পিতা জুনিয়াস ও মাতা সার্ভেলিয়ার সন্তান ব্রুটাস। ছেলেবেলা থেকেই ব্রুটাস ছিলেন জ্ঞানানুরাগী। ছিলেন জুলিয়াস সিজারের কন্যা জুলিয়ার সমবয়সী প্রায়, এবং সিজারের পিতৃতুল্য স্নেহে বড় হয়েছিলেন জুলিয়ার সাথেই। তবে ‘সিজার’ ‘পম্পেই’ দ্বন্দ্বে ব্রুটাস সমর্থন দিয়েছিলো পম্পেই-কে। তারপর একসময় সিজার তাকে ক্ষমা করে দেয় ও তাকে গলের গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেয়। পাশাপাশি এ’কথা সর্বজনবিদিতই ছিলো যে ব্রুটাসের মাতা সার্ভেলিয়া চিরকালই সিজারের প্রণয়িনী ছিলো (সিজারের একাধিক স্ত্রী ছিলো ও তিনি বহু নারীতে আসক্ত ছিলেন)। আর সেই কারণে অনেকেই মনে করে থাকে যে, ব্রুটাসের প্রকৃত পিতা ছিলেন জুলিয়াস সিজার স্বয়ং। কাহিনীটির ড্রামাটা ঠিক এখানেই। সিজার বিরোধী সিনেটররা কিছুতেই কনভিন্স করতে পারছিলো না ব্রুটাস-কে। তাই তারা তাদের ষড়যন্ত্রকেও বাস্তবে রূপ দিতে পারছিলো না। তবে একসময় তারা সফল হয়, ব্রুটাস মেনে নেয় তাদের কথা, ‘ডিক্টেটর সিজার প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করছে’ রোম শিগগীরই সাম্রাজ্যে পরিণত হতে পারে, তাই প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে সিজার-কে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। ব্যাস নেমে গেলেন তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। যথাদিনে সিনেট ভবনের ভিতরে ষাটজন সিনেটর উন্মুক্ত খঞ্জর হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সিজারের উপর। একের পর এক তারা ছুরিকাঘাত করতে থাকে সিজারের দেহে। রাজ্যজয়ী সেনাপতি সিজার নিরস্ত্র হাতে কিছুই করতে পারছিলো না, শুধু ষড়যন্ত্রকারীদের সনাক্ত করছিলো, একসময় যখন ছুরিকাঘাত করতে এগিয়ে আসে ব্রুটাস, বিস্মিত সিজার তখন কেবল বলেছিলো “Kai su, teknon?”: “You too, child?”
এই আকস্মিক ভায়োলেন্সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে, অন্যান্য সিনেটররা দ্রুত দৌড়ে সেখান থেকে পালাতে থাকে। একসময় সিনেট ভবন ফাঁকা হয়ে যায়, পড়ে থাকে কেবল একটি দেহ, ‘জুলিয়াস সিজারের রক্তাত মৃতদেহ’। জীবিতাবস্থায় প্রবল প্রতাপশালী সিজারের নিথর দেহ কয়েক ঘন্টা ওভাবেই পড়েছিলো পাষাণ মেঝের উপর। কয়েক ঘন্টা পর সৈন্যরা তার মৃতদেহ ওখান থেকে সরিয়ে নেয়।
এই ঘটনাটি ইউরোপের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই নিয়ে অনেক নাটক-নভেলও হয়েছে। স্বয়ং উইলিয়াম শেক্সপীয়ারও লিখেছেন নাটক ‘জুলিয়াস সিজার’।
উল্লেখ্য, এই একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি মানব ইতিহাসে আরো বহুবার হয়েছে।