হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে
———————- রমিত আজাদ
গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়তে শুরু করেছি সেই ছেলেবেলা থেকে। পারিবারিক বিশাল লাইব্রেরীটিই আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছিলো। মনে পড়ে শরৎ বাবুর ‘শ্রীকান্ত’, তখন পড়তাম মাত্র ক্লাস ফাইভে। তাই ঐ সাহিত্যকর্মের কাহিনী ছাড়া আর কিছুই বুঝিনি। রাজলক্ষী-শ্রীকান্তের অনুভূতিটির কিছুই আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। এরপর আরো যা গল্প-উপন্যাস পড়েছিলাম সেগুলিও কাহিনীর বাইরে আর কিছু বোঝা হয়নি। আমাদের কলেজের উপাধ্যাক্ষ জ্ঞানী শিক্ষাবিদ ‘আবুল আশরাফ নূর’ স্যার বলেছিলেন, “The finest thing in this world is Love”। স্যারের এই চমৎকার উক্তিটির গুরুত্বও তেমন বুঝতে পারিনি। প্রথমবারের মত মনে দোলা দিয়েছিলো সেই সময়ের বস লেখক হুমায়ুন আহমেদ-এর লেখা ‘সবাই গেছে বনে’ তখন আমি ক্লাস টেনের ছাত্র। উপন্যাসটি শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ নিথর বসেছিলাম। একই লেখকের লেখা ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’-এর নাট্যরূপে অভিনয় করেছিলেন বস অভিনেতা ‘হুমায়ুন ফরিদী’, বস লেখকের হুমায়ুনের কাহিনী ও বস অভিনেতা হুমায়ুনের অভিনয় এই দুই হুমায়ুনের যাদুতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো ঐ নাটকটি। ধীরে ধীরে ‘প্রেম’ নামক ঐ অনুভুতিটি মন ছুঁতে লাগলো। বস তার একটি গল্প সংকলনের শুরুতে ভূমিকাংশে বলেছিলেন, “এই পৃথিবীর অনেক বড় বড় সাহিত্যকর্মই হয়েছিলো মানব-মানবীর ঐ বিশুদ্ধ অনুভূতিটিকে নিয়ে, উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন লেভ তলস্তয়-এর ‘আন্না কারেনিনা’-র কথা। সত্যিই তো! সেই পৌরাণিক আমল থেকেই তো হয়ে আসছে, ‘হেলেন’ বা ‘ব্রাইসিস’-এর রোমান্স ছাড়া কিসের ‘ইলিয়াড’? ‘দ্রৌপদী’ ছাড়া কি ‘মহাভারত’ হয়?
একসময় আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম মানব-মানবীর ঐ বিশুদ্ধ অনুভূতিটিকে নিয়ে নিজ ক্ষুদ্র সামর্থে কিছু গল্প-উপন্যাস লেখার। তবে এই নিয়ে প্রায়ই কিছু বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ব্লগে প্রকাশিত আমার প্রথম প্রেমের গল্প ‘রেইনা’ পড়ে সবাই ধরেই নিলো যে এটা আমার নিজের জীবনেরই অভিজ্ঞতা। এক পাঠক বারবার জানতে চাচ্ছিলেন, রেইনা এখন কোথায় আছে, আমার সাথে তার আর কোনদিনই কি দেখা হয়নি? ইত্যাদি। আমার ঘনিষ্ট বন্ধুও বারবারই বলছিলো, “এটা তো সত্যি ঘটনা তাই না?” আমি যখন বললাম যে এটা কাল্পনিক, তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন তাই আমার কথা ফেলতে পারলেন না। অবশেষে বললেন, “এখন আর এটা কেউ বিশ্বাস করবে না, যেমন সৈয়দ মুজতবা আলী-র ‘শবনম’ পড়ে সবাই বলেছিলো, ‘আপনি আফগানিস্তানে গিয়ে প্রেম করেছেনই’। আমার লেখা আরেকটি প্রেমের গল্প ‘দারুচিনি দ্বীপের মেয়ে’ পড়ে আমার এক বান্ধবী ধরেই নিলো যে এটা আমার জীবনেরই ঘটনা। আমি তাকে বললাম, “আমি এ পর্যন্ত সাত-আটটি প্রেমের গল্প লিখেছি, এর মানে কি এই যে, আমি সাত-আটটি প্রেম করেছি?” বান্ধবীটি বললো, “হতে পারে, সাত-আটটি প্রেম তো নর্মাল!” রিসেন্টলি লেখা ‘গল্পটি বিরহের নয়’ পড়ে, আমার এক বন্ধু টেলিফোন করে রীতিমত ভর্ৎসনা করলেন, “তুমি এটা কি করলে! মৌলিকে তো তোমার বিয়ে করা উচিৎ ছিলো, করলে না কেন?” আমাকে খুব করে তাকে বোঝাতে হলো যে, এটার সবই কল্পনা। লোকের ভয়ে ‘সমতল পাহাড় ও হৃদয়ের গল্প’ গল্পটির ২য় পর্ব লিখতেই পারছি না, যদি সবাই বলে বসে ‘পাহাড়ী’ মেয়ের সাথেও প্রেম করেছিলেন!
এতকিছুর পরও মানব-মানবীর এই বিশুদ্ধ অনিভূতিটিকে নিয়ে না লিখে পারিনা। মানুষ আছে হৃদয় আছে। হৃদয় আছে প্রেম আছে। প্রেম আছে, প্রেম নিয়ে লেখাও আছে।