লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ
——————————ডঃ রমিত আজাদ
Listening to the Wind of Change

লিস্ট্নিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ -১
(সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পতন পরবর্তী সময়ের উপর ভিত্তি করে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস)
যুগে যুগে মানুষ স্বপ্ন দেখেছে আদর্শ সমাজের। সেই আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানা যুগে মানুষ আঁকড়ে ধরেছে নানা দর্শনকে। ইতিহাসের ধারায় নয়-দশ হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা মানব সভ্যতা এ’ পর্যন্ত এসেছে নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দি্যে, রোম সাম্রাজ্যের উথ্থান-পতন, চার্চের অনুশাসনের প্রবল প্রতাপ ও রেনেঁসার মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি, পারস্য সাম্রাজ্যের উথ্থান-পতন, ইসলামী খিলাফতের দ্বিগীজ্বয় আবার তার দুর্বল হয়ে যাওয়া, এবং পরিশেষে শেষ প্রদীপ অটোমান সাম্রাজ্যেরও নিভে যাওয়ার পর, মাথাচারা দিয়ে উঠতে শুরু করে প্রোটেস্টান্ট দর্শনে বিশ্বাসী ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলো। গোটা এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে উপনিবেশ স্থাপন করে সূচনা করল বিশ্বব্যপী লুন্ঠনের এক নব্য ইতিহাস। কিন্তু এই লুন্ঠনে লাভবান খোদ ইউরোপীয় চিন্তাবিদরাই অনুধাবন করতে শুরু করেছিলেন, এহেন একতরফা শোষণের অবসান হতে বাধ্য। এ্যাডল্ফ তিয়ের ও ফ্রাঁসোয়া গিজোর মত ফরাসী ঐতিহাসিকেরা শ্রেণী ভেদ ও শ্রেণী সংগ্রামের কথা লিখলেন। সব সমাজেই মোটামুটি দুটি শ্রেণী আছে, শোষক ও শোষিত, এবং এদের মধ্যে সংগ্রাম বাধবেই। ১৮৬৭ সালে জার্মান ইহুদী দার্শনিক কার্ল মার্কস পূর্বসুরীদের শ্রেণী বিভাজনের চিন্তাটা গ্রহন করে জন্ম দেন এক নতুন দর্শনের, যার নাম কম্যুনিজম। যেখানে আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, সংগ্রামের মাধ্যমে শ্রেণী লোপ করাই সমাজ বিবর্তনের প্রধান পথ। পৃথিবীব্যাপী ঝড় তোলে তার লিখিত ‘ডাস ক্যাপিটাল’। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যায় এই দর্শন। শেষ পর্যন্ত একদল লোক আঁকড়ে ধরে এই দর্শনকে। তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়, এই দর্শনই পৃথিবী থেকে সব দুর্নীতি আর বৈষম্যের জঞ্জাল দূর করে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা। দেশে দেশে প্রতিস্ঠা হতে শুরু করে ‘কম্যুনিস্ট পার্টি’। মার্কস বলেছিলেন, “ইউরোপ ভুত দেখছে, কম্যুনিজমের ভুত।” ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সেই ভুত হঠাৎ করে ঘাড়ে চেপে বসল রাশিয়ার। অনেকগুলো জাতি ও স্টেট নিয়ে গঠিত জারের রুশ সাম্রাজ্যের নাম রাতারাতি পাল্টে হয়ে গেল ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’। কলেবরে ইউরোপ এমনকি আফ্রিকা মাহাদেশের চাইতেও বড় এই বিশাল রাস্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসল ‘সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি’। ১৯১৭ থেকে ১৯৮৪ প্রবল প্রতাপে শাসন করেছে এই রাজনৈতিক দলটি। শুধু নিজ দেশের অভ্যন্তরেই নয়, লৌহ পর্দায় ঘেরা ইউনিয়নের অভ্যন্তর থেকে সে জাল বিস্তার করে সমগ্র পৃথিবীব্যপী।
একের পর এক বিভিন্ন দেশে সফল হতে শুরু করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। ইউরোপের পূর্বাংশ ছেঁয়ে যায় এই আদর্শে বিশ্বাসীদের শাসনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপরই কম্যুনিস্টরা জাঁকি্য়ে বসে গণচীনে। সেই সাথে এশিয়ার কয়েকটি দেশে। আফ্রিকাও বাদ থাকেনি। এমনকি আটলান্টিকের অথৈ জলরাশী পেরিয়ে সুদুর আমেরিকা মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এই দর্শন। এই দর্শন বিরোধী রাস্ট্রগুলোর নেতা প্রবল প্রতাপশালী মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের পেটের ভিতর দ্বীপ রাস্ট্র কিউবায় ক্ষমতা দখল করে নেয় কম্যুনিস্টরা। তালিকা থেকে পৃথিবীর যে কয়টি দেশ বাকি ছিল সেখানেও সক্রিয় হয়ে ওঠে বিপ্লবীরা। নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত, আঘাত-সংঘাত, কখনো নিরস্ত্র, কখনো সসস্ত্র আন্দোলনে উত্তাল ছিল ‘৬০ ও ‘৭০-এর দশকের বিশ্ব।
কম্যুনিস্টদের ভাষায় এটা ছিল শ্রেণী সংগ্রাম – ধনীক শ্রেণী বনাম সর্বহারা, মালিক বনাম শ্রমিক, শোষক বনাম শোষিত। গুটি কতক ধনীরা প্রবল শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে তাদের ধন সম্পদ, আর সর্বহারারা পঙ্গপালের মত ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সেই সম্পদ। চলছে দু’পক্ষের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এমনই মনে হয়েছিল দৃশ্যটা একপাশ থেকে।
পুঁজিবাদী দেশগুলোর নিরপেক্ষ মানুষদের মনে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত পরাজিত হবে পুঁজিবাদ। আদর্শগত দিক থেকে কম্যুনিজমই সেরা। পুঁজিবাদী দেশগুলোকে একসময় কম্যুনিজম গ্রহণ করতেই হবে। ব্যাপার শুধু সময়ের। ঠিক সে সময়ই ঘটনা ঘটল বিপরীত দিক থেকে। ১৯৮৪ সালে বিশ্ববাসী পরিচিত হলো দুটি নতুন শব্দের সাথে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’। শব্দ দুটি রুশ যার অর্থ যথাক্রমে, ‘পুনর্গঠন’ ও ‘উন্মুক্ততা’। নতুন হাওয়া বইতে শুরু করেছে কম্যুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে। যে আদর্শকে তারা কেবল আঁকড়েই ধরে রাখেনি বরং সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে, তার কোথাও কোন ত্রুটি রয়েছে। যে ত্রুটির সংবাদ এতকাল কেউ পায়নি, তা আজ মৃদু কম্পনের মত অনুভূত হতে শুরু করেছে। সেই ত্রুটির সংশোধন প্রয়োজন, তা নইলে প্রবল ভূমিকম্পে সব ধ্বসে পড়েতে পারে।
তাই সেখানে গৃহিত হলো এই দু’টি নীতি। কিন্তু তাতেও কাজ হলো বলে মনে হয় না। কম্পনের মাত্রা বাড়তেই শুরু করল। ‘৮৪ থেকে ‘৯০ ঠিক ছয় বছরের মাথায় তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল এই এতগুলো বছরের প্রবল প্রতাপশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন। ঠিক তার পরপর অনেক ঘটনাই ঘটল খুব দ্রুত। শান্ত-নির্জন সোভিয়েত ইউনিয়ন অশান্ত হয়ে উঠল। পরিবর্তনের ধাক্কায় পাল্টে গেল অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্রগুলোও। পাল্টে গেল সমগ্র বিশ্ব। কি ঘটেছিল তখন? কি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে? সাধারণ মানুষের জীবন ধারা চিন্তা-চেতনায় কেমন প্রভাব পড়েছিল সেই সময়ের? কেমন করে তারা প্রত্যক্ষ করেছিল সেই সময়ের রাজনীতিকে? কেমন করে মোকাবেলা করেছিল এই অস্থিরতাকে? এই সবকিছু নিয়ে এই ধারাবাহিক উপন্যাস – ‘লিস্ট্নিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ’। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তন নিয়ে লেখা ও গাওয়া বিখ্যাত গানের গ্রুপ ‘স্করপিওন্স’-এর একটি গানের কলি থেকে এই নামটি নেয়া হয়েছে।
এখানে গল্পের নায়ক একজন বাংলাদেশী। যে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে গিয়েছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে। রাজনীতিতে তার আগ্রহ সামান্য। আর ঐ বয়সে কতটুকুই বা বোঝা যায়? হঠাৎ করে তার চোখের সামনেই ঘটে যেতে শুরু করল সবকিছু। আর সেও হয়ে উঠল ঐ ঘটনাবহুল সময়ের অংশ।

লিস্ট্নিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ – ২
পূব আকাশে উঠি উঠি করছে সূর্য। ভোরের সূর্য আমার দারুন ভালো লাগে। সেই সাথে ভালো লাগে ঐ সুনীল আকাশটাকে। হোস্টেলের রূমে আমার বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে পুরো আকাশটাকেই দেখা যায়। সাপ্তাহিক ছুটির অলস দিনটিতে আমি বিছানায় শুয়ে দেখি আকাশে হরেক রঙের মেঘের খেলা। জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া টুকরো আকাশটা কখনো পুরোটাই আশ্চর্য্য নীল, আবার একটু পরেই একদল সাদা মেঘ এসে ভীড় করে। ধীরে ধীরে তাদের আকার আকৃতি বদলায়, কখনো রঙও বদলায়। এইভাবে বদলাতে বদলাতে তারা ভেসে ভেসে দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। আবার তাদের জায়গায় এসে দাঁড়ায় অন্য কোন মেঘের দল। ভোরের আকাশ আর দুপুরের আকাশ একরকম নয়।সদ্য উদিত সূর্যের বর্ণচ্ছটায় ভোরের মেঘের গায়ে লাল-গোলাপী ছোপ পড়ে। যেন লজ্জ্বরাঙা কিশোরীর গালে রক্ত ছলকে উঠেছে। দুপুর গড়াবার আগেই সেই রঙ হারিয়ে শ্বেত-শুভ্র হয়ে যায় সেই মেঘরাজী। বিকেল নাগাদ আবার সেই গোলাপী আভা ফিরে পায় সেই মেঘগুলো। তাদের পাশে পাশে দেখা যায় টুকরো টুকরো ছাই রঙা মেঘ। এই মেঘের রঙ পাল্টাপাল্টি দেখতে বেশ ভালো লাগে আমার। শুধু কি মেঘ? আকাশের রঙও বদলায়। আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছি আকাশের ঐ নীল রঙও দিনের সময়ভেদে নানান ঔজ্জ্বল্যের হয়। দিনের শেষে সন্ধ্যা নাগাদ নীল ধীরে ধীরে ছাই রঙা, তারপর দিনটা ফুরিয়ে গেলে, গোধুলির ম্লান আলো উবে গিয়ে নিকষ কালো হয়ে, ঝকঝকে তারাগুলো বুকে ধরে রাতের রূপ ধারণ করে। ঐ অত অত উজ্জ্বল তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলে। অরুন্ধুতি, কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডল, ক্যসিওপিয়া সরে সরে গিয়ে নতুন দৃশ্যপট রচনা করে। কখনো পাহাড়ী ফুলের মিষ্টি গন্ধ এসে মনে আবেশ ছড়ায়।
সিলেটের প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য অদ্ভুত। আমার কলেজটির আশেপাশে ছোটবড় পাহাড়ের সারি। মাঝে মাঝে সবুজ উপত্যকা। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ঝাঁকড়া সবুজ পাতাওয়ালা নানান জাতের বিটপী দাঁড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। ক্যাম্পাসের পিছন দিয়ে কলকল করে বয়ে চলেছে পাহাড়ী ঝর্ণা মালিনীছড়া। দূরের খাসিয়া-জয়ন্তীয়া পাহাড়ের চূড়াগুলোকে দেখায় গাঢ় নীল। আর কাছেরগুলো উজ্জ্বল সবুজ। ঘাস, প্রান্তর আর পাহাড়ের গোড়ার সঙ্গমস্থলের কোথাও সবুজ কোথাও খোলা মাটি। আর বহু দূরে দিগন্তের একেবারে কাছাকাছি আকাশের গায়ে হেলান দি্যে থাকা ঘুমন্ত পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য্য ভাষায় বর্ণনা করা যায়না।
সিলেটের আবহাওয়াও অদ্ভুত। এই রোদ তো এই মেঘ। ঝকঝকে আকাশে সোনালী সূর্য্য হাসছে, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে আসে কালো মেঘের দল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ছেয়ে দিল নীল আকাশ। তারপর ঝমঝম করে শুরু হলো বৃষ্টি। ঝরছে তো ঝরছেই, ঝরছে তো ঝরছেই, আর থামার কোন নাম নেই। মনে হবে যেন অনন্তকাল আমরা এই বৃষ্টির মধ্যেই আছি। বৃষ্টির বড় বড় ফোটাগুলো পড়তে পড়তে যখন চারিদিক মূখরিত করে তোলে, তখন প্রকৃতির মাঝে এক অদ্ভুত সুর জাগে। সেই সুরের মূর্ছনায় মন উদাস হয়। মনে হয় যেন বৃষ্টির গান শুনছি।
তবে সারা বছরই এক রকম নয়, ছয়টি ঋতু ছয় রূপেই আসে। বারবার প্রকৃতির রঙ বদলায়। দু’য়েক সময় কাল বৈশাখী ঝড় ওঠে। ঝড়ের দোর্দন্ড প্রতাপে উপড়ে ফেলে কিছু অসহায় গাছ, দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে টিনের ঘর। উড়িয়ে নিয়ে যায় কোনরকমে টিকে থাকা দরিদ্রের বাঁশের বেড়া। প্রচন্ড বেগে বাতাস যখন শীষ কাটতে থাকে, তখন মজবুত দালানে বসেও বড় ভয় হয়। সেই শিষ কাটতে থাকা প্রতাপী বাতাসও একসময় শান্ত হয়ে আসে। প্রকৃতিতে আবার ফিরে আসে স্বস্তি ।
সিলেটে আর বেশীদিন নেই আমি। এইতো সামনেই এইচ এস সি পরীক্ষা। তারপর এই কলেজের পাট চুকিয়ে ঢাকা চলে যাব। অনেকগুলো বছর এখানে ছিলাম। চলে যাব ভাবতেই মনটা খারাপ লাগছে। সিলেটের এই কলেজটিকে আমি বড় বেশী ভালোবাসি। এই কলেজ ছেড়ে চলে যাব ভেবে মাঝে মাঝে কান্নাই পেয়ে যায়। এই কলেজের জন্য আমার মন খুব পুড়বে । সব চাইতে বেশী মিস করব এই জানালাটিকে, যার মধ্যে দিয়ে আমি প্রকৃতির রূপ বদলানো দেখতাম।
যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে,
যা হচ্ছে তা ভালোই হচ্ছে,
যা হবে তা ভালোই হবে।
তোমার কি হারিয়েছে – যে তুমি কাঁদছো?
তুমি কি নিয়ে এসেছিলে – যা তুমি হারিয়েছ?
তুমি কি সৃষ্টি করেছ – যা নষ্ট হয়ে গেছে?
তুমি যা নিয়েছ, এখান থেকেই নিয়েছ,
তোমার আজ যা আছে,
কাল তা অন্যকারো ছিল।
পরশু সেটা অন্যকারো হয়ে যাবে —
পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম।
(উপরের কথাগুলো গীতার সারাংশ)

লিস্ট্নিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ – ৩
“রোমানকে আর দেশে পড়ানো ঠিক হবেনা”। রাতের খাবারের টেবিলে বসে বললেন আমার মা।
ঃ হু, আমিও এরকমই ভাবছিলাম।
সায় দিলেন আমার বাবা। বাবা-মার একমাত্র ছেলে আমি, খেতে খেতে চুপচাপ শুনছিলাম তাদের কথা। কথাগুলো ঠিক যেন আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না। এইচ, এস, সি, পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ভর্তির জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কোচিং করছি। তখন ভর্তী পরিক্ষায় কম্পিটিশন ছিল ভীষণ। ছাত্রসংখ্যা লক্ষ লক্ষ অথচ সীটের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে মাত্র। বুয়েট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আটটি মেডিক্যাল কলেজ, চারটি বি, আই, টি, ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চিটাগাং ও রাজশাহী চারটি বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটি এই ছিল সেই সময়ের উচ্চ শিক্ষার বিদ্যাপিঠ। এছাড়া একদল ছেলে ঝুকত সসস্ত্রবাহীনি ও মেরিন একাডেমির দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা তখন পাবলিক বা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ই বুঝতাম, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ধারনাই সেই ১৯৮৮ সালে তৈরী হয়নি। একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কথা উড়ো উড়ো শুনতে পাচ্ছিলাম, তবে আমি বা আমাদের বন্ধু-বান্ধবের কেউই ঐ মুখো হওয়ার কথা ভাবিইনি। প্রথমতঃ বিশাল টাকা-পয়সা খরচ করে পড়ার ব্যাপার, দ্বিতীয়তঃ ওখানে পড়াটা মোটেও প্রেস্টিজিয়াস মনে করিনি- ‘ভালো ছাত্ররা ঐসব হেজি-পেজি জায়গায় পড়বে কেন, এতে কোন সম্মান আছে? ওখানে পড়বে যারা কোথাও চান্স পাবেনা অথচ বাবার অঢেল টাকা।’ এই সব ভাবতাম । আমার টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভালো সাবজেক্টে পড়ার। ভালো সাবজেক্ট বলতে আমরা পপুলার সাবজেক্ট বুঝতাম। ফিজিক্স, এ্যপ্লাইড ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, বায়োকেমিস্ট্রি, সদ্য খোলা মাইক্রো বায়োলজী, বাণিজ্য অনুষদের ইকোনমিক্স, কলা অনুষদের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস, ল, ইত্যাদি।পরবর্তি জীবনে বুঝেছি, সব সাবজেক্টই ভালো, খারাপ কোন সাবজেক্ট নেই। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ, এখানে মানুষ প্রতিদিন যেই সমস্যাটা সব চাইতে বেশি ফেস করে সেটা ম্যাটেরিয়াল প্রবলেম। তাই মানুষ এমন একটা সাবজেক্ট খোঁজে যেই সাবজেক্টটার মার্কেট ভ্যালু আছে, অর্থাৎ যেই সাবজেক্ট-এ পড়লে তার দ্রুত চাকুরী হবে ও ভালো অর্থ উপার্জন করতে পারবে। শুনেছি এককালে ইন্জিনিয়ারিং-এ পড়ার আগ্রহী ছাত্রের ভীষণ অভাব ছিল। সবাই চাইত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে, লক্ষ্য ক্ষমতাধর সি,এস,পি অফিসার হওয়া। যখনই মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরীর ব্যবস্থা হলো, ইন্জিনিয়ারদের ভাগ্যের দুয়ার খুলে গেল। সেখানে চাকুরী করে অঢেল টাকা উপার্জন করতে শুরু করল তারা। নিজস্ব এলাকায় গড়ে তুলল তিনতলা-চারতলা সুরম্য অট্টালিকা। আশেপাশের লোকজনের চোখ কপালে উঠে গেল, এত কিছু! বাবা-মাদের লক্ষ্য হয়ে উঠল ছেলেকে ইন্জিনিয়ারিং অথবা ডাক্তারী পড়াবে। বাবা-মাদের সেই আকাঙ্খা সন্তানদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। সে সময় একটা কথা মুখে মুখে ফিরত, বাবা তুমি ডাক্তার হবে না ইন্জিনিয়ার হবে? ডাক্তারদের উপার্জন এখনকার মত নির্লজ্জ্বভাবে না হলেও বরাবরই ভালো ছিল।
বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা কখনো ভাবিনি। ভাবার অবকাশ আসলে ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি, বিদেশে পড়ার সামর্থ্য কোথায়? বিদেশে তো পড়বে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা। যেমন আমাদের ক্লাসের এহতেসাম ও সালমান ইতিমধ্যেই প্রস্ততি নিচ্ছিল আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার। এহতেশাম খুব ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে। সালমানের বাবা অনেক বড় ডাক্তার। টোফেল-মোফেল কিসব যেন করছিল। বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই সময়টা ছিল খুব টেনশনের। ঐ যে বলেছিলাম ছাত্রের তুলনায় সীট সংখ্যা খুবই কম। অনেকে আর্মির চাকরিতে ঝুকত এই কারণে যে পাশ করার পরপরই মাত্র দুবছরের ট্রেনিং শেষেই চাকুরী। অনেকেই আমাকে বলেছিল, “আরে রোমান বুদ্ধিমান হও, বাদ দাও তোমার উচ্চ শিক্ষা। আর্মিতে ঢুকে যাও, ঐসব উচ্চশিক্ষা-ফিক্ষার চাইতে এটাই এখন ভালো। একেবারে সোনার হরিণ।” কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারাও বেশ খুঁজে বেড়াতো আর্মি অফিসার জামাই। পাড়ায় কোন ল্যাফটেন্যান্ট বা ক্যাপ্টেন থাকলে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতারা তাকে খুব তোয়াজ করত, উদ্দ্যেশ্য, যেন তাদের মেয়েটার দিকে তাকায়। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। মীরপুরের এক পাড়ায়, এক বাড়ীর চালে আচার শুকাতে দিয়েছে বাড়ীর মা। ইয়াং ছেলেরা যা করে আর কি, এক ছেলে চুপে চুপে উঠেছে সেই আচার চুরি করতে। হঠাৎ মায়ের নজরে পড়ে গেল সখের চোর ছেলেটি। ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন সেই মা। “বেয়াদব ছেলেপেলে, আচার চুরি করে, এদের বাবা-মা কি এদের কিছু শেখায় না, …… ইত্যাদি ইত্যাদি।” অপরদিন ঐ বাড়ীরই আচার চুরি করতে উঠল পাড়ার আরেক ছেলে, ছেলেটি তখন বাংলাদেশ মিলিটারি এ্যাকাডেমী (বি,এম,এ)-তে ট্রেনিং নিচ্ছে, ছুটিতে বেড়াতে এসেছে (আর্মিতে চান্স পেয়ে এলাকার সবার কাছেই সে এখন পরিচিত)। এবার ঐ বাড়ীর মা-মেয়ে দুজনেরই নজরে পরল ছেলেটিকে, কিন্তু কেউই কিছু বলছেনা। মা এবার গাল-মন্দ তো দূরের কথা, মিটি মিটি হাসছেন। উদ্দেশ্য হলো যখনই ছেলেটির চোখে চোখ পড়বে তখনই, “বাবা তোমার আচার খাওয়ার সখ হয়েছে? এসো এসো..” – বলে প্লেটে তুলে দিয়ে খাওয়াবে।
আমি যে আর্মিতে যাওয়ার বিষয়টি একেবারেই ভাবিনি তা নয়। কিন্তু দোদুল্যমানতার মধ্যেও ছিলাম। জীবনে উচ্চশিক্ষারও প্রয়োজন আছে, কিন্তু আর্মিতে গেলে তো উচ্চশিক্ষা হবেনা। আবার অনেকে বলে, “সব চাইতে বেশী কম্পিটিশন তো ঐ আর্মিতেই, হাজারে একজন চান্স পায়। চেষ্টা করে দেখো রোমান তুমিতো মেধাবী, সহজেই চান্স পেয়ে পাবে। সুযোগ হাতছাড়া করোনা।” আবার ভাবছিলাম মেরিন এ্যকাডেমিতে গেলে কেমন হয়? টাকা-পয়সা নাকি ভালোই দেয়। আবার অনেকে বলে, “দরকার নাই, দরকার নাই, জাহাজে জাহাজে সাহরে-মহাসাগরে জীবন। মেরিনওয়ালাদের বৌ থাকেনা”। সত্যিই জীবনের এই পর্যায়ে এসে সিদ্ধান্ত নেয়াই কঠিন!
ঃওকে কোথায় পাঠাবে ঠিক করেছ?
মায়ের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম আমি।
ঃ ভাবছি, আমেরিকা-ইংল্যান্ডে তো আর পাঠাতে পারব না অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার।
বললেন বাবা।
ঃ বাবা, রোমানকে বিদেশে পাঠাতে চাইছ কেন? দেশে পড়লে কি সমস্যা?
বললেন আমার বড় দুই বোনের মধ্যে যিনি ছোট, রিতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স পড়ছেন।
ঃ বিদেশে পাঠানোই তো উচিৎ। ওদের পড়ালেখা তো অনেক উন্নত, অনেক কিছু শিখতে পারবে রোমান। অনেক বড় ডিগ্রী নিয়ে আসবে। বললেন সব চাইতে বড় বোন রীনা। সাংবাদিকতায় এম, এ, পাশ করে এখন ভালো চাকুরী করছেন।
ঃ দেশের অবস্থা দেখছিস মা। এরশাদ তো একটা দুষ্ট গ্রহ। ও আসার পর থেকেই এই দেশের উপর শনি ভর করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো এখন আর বিদ্যাপিঠ নেই, ব্যাটেল ফিল্ড হয়ে উঠেছে। ছেলেমেয়েদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। এছাড়া ঘন ঘন এরশাদ ভ্যাকেশনের তোড়ে, সেশন জট যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তাতে চার বৎসরের মাস্টারস কোর্স শেষ করতে এখন দশ বৎসর লাগছে। অনেকেই উপহাস করে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তী হওয়া মানে দশ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড। না রোমানকে আমি এর মধ্যে ঠেলে দিতে চাইনা।
বললেন, মা।
ঃ মা, তুমি ঠিকই বলেছে। আপাতো একটু আগে পাশ করে গেল, তাই খুব একটা টের পায়নি। আর আমি ৮২ থেকে ৮৮ পুরো এরশাদের সময়টা কি কষ্টটাই না করছি। এই দেখ ছয় বছর হয়ে গেল এখনো মাস্টার্স শেষ হলোনা, দুদিন পরে পরেই এরশাদ ভ্যাকেশন। আর জীবনের নিরাপত্তা? তোমাদের মেয়েকে যে জীবিত দেখতে পাচ্ছ এটাই অনেক বেশী। তোমাদের তো বলিনি, ঐ দিন ইউনিভার্সিটিতে মিছিলের উপর গুলি চলে। আমার চোখের সামনে একটা ছেলের মাথায় গুলি লাগল, ওর মগজ ছিটকে পড়ল চারদিকে। আমি আর্তনাদ করে কোনক্রমে পালিয়ে বাঁচলাম। এই হলো ইউনিভার্সিটির হাল।
সকলে ভয়ার্ত চোখে তাকালো আপার দিকে।

লিস্ট্নিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ – পর্ব ৪
এই পথ দিয়ে আমি প্রায় প্রতিদিনই হেটে যাই। পথটা মোটামুটি নির্জন এবং সুন্দর। ঢাকা শহরের ভিতরের রাস্তাগুলোতে ফুটপাত সাধারণতঃ থাকেনা। কিন্তু এই রাস্তাটায় আছে। ফলে ঝট করে পিছন থেকে রিকশার গায়ের উপরে উঠে যাওয়া, অথবা সহসা গাড়ির ক্ষুদ্ধ হর্ণ শোনার ভয় নেই। আরেকটি বিষয় এই পথটির প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়িয়েছে। সেটি হলো পথের একপাশে সারি সারি কাঠগোলাপ গাছের সৌন্দর্য্য, আর অদ্ভুত সুন্দর ফুলগুলোর মন মাতানো সৌরভ। কাঠগোলাপ ফুল বোধহয় একটু বেশী ঝরে। তাই পথ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় পরে থাকে ঝরা ফুল। মাঝে মাঝে দু’একটা ঝরা ফুল তুলে নিয়ে তার রুপ আর সৌরভে মন মাতাই। উঠতি বয়সী ছেলেদের জন্য পথটির আরেকটি আকর্ষণ আছে; পথটির একপাশে ভিকারুননিসা নুন স্কুল, আর আরেকপাশে মগবাজার বালিকা বিদ্যালয়।
বখাটে অনেক ছেলেই ছুটির সময় ঐ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের দেখার জন্য। আমি রোমান অবশ্য এই কাজটি কখনোই করিনি। কারণ এলাকায় ভদ্র ছেলে হিসাবে আমার শুনাম আছে। কোনদিন যদি কেউ আমাকে ছুটির সময় ঐ পথের পাশে দেখে, তাহলে এতদিনের গড়া রেপুটেশনটা এক মুহূর্তেই গায়েব হয়ে যাবে।
বিকাল বেলাটা খুব সুন্দর। আমি লাঞ্চের পর আমাদের দু’বছর আগের কেনা ইস্টার্ন হাউজিং-এর এপার্টমেন্টের ছোট্ট রূমটায় শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ি। তারপর সূর্য হেলতে হেলতে পশ্চিমাকাশে অনেকটা ঢলে পড়লে, হিঙ্গুল শাহ সাহেবের মসজিদ থেকে মধুর সুরে আছরের আজান ভেসে আসলে বই বন্ধ করে আমার প্রিয় খদ্দেরের পান্জাবীটা পড়ে চলে যাই মসজিদে। আছরের নামাজ শেষ হলে, পরিচিত দু’একজনার সাথে টুকটাক কথা হত। আসলে পরিচিত তেমন কেউ নাই। এই সিদ্ধেশরী এলাকায় আমরা এসেছি মাত্র দু’বছর হয়। তাছাড়া আমি এই দু’বছরের বেশীরভাগ সময়ই ছিলাম সিলেটের কলেজে। এইচ, এস, সি, পরীক্ষা দিয়ে কলেজ ছেড়ে একবারে চলে এলাম এই কিছুদিন হয়।
মগবাজারের নিজেদের বাড়ীটা ভাড়া দিয়ে, এখানকার এ্যপার্টমেন্টে উঠে গিয়েছি। দেশে এপার্টমেন্ট কালচার শুরু হয়েছে মাত্র। বাবা যখন আমাদের অনেক পুরাতন একটা জমি বিক্রি করে আর কিছু জমানো টাকা মিলিয়ে এ্যপার্টমেন্টটি কিনলেন আমি তখন গা করিনি। কিনতু বাবা-মা যখন মগবাজারের পুরাতন নিজস্ব বাড়িটা ছেড়ে এ্যাপার্টমেন্টে উঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, খেপে উঠলেন আমার দাদীমা। বললেন
ঃ আপন বাড়ী রেখে কেউ অন্য বাড়িতে যায়?
হেসে উঠলেন বড় আপা, বললেন
ঃ ওটাও আপন বাড়ী।
ঃ তা হোক এই বাড়িতে তোরা জন্ম থেকে আছিস। কত সুখ স্মৃতি এই বাড়িতে।
ঃ ও বাড়িতেও অনেক সুখ স্মৃতি হবে।
এবার মুখ খুললেন ছোট আপা
ঃ নারে, দাদী ঠিকই বলেছে। নিজের বাড়ী রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা।
মা বললেন,
ঃ ওটা খুব লাক্সারিয়াস। মর্ডান ফিটিংস, টাইল্সের বাথরুম, দামী মোজাইকের ফ্লোর, নেটের জানালা, আধুনিক কিচেন, চব্বিস ঘন্টা সিকিউরিটি গার্ড, এরকম ঢাকা শহরে আর নেইরে। দেখিস তোদের ভালো লাগবে।
ঃ হুঁ, হুঁ, ভালো লাগবে। সেখানে তো ঘরের সামনে বড় লন আছে, নারকেল, পেয়ারা, জামরুল আর আমগাছে ভরা বাগান আছে! খাটের নীচ ভরে তুমি ঝুনা নারকেল রাখবে! টিপ্পনি কাটলেন ছোট আপা।
মা চুপ করে রইলেন, কিছু বললেন না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, মা যেই সিদ্ধান্ত নেন সেটাই হয়। একসময় আমরা ঠিকই উঠে এলাম এ্যাপার্টমেন্টে। বাড়ী বদলের সময় আমি অবশ্য ঢাকায় ছিলাম না। ছিলাম সিলেটে, আমার প্রিয় কলেজে। সেখানে থাকতেই শুনলাম বাড়ি বদলের কথা। তারপরের ভ্যাকেশনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সোজা চলে এলাম সিদ্ধেশরীর এ্যাপার্টমেন্টে।
এ্যাপার্টমেন্ট হাউজিং কমপ্লেক্সের কালচার একটু ভিন্ন মনে হলো। মানুষের সাথে মানুষের মেলামেশা কম। যে যার মত আসছে যাচ্ছে, কারো সাথে কারো কথাবার্তা নেই, সখ্যতা নেই। একদিক থেকে ভালোই, যে যার মতো চলে। অপরের পারিবারিক জীবনে উৎসুক্য, ব্যাক্তিগত জীবনে নাক গলানো ইত্যাদি একেবারেই নেই। আবার মনে হয়, মানুষে মানুষে সখ্যতা না থাকলে কেমন? এভাবে জীবন কি রোবটের মত হয়ে যায়না? তবে এখানে কিছু ভালো জিনিস দেখলাম। পুরো হাউজিংটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ১৫ জন সিকিউরিটি গার্ড ২৪ ঘন্টা পাহাড়া দিচ্ছে। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা। ফ্ল্যাট ওউনারদের নিয়ে গঠিত হয়েছে মালিক সমিতি। তারা সবকিছু পরিচালনা করেন। পুরো হাউজিংটা খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুশৃংখল।
ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা কমনরূমের ব্যবস্থা আছে, লাইব্রেরীও আছে। এই সব বিষয় খুব পজেটিভ। এগুলো মগবাজারের ঐ গলিটিতে কল্পনাই করা যায়না। ওখানে নানা কিসিমের লোক থাকত। কোন কোন পরিবার ছিল শিক্ষিত আর কোন কোন পরিবার ছিল একেবারেই অশিক্ষিত। তাই মন মানসিকতায়ও পার্থক্য স্পষ্ট ছিল। একবার একটা ক্লাব করেছিল ইয়াং আর মুরুব্বীরা মিলে। ক্ষমতা আর নানান দ্বন্দে শেষ পর্যন্ত দুবছরের বেশী টিকাতে পারল না ক্লাব। বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন ক্লাব টিকাতে। বলেছিলেন, ” এট লিস্ট আমাদের সন্তানদের কথা ভেবে, আসুন ক্লাবটা টিকিয়ে রাখি”। কিন্তু কাজ হয়নি। আসলে আমাদের দেশের মানুষ সহজে অন্য কাউকে ভালো কিছু করতে দেয়না।
১৯৮৬ সালের জুলাইয়ের দিকে আমরা নতুন এ্যাপার্টমেন্টটিতে আসি, ১৯৮৮ সালের জুলাইয়ের দিকে যখন আমি একবারে ঢাকা চলে এলাম তখন এখানে আমার পরিচিত কেউই ছিলনা। শুধু উপরের তলায় বুয়েটের ছাত্র এক সুদর্শন বড় ভাই ছাড়া। প্রথমটায় আমি ভেবেছিলাম, এখানে বোধহয় কেউ মিশুক না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, বিষয়টা আসলে সেরকম নয়। আসলে সবাইই এখানে নতুন এসেছে। তাই সবাই সবার সাথে এখনো পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। ধীরে ধীরে আমার দু’একজনার সাথে পরিচয় হতে শুরু করল। এদের মধ্যে একজন কাজল ভাই। আমার চাইতে বছর দুয়েকের বড়। খুব ভালো মানুষ।
এইচ, এস, সি পাশই যথেষ্ট নয়। ভর্তি পরীক্ষার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন। সকলের পরামর্শে ভর্তি হয়ে গেলাম একটা কোচিং সেন্টারে। মুনলাইট কোচিং সেন্টার। মৌচাক মার্কেটের কাছেই। সেখানে পড়তে ভালোই লাগল, আমারই মত সবাই, ভর্তি যুদ্ধের যোদ্ধা। নতুন সব বন্ধু এবং বান্ধবী। বন্ধুদের সাথে জমিয়ে ফেললাম। আর মূল আগ্রহ ছিল বান্ধবীবের দিকে। এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রথমতঃ আঠারো-উনিশ বছরের এটাই দোষ (অথবা গুন), দ্বীতিয়তঃ, এর আগে আমি কখনোই কো-এডুকেশনে পড়িনি। প্রতিদিনই নতুন নতুন বন্ধু এবং বান্ধবীরা ভর্তি হতো। বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে দেখতাম, কার সাথে জমানো যায়।
ঐ বয়সটাই এরকম। চোখ শুধু এদিক-ওদিক চলে যায়। রাস্তা-ঘাটে, মার্কেটে, নিজ এলাকায়, কোচিং-এ সবখানেই একই অবস্থা। ভাবতাম, আমি এমন হয়ে যাচ্ছি কেন? পরে জানলাম সব বন্ধুদেরই একই অবস্থা। এ প্রসঙ্গে একটা হাসির কথা মনে পড়ে গেল। একবার আমার এক বন্ধু মার্কেটে গিয়েছে। এক দোকানে গিয়েছে কি কিনতে। একটু পরেই ঐ দোকানে আমাদের বয়সী সুন্দরী এক তরুণী ঢুকল। তার রূপ-সৌন্দর্য্য দেখে, আমার বন্ধু তো মুগ্ধ। সে আর দোকান থেকে বের হয়না। দূর থেকে মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটির সাথে তার মা ছিল। মেয়েটি কোন কথা বলছিল না। যা বলার মাই বলছিল। কেনাকাটা শেষ হলে, দোকানী যখন প্যকেট করতে গেল, মেয়েটি কর্কশ গলায় বলে উঠল, “একটা লড়ি দিয়া বাইন্দা দেন না।” ঐ কন্ঠ আর ঐ ভাষা শুনে আমার বন্ধুর মুগ্ধতা উবে গেল।
প্রথম প্রথম আমরা ছেলে-মেয়েরা আলাদা আলাদা বসতাম। একদিন একটা মেয়ে একটু লেটে এসে দেখলো মেয়েরা যেদিকটায় বসে সেদিকটা ফীলআপ হয়ে গেছে। ছেলেদের দিকটায় এখনো বেশ কিছু সীট খালি আছে। কিন্তু মেয়েটি জড়তা ভেঙে কিছতেই ছেলেদের সাথে বসতে পারছিল না। অনেক চাপাচাপি করে। মেযেদের দিকটাতেই বসল। আমাদের যারা পড়াতেন, তারা সবাইই ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা তাদের কখনো ভাইয়া কখনো স্যার ডাকতাম। সম্বোধনটা ক্লিয়ার করতে পারিনি। এরকম একজন ভাইয়া-স্যার ঢুকলেন। দু’একটা অংক করানোর পর লক্ষ্য করলেন মেয়েটি চাপাচাপি করে বসার কারণে ঐ বেঞ্চে সবার লিখতে অসুবিধা হচ্ছে। তিনি বললেন, “এরকম চাপাচাপি করে বসেছেন কেন? এইদিকে কোথাও এসে বসুন। আরে এতে লজ্জ্বার কিছু নাই। এখন তো আলাদা আলাদা বসেছেন, কয়েকমাস পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তো পাশাপাশিই বসবেন।” উনার কথায় মেয়েটি হয়তো বিব্রত বোধ করল, কিন্তু আমরা খুব কৌতুক অনুভব করলাম।
আলাদা বসলেও, চুপিচুপি আমরা ওদেরকে দেখতাম। আর তাদের রূপ-সৌন্দর্যের বিশ্লেষণ করতাম। শায়লা ফর্সা ও সুন্দরী ছিল, ছাত্রীও ভালো ছিল। ফাউস্টিনা কালো ও ছোটখাট গড়নের ছিল, সুন্দরী নয় বলে কারো চোখ ওর দিকে পড়েনি, তবে ও খুব ভালো ছাত্রী ছিল। শায়লার সাথে ছিল সঞ্চিতা, শায়লার মত সুন্দরী না হলেও, অসুন্দরী নয়। রূপালী ছোটখাট গড়নের হলেও ভরাট শরীর, দেখতেও সুন্দরী। ওকে দেখে মনে হলো কোথায় যেন দেখেছি। একদিন ও আমাকে বলল, “তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি”। এখন আমার মনে পড়ল কোথায় দেখেছি। বললাম আমরা একই হাউজিং কমপ্লেক্স-এ থাকি। “ও হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো”, চিৎকার করে উঠল রূপালী। সবার না হলেও বেশীরভাগের রূপ-সৌন্দর্যেই আমরা মুগ্ধ হতাম। সৌন্দর্য বলতে তখন মেইনলি মুখশ্রীটাই দেখতাম। ঐ বয়সে নারীদেহের বাঁকগুলোর দিকে নজর যেতনা।
কিছুদিনের মধ্যে আমাদের জড়তা ভেঙে গেল। এখন আমরা একে অপরের সাথে ফ্রীলি কথা বলি। পাশাপাশিও বসা শুরু করেছি। শিমুল নামের একটি মেয়ে, প্রাযই আমার পাশে এসে বসতে শুরু করল। শ্যামলা রঙের সুন্দর ফিগারের মেয়েটি মোটামুটি আকর্ষণীয়। প্রথম দিকে আমরা পড়ার আলাপটাই বেশী করতাম। তারপর এটা সেটা আলাপ শুরু হলো। একদিন শিমুল প্রশ্ন করল, “একটা হিন্দি সিনেমা খুব হিট করেছে দেখেছ?”
ঃকি নাম ছবিটির?
ঃ কেয়ামত সে কেয়ামত তাক।
ঃ ও হ্যাঁ, দেখেছি। আমীর খান আর জুহি চাওলা।
(সে সময়, ডীশ এ্যান্টেনা বা কেবল লাইন বলে কিছু ছিলনা। ভিডিও নামক যন্ত্রটিরও ব্যাপক প্রচলন হয়নি। খুব দাম ছিল বলে অল্প কিছু ঘরেই ছিল। কারো বাড়িতে ভিডিও আছে মানেই তারা ধনী। আমরা অবশ্য ধনী ছিলাম না, কিন্তু আমাদের ভাই-বোনদের অনেক পীড়াপীড়িতে বাবা একটা ভিডিও কিনেছিলেন। একসময় আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা হলের পরিবেশ যথেষ্ট ভদ্র ছিল, এবং মূলতঃ শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখত। ছবির মান যথেষ্ট ভালো ছিল। আমি এই কথা বলব না যে উন্নত দেশগুলোর মতোই ভালো ছিল। সদ্য স্বাধীন একটা দেশের কাছ থেকে কয়েক শত বছর ধরে স্বাধীন অথবা কখনোই পরাধীন হয়নি এমন সব দেশগুলোর মতো উন্নত সংস্কৃতি আশা করা যায়না। কিন্তু একথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, প্রচেষ্টা ছিল। বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং গৌরবময় । ঢাকার নবাব পরিবারের তরুনদের পৃষ্টপোষকতায় এদেশে প্রথম সিনেমা নির্মিত হয় সেই ১৯২৭ সনে, স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক ছবি ‘সুকুমারি’ । প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক সিনেমা ‘দা লাস্ট কিস্’ মুক্তি পায় ১৯৩১ সনে । আর বাংলাদেশের প্রথম সবাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালে, আব্দুল জাব্বার খানের পরিচালনায় । সেই সময়ের ছবি তো আর আমার দেখা হয়নি, তবে ‘৭০-‘৮০-র দশকের ছবিগুলো আমি দেখেছি। কিছু ছবির স্মৃতি এখনও মনে পরে, সাড়েং বৌ (আবদুল্লা আল মামুন), ডুমুরের ফুল (শুভাস দত্ত), গোলাপী এখন ট্রেনে (আমজাদ হোসেন), কসাই (আমজাদ হোসেন), এমিলের গোয়েন্দা বাহীনি (বাদল রহমান), ছুটির ঘন্টা (আজিজুর রহমান), সীমানা পেরিয়ে (আলমগীর কবির), রূপালী সৈকতে (আলমগীর কবির), ডানপিটে ছেলেটি, ইত্যাদি। এর মধ্যে একবার (১৯৮০ সালে) ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল হলো বাংলাদেশে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল দর্শকরা হলে। টিকিট কাটতে গিয়ে সেকি হুজ্জোত। কয়েক মাইল লম্বা লাইন। হলগুলোতে দর্শক গীজ গীজ করছিল। শুনেছি ফ্লোরে বসেও লোকে সিনেমা দেখেছে। আর আমরা যারা এত লাঠালাঠি করে টিকিট কাটতে পারিনি, তাদের খুব মন খারাপ হয়েছিল। এত ভালো ভালো ছবি দেখতে পারলাম না! কিন্তু মন খারাপ কয়েকদিন পরই দূর হয়ে গেল। সরকার ব্যবস্থা করে দিল। বিটিভিতেই সবগুলো সিনেমা দেখানো হবে। দেশব্যাপী মানুষের সেকি আনন্দ। সেই প্রথম আমরা দেখলাম সাড়া জাগানো ইন্দোনেশীয় ছবি ‘বাউ হাতি মামা’, চীনের ছবি ছাও হুয়া (লিটল ফ্লাওয়ার), ভারতীয় বাংলা ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’, ইত্যাদি। ছবির জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। চিত্রপরিচালকরা ভাবতে লাগলেন, এই রকম আন্তর্জাতিক মানের ছবি আমাদেরকেও বানাতে হবে। রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল, খ্যাতিমান সব চিত্রপরিচালকদের মধ্যে। হঠাৎ করে কি হল, ৮২-৮৩-র পর বাংলা সিনেমার মান একেবারেই নীচে নেমে গেল। কি সব অশালীনতা ঢুকে গেল, আমাদের সিনেমায়। তারপর পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মত ছবি রইল না। হলগুলো অশিক্ষিত নিম্নশ্রেণীর লোকদের সস্তা বিনোদনের জায়গা হলো। হতাশ হয়ে পড়লেন, তুখোড় আর্ট ফিল্মের নির্মাতারা। চিত্রপরিচালক আমজাদ হোসেনের নিজের মুখ থেকে শুনেছি, “বাবা, কি জমানা আসলো, আমাদের মত ডায়েরেক্টররা ভাত পায়না”!
চারিদিকে তখন হিন্দি ছবির জয়জয়কার। সবাই ঘরে বসে হিন্দি ছবি দেখে। ঘরে ঘরে, এখানে-সেখানে সেই হিন্দি ছবিরই আলাপ। সিনে পত্রিকাগুলোতেও, হিন্দি ছবি বিষয়ক আলোচনা ঠাই করে নিল। তার পাশাপাশি রয়েছে হিন্দি ছবির নায়িকাদের অর্ধনগ্ন ছবি।
ঃ কেয়ামত সে কেয়ামত তাক-এ একদম নতুন নায়ক-নায়িকা।
শিমুল বলল।
ঃ হ্যাঁ। খুব সুন্দর দুজনেই।
ঃ ভালোবাসার ছবি। কি যে হৃদয় কেড়ে নেয়!
আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলল শিমুল।
হৃদয়ের কথা যখন উঠল, আমি শীমুলের দিকে তাকালাম। ও কি আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে? মেয়েটি সুন্দরী, আকর্ষণীয়া। কারো না কারো হৃদয়, হয়তো একদিন কেড়ে নেবে। ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, পাশে বসতে আরো বেশি ভালো লাগে। কিন্তু আমার মনে এখনো গভীর কোন দাগ ও কাটতে পারেনি। সেই দাগ ও কাটবে কি? আমার হঠাৎ লাবনীর কথা মনে পড়ল।
(মন কিযে চায় বলো
যারে দেখি লাগে ভাল
এ মন সেতো বাধা পড়ে না
কিযেনো কেন জানি না
কাছে এসে পাশে বসে কথা বলে যে
এমন বলে সে আমায় ভালবেসেছে
চোখে চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে
বোঝাতে পারিনি তারে ভালবেসেছি
কি করে যায় সে বলা
আমি আজও শিখিনি
মন কিযে চায় বলো
যারে দেখি লাগে ভাল
এ মন সেতো বাধা পড়ে না
কিযেনো কেন জানি না
প্রেম ভরা মন নিয়ে চলেছি একা
ভাবি শুধু কবে পাব তার দেখা
কথা আছে জীবনে প্রেম আসে একবার
আমার জীবনে সে আসবে কবে আর
জীবনে প্রেম হবে কিনা
আমি তাও জানি না
মন কিযে চায় বলো
যারে দেখি লাগে ভাল
এ মন সেতো বাধা পড়ে না
কিযেনো কেন জানি না।)
– সেই সময়কার একটি জনপ্রিয় বাংলা গান

লিস্ট্নিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ – পর্ব ৫
আমার এক চাচাতো বোন আছে , ওর নাম লাবনী। চাচা আব্বার ছোট ভাই। খুব ধনী এবং খুব তিরিক্ষি মেজাজের মানুষ। আব্বা শান্তশিষ্ট মানুষ, তিরিক্ষি মেজাজের মানুষের সাথে তার বনিবনা হয়না। তাই চাচার সাথে তার সদ্ভাব নাই। আসলে আব্বা চাচাকে খুব ভালোবাসেন, বলেন, “ছোট্ট ভাইটাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, কিন্তু ওর ঐ তিরিক্ষি মেজাজের কারণেই ওর সাথে ডিসটেন্স মেইনটেইন করতে হয়।” চাচার দুই মেয়ের মধ্যে ছোটটি লাবনী। আমার চাইতে তিন বৎসরের ছোট। ওর সাথে আমার একটা মধুর সম্পর্ক আছে। এটাকে কি প্রেম বলব? জানিনা। মুখ ফুটে তো কখনো কেউ কাউকে কিছু বলিনি। কথা যা হয়েছে সব তো চোখের ভাষাতেই হয়েছে। কথা বলাবলির খুব বেশী সুযোগ আমরা পাইওনি, এই জীবনে। আব্বা-চাচার বনিবনা না থাকায় ওদের বাড়িতে আমার বা আমাদের বাড়ীতে ওর যাওয়া আসা হয়না। ওর সাথে আমার দেখা হতো আমাদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের বাসায়। সেও কালে ভদ্রে, ঈদ বা শবেবরাত এই জাতীয় দিনগুলোতে। তাও গত ঈদে দেখাই হয়নি। আমি যদিও উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেছিলাম।
তার আগের ঈদে ওকে দেখেছিলাম। ওর পড়নে ছিল বেগুনী রঙের সালোয়ার-কামিজ আর ঝালর লাগালো ক্রিম কালারের একটি ওড়না। ফর্সা রঙের লাবনীর গায়ের উপর এই পোষাকটি চমৎকার মানিয়েছিল। সুন্দর চপল দৃষ্টি, গভীর কালি চোখের অতল থেকে খুশির আভা বেরিয়ে আসছে। অমন ধারা চোখ যে কোন তরুণেরই মন মাতায়। এলোমেলো উড়ন্ত চুল, তার স্পনদিত দেহ যেন ফুলের পাঁপড়িতে আন্দোলন। হাতের আঙুলগুলো চাঁপা বর্ণের। ও যখন কথা বলে মনে হয় যেন সুরের মূর্ছনা উঠছে। লাবনীর মধুমিত লাবন্যিত মুখচ্ছবি বড় বেশী প্রীতিমাধুর্যপূর্ণ। বেশী লম্বা নয় তবে খাটোও নয়। বাঙালী মেয়ে হিসাবে পর্যাপ্ত উচ্চতার। দেহের বর্ণনা দিতে পারব না, কারণ ঐ কাঁচা বয়সে মেয়েদের দেহের বাঁকগুলোর দিকে নজর যেতনা, বিশেষতঃ যাকে মনে ধরেছে।
কোন একটা বইয়ে পড়েছিলাম, ফ্রান্সে প্রেম মানে হাস্যরসের বিষয়। ইল্যাংন্ডে প্রেম খুব সিরিয়াস ব্যাপার। আর আমাদের উপমহাদেশে প্রেম একটা ভয়ের ব্যাপার। প্রেমিক-প্রেমিকা সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে, যদি কেউ দেখে ফেলে, যদি কেউ জেনে যায়! আমিও তাই লাবনীর ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতাম।
কিশোর বয়েসে আমি একটা পেইন্টিং দেখেছিলাম – একটি যুগল সমুদ্র সৈকতে হেটে বেড়াচ্ছে। সেই চিরন্তন নারী ও পুরুষ। নারীটির পড়নে চমৎকার একটি নীল শাড়ী। নীল সাগরের তীরে নীল শাড়ী পড়া রমনীটিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন সাগরের নীল আর শাড়ীর নীল মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম যে, আমার প্রিয়তমাও এমনি নীল শাড়ি পড়ে আমার হাত ধরে নীল সাগরের তীরে হেটে বেড়াচ্ছে।
বিকাল বেলাটায় মাঝে মাঝে ছাদে বসে সময় কাটাতাম। আমাদের ছয়তলা ভবনের ছাদ থেকে আশেপাশের দৃশ্য ভালোই লাগত। উপর থেকে পৃথিবীটাকে খুব সুন্দর মনে হয়। সামান্য দূরে প্রকান্ড একটা উঁচুতলা বিল্ডিং নজরে পড়ত। ভালো করে নজর দিয়ে দেখেছি, ওখানে বিদেশীরা থাকে। বিল্ডিংটা খুব সুন্দর, প্রতিটি ফ্লোরে কয়েকটি করে এ্যপার্টমেন্ট। দূর থেকে ভালো দেখা না গেলেও মোটামুটি বোঝা যেত যে, সেই এ্যপার্টমেন্টগুলো খুব পরিপাটি। বিল্ডিংটার সামনে একটা সুইমিং পুল আছে। বড় আপাকে বললাম বিল্ডিংটার কথা। আপা বললেন ওটা ‘রাশান ট্রেড হাউস’। ও আচ্ছা, তাহলে ওরা রাশান। আমরা সাদা চামড়া দেখলে ইউজুয়ালী আমেরিকান বা বৃটিশ মনে করতাম। আসলে তো পুরো ইউরোপের মানুষই শ্বেতাঙ্গ।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে দিয়ে ছুটির সময়টায় যাইনা। আগেই বলেছি বখাটেরা ঐ সময় স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাকে ওখানে দেখলেই লোকে ভাববে, মেয়েদের দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। একদিন মা বললেন
ঃ যা, বার্গার কিনে নিয়ে আয়। বিকেলের নাস্তায় খাব।
বার্গার কাছেপিঠে পাওয়া যায় বেইলী রোডে। ওখানে যেতে হলে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে দিয়েই যেতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এখন স্কুল ছুটির সময়। তাছাড়া ঐ সময়টায় ঐ রাস্টায় প্রচন্ড জ্যাম হয়। গাড়ীর প্যাঁ-পুঁ হর্ন আমাদের বাসা থেকেই সোনা যায়। মিনিট পনের যাবৎ এই হর্ণও শুনতে পাচ্ছিলাম। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ছুটির সময়। এখন ঐ পথ দিয়ে যাওয়া ঠিক হবেনা। মাকে বললাম
ঃ পরে গেলে হয়না?
ঃ পরে আবার কখন? এখনই সময়, যা।
মায়ের আদেশ। কি আর করা? টাকা নিয়ে বের হলাম। পথের মধ্যে গাড়ী, রিকসা, যানবাহনে ভরে বিশাল জ্যাম। পুরণো ঢাকা বাদ দিলে, ঢাকা শহরের অন্যান্য রাস্তা তো একরকম ফাঁকাই থাকে। কিন্তু স্কুল ছুটির সময় এই রাস্তয় আসলে মনে হবে, ঢাকা শহরের সব গাড়ী যেন এই রাস্তাতেই জমে আছে। হাটাও মুশকিল। চিকন ফুটপাত দিয়ে হাটতে লাগলাম। অনেক মেয়ে একা আর অনেক মেয়ে অভিভাবকের সাথে ঐ ফুটপাত দিয়ে হাটছে। দু’একজন আবার আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো, ‘বখাটে নাকি!’ মুখভঙ্গিতে যাথাসম্ভব ভদ্রভাব ফুটিয়ে হাটতে লাগলাম। মাঝে মধ্যে দুএকজনের দিকে যে চোখ যায়নি তা নয়। যাওয়ারই কথা। বয়সের দোষ (অথবা গুন)! হঠাৎ গেটের দিকে চোখ গেল। চমকে উঠলাম! আবার ভালো করে তাকালাম। বুকটা ধুক করে উঠল। লাবনী! হ্যাঁ লাবনীই তো। ও এই স্কুলে পড়ে আমি জানতাম। কিন্তু এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। এবার লাবনীরও চোখ পড়ল আমার দিকে। ওর চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল। একটু সময়ের জন্য আমরা দুজনেই থেমে গেলাম। কিন্তু এভাবে থেমে থাকা তো যাবেনা। আমি সামনের দিকে হাটতে লাগলাম। লাবনীও আড়াআড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলল। সেখানে হয়তো ওদের গাড়ীটা অপেক্ষা করছে। কিছুদূর গিয়ে আমি পিছনে ফিরে তাকালাম। লাবনীও ঘুরে তাকিয়েছে। আমার বুকের ধুকধুকানী আরো বেড়ে গেল। একটা বইয়ে পড়েছিলাম, মেয়েটিকে ভালোবাসেন বুঝবেন কি করে? যদি মেয়েটিকে দেখে আপনার বুক ধুকধুক করে ওঠে, তাহলে বুঝবেন আপনি মেয়েটিকে ভালোবাসেন। তবে কি লাবনীকে আমি ভালোবাসি?
একদিন মা বললেন,
ঃ যা, ইলেকট্রিক বিলটা দিয়ে আয়।
আকাশ থেকে পড়লাম। জীবনে কোনদিন ইলেকট্রিক বিল দেই নাই। কি করে বিল দিতে হয় তাও জানিনা। এগুলো কাজ তো বাবাই করতেন, মাঝে মাঝে মা করতেন। হঠাৎ আমার কাধে চাপানো!
ঃ হা করে দেখছিস কি? যা তাড়াতাড়ি, আগামীকাল লাস্ট ডেট। দেরী হলে পরে জরীমানা দিতে হবে।
ঃ জ্বি, মানে ইলেকট্রিক বিল তো আমি কখনো দেই নাই।
ঃ দিস নাই তাতে কি হয়েছে? এখন দিবি। বড় হয়েছিস কাজ শিখতে হবে না?
ঃ ও আচ্ছা। কি করতে হবে
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম।
ঃ মগবাজার চৌরাস্তার মোড়ে একটা ব্যাংক রয়েছে। ওখানে যাবি।
তারপর মা আমাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন।
আমাদের বাসা থেকে হেটেই মগবাজার চৌরাস্তায় যাওয়া যায়। হাটতে হাটতে চলে গেলাম। রাস্তা পার হওয়ার জন্য একপাশে দাঁড়িয়েছি। উদ্দ্যেশ্য ট্রাফিক সিগনালে লাল বাতি জ্বললে, গাড়ীগুলো যখন জেব্রা ক্রসিংয়ের পিছনে দাঁড়াবে তখন আমি নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হব। লাল বাতি জ্বলার পর মনে হলো গাড়ীগুলো অতি অনিচ্ছা সত্ত্বে থামছে। তাও জেব্রা ক্রসিংয়ের পিছনে নয় উপরে, আবার কোন কোন গাড়ী অনেক সামনে প্রায় মোড়ের উপরে গিয়ে পরছে, ফলে অন্য রাস্তার গাড়ী চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমানে ট্রাফিক পুলিশও নেই। মনে মনে ভাবলাম এমন অবস্থা কেন? একদিকে আমাদের চালকদের সচেতনতা নেই, তাই পথচারী এবং অন্য গাড়ীগুলোর কথা ভাবিনা, আবার সরকারও ঐ কিসিমের, দুইটি প্রধান সড়কের মিলনস্থলে কি কিছু ট্রাফিক পুলিশ বেশী রাখা যায়না? এতে জনগন যেমন উপকৃত হবে, তেমনি কর্মসংস্থানও হবে। একজন ট্রাফিক পুলিশ আমার মনোভাব বুঝতে পেরে, এগিয়ে এসে গাড়ীগুলোকে জেব্রা ক্রসিংয়ের পিছনে থামানোর চেস্টা করলেন। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে, একিয়ে বেকিয়ে রাস্তাটা পার হলাম।
দেশের এই এত বিশৃংখলা, মানুষের ঔদাসিন্য, এইসব দেখেশুনে মাঝে মাঝে রাগে অস্থির হয়ে যাই। কিন্তু এটা ঠিক না। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। আমার কলেজে রাহাত নামে এক জুনিয়র ভাই ছিল। ওকে দেখতাম সব সময় নীরব-নির্লিপ্ত। ওর এই বৈশিষ্ট্যটি সবারই চোখে পড়েছিল। কেমিস্ট্রির বেলাল হোসেন স্যার একবার ওকে জিজ্ঞেস করেই বসলেন, “রাহাত, তোমার এই ব্যাপারটা আমি বুঝিনা। তুমি সব সময়ই এত নির্লিপ্ত কেন? মানুষের মধ্যে উত্তেজনা থাকে, উৎকন্ঠা থাকে, উদ্বেগ থাকে, তোমার মধ্যে যেন এগুলো কিছুই নাই। তোমাকে রাগ করলেও তুমি শান্ত, তোমাকে ধমক দিলেও তুমি শান্ত, যেখানে অন্যেরা উদ্বিগ্ন সেখানেও তুমি চুপচাপ। ব্যাপারটা কি বলতো?” রাহাত মুচকি হেসে বলল, “সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখবেন স্যার।”
ব্যাংকের ভিতরে ঢুকে দেখলাম ইলেকট্রিক বিল দেয়ার লাইনটা মোটামুটি দীর্ঘ। আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময় লেগে যাবে। যাহোক অসীম ধৈর্য নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল। তখন মনে হলো ভালোই হয়েছে, বৃষ্টি পড়ার আগে আগে চলে এসেছি। আর লাইনটা লম্বা হয়েও ভালো হয়েছে। যেভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাতে খুব শীগগিরই থামার সম্ভাবনা নেই। ততক্ষণ এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো। এর মধ্যে লাইনের সামনের দিকে একটা ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। একজন হঠাৎ পাশের সোফা থেকে উঠে লাইনে ঢোকার চেষ্টা করল, তখন আরেকজন বলে উঠল, “আপনে আবার হঠাৎ কই থেইকা আইসা লাইনে ঢোকার চেষ্টা করতাছেন?”
ঃ কই থেইকা আবার কি? আমি তো এইহানেই আছিলাম।
ঃ কোনহানে আছিলেন আপনে?
ঃ এই সোফায় বইয়া আছিলাম।
ঃ ক্যা, বিল দিতে আইয়া সোফায় বইয়া থাকবেন ক্যান? লাইনে খাড়াইবেন।
ঃ আরে, আপনের আগে আইছি আমি। ঐ উনারে কইয়া, সোফায় গিয়া বইয়া আছিলাম।
ঃ আমরা, লাইনে খাড়াইয়া মরি, আর আপনে সোফায় বইয়া আরাম করেন!
ঃ আরে আমি কি, বাড়ীত যাইয়া ঘুমাইছি নাকি? আমি তো ব্যাংকের মধ্যেই আছিলাম।
ঝগড়া দেখতে মজাই লাগছিল। আবার ভাবছিলাম, আমাদের কালচার এত নীচু কেন? আমরা কি একে অপরের প্রতি সামান্যটুকুও সহনশীল হতে পারিনা?
হঠাৎ স্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা ম্যানেজারের রূমটার দিকে নজর গেল। চাচা ঢুকেছেন ম্যানেজারের রূমে। ধনী ব্যক্তি, তাঁর হাটার চালেই অহংবোধ লক্ষ্যণীয়। ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালেন। চাচা একটি সোফায় বসলেন। চাচার পিঠটা ছিল আমার দিকে, তাই আমাকে দেখতে পাননি। এবার আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। লাবনীদের দামী টয়োটা গাড়িটা চোখে পড়ল। এখন স্কুলে ভ্যাকেশন চলছে। ঐ গাড়ীতে লাবনীর থাকাটা বিচিত্র কিছু না। বুকটা ধুক করে উঠল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, লাবনীর সাথে দেখা করতে হলে, বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ভিজব বৃষ্টিতে। তাও এই সুযোগ হাতছাড়া করব না। চাচা যদি দেখে ফেলে? ভীষণ গোলমাল লেগে যাবে। একটু অবদমিত হলাম। কিন্তু মনকে বোঝাতে পারলাম না। লাবনীর সাথে দেখা করতে হবেই। কোন বাধাই বাধা নয়। বৃষ্টিতে কাকভেজা, চাচার রক্তচক্ষু, সব তুচ্ছ, সব। আমার পিছনের লোকটিকে বললাম, “আমার জায়গাটা একটু দেখবেন দয়া করে, আমি এই আসছি।” বলে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে গেলাম লাবণীদের গাড়ীটার দিকে। সাহস করে গাড়িটার দরজা টান দিয়ে খুলে ফেললাম। যা ভেবেছিলাম তাই, ভিতরে লাবণী বসে আছে। আমাকে দেখে বিস্মিত হলো ও, আবার একেবারেই অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়ায় ওর দুচোখে উপচে পড়ল খুশী। বিলাসবহুল গাড়ীর ভিতরে আরামদায়ক আসনে বসে অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে লাবণী, আর প্রবল বর্ষণে ভিজে গাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। টুকটাক দুয়েকটি কথা বললাম আমরা। লাবণী বলল
ঃ তুমি!
ঃ অবাক হয়েছ?
ঃ হ্যাঁ, একটু।
ঃ আমিও। কাকতালীয়ভাবে ঘটে গেল।
ঃ কেমন আছো?
ঃ ভালো। তুমি?
ঃ ভালো।
ঃ স্কুল কেমন চলছে?
ঃ স্কুল তো বন্ধ।
ঃ ও, হ্যাঁ । মাঝে মাঝে তোমাকে দেখিতো, স্কুল ছুটির পরে।
ঃ তুমি সব সময় একটা পকেটে হাত দিয়ে থাক কেন?
ঃ পকেটে হাত দিয়ে থাকি নাকি? খেয়াল করিনি তো। তোমার পছন্দ না হলে আর পকেটে হাত দেবনা।
ঃ না তা বলছিনা। (হেসে ফেলল লাবণী)। তুমি কি করছ এখন?
ঃ এইচ, এস, সি পরীক্ষা শেষ। এখন তো ‘আল বেকার’।
ঃ ‘আল বেকার’ কি?
ঃ মানে কাজ কাম কিছু নাই আরকি। কোচিং করছি।
বাইরে প্রবল বর্ষণ তার মধ্যে খুশী আর লজ্জ্বার মাঝামাঝি আমাদের টুকরো টুকরো কথা। বাইরের মত আমাদের ভিতরেও কি বর্ষণ শুরু হয়েছে? আমাদের টুকটাক কথা দুয়েকটি শব্দ এক একটা টুকরো টুকরো সজল মেঘের মতো।
হঠাৎ খেয়াল হলো চাচার কথা। সহসা শকুণের মত চাচা উড়ে আসলে ভিষণ হইচই শুরু হয়ে যাবে। ছোঁ মেরে আমার কলজেটাও ছিড়ে নিতে পারে। তাড়াতাড়ি কথা বন্ধ করলাম। বললাম,
ঃ যাই। আবার কথা হবে।
ঃ আবার কথা! বিষন্ন হয়ে গেল লাবণীর কন্ঠ। কি জানি কবে হবে।
ঃ আমি তোমাকে টেলিফোন করব।
ঃ নাম্বার জানোতো?
ঃ তা জানি। আমার চাচার নাম্বার আমি জানব না?
ঃ আর চাচা! দুই ভাইয়ে কবে যে মিল হবে!
ঃ ঠিক আছে আমি যাই।
আরেকবার ওর দিকে তাকালাম। লাবণীর মিষ্টহাস্য অপরূপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বড় ভালো লাগছে এই বর্ষণস্নাত আকাশ ও পৃথিবীটাকে। আমি কি পারিনা রূপকথার রাজকুমারের মত ওকে লুফে নিয়ে নীল আকাশে উধাও হয়ে যেতে?
ভিজে চুপচুপ হয়ে ব্যাংকে ঢুকলাম। লোকজন আমার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালো । তারা তো জানেনা এই বৃষ্টিতে ভিজে আমি যে কত অপার আনন্দ লাভ করেছি।
বাড়ী ফিরে ভাবলাম, ওকে টেলিফোন করব। টেলিফোন সেটটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলাম। কি বলব ওকে আমি? ঐ একটি কথা যার সঠিকতা সম্পর্কে আমি নিজেই সন্দিহান। সেটা বলব কি?
(দুঃসাহসে বুক বেধে হিমশৃঙ্গে আরোহন করতে পারি,
যদি বল কন্টকাকীর্ণ ফুলও আনতে পারি,
কিন্তু বুকে পাথর বেঁধেও কোনদিন সরাসরি বলতে পারব না, “ভালোবাসি”।

লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ – পর্ব ৬
গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে একটা ফোন এল।রিসিভার তুলতে ওপাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠ ভেসে এলো –
ঃ এখানে শিউলি আছে?
ঃ শিউলী? কি করেন তিনি? (আমি অবাক হয়ে বললাম)
ঃ আমার নাম পারভীন, আমরা একসাথে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি।
ঃ আপনি কত নাম্বারে রিং করেছেন?
ঃ ৪০৫৭০৪
ঃ হ্যাঁ, নাম্বার তো ঠিকই আছে, কিন্তু এ নামে তো এখানে কেউ থাকেনা।
ঃ তাহলে কি ও আমাকে ভুল নাম্বার দিল!
ঃ হতে পারে।
ঃ কাল গিয়ে ওকে ধরব। কি করেন আপনি?
ঃ আমি আপনার ছোট। এবার এইচ, এস, সি, পরীক্ষা দিয়েছি।
ঃ হ্যাঁ, গলার ভয়েস শুনে বুঝতে পারছি। কোন কলেজ থেকে?
আমি কলেজের নামটা বললাম।
ঃ ভালো ছাত্র নিশ্চয়ই?
ঃ না, তেমন ভালো ছাত্র নয়।
ঃ আপনার নাম?
ঃ রোমান।
ঃ আচ্ছা রাখি তাহলে।
আমার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেল। বললাম
ঃ আপনার ফোন নাম্বার কত?
ঃ আমার? উঁ, আচ্ছা থাক, আমিই আপনাকে ফোন করব। কখন থাকেন আপনি?
ঃ আমাকে সকালে ও রাত্রে পাবেন।
ঃ আচ্ছা রাখি।
ফোনটা রেখে ভাবছিলাম মেয়েটা কে? কেন ফোন করেছিল? মেয়েটা কি আমাকে চেনে? আমাদের আশেপাশেই থাকে? নাকি কোচিং-এর কেউ? শিমুলকে তো ফোন নাম্বার দেইনি। অবশ্য দিলেও কিছু আসতো যেতো না। কিন্তু ও চায়নি তো? অবশ্য ফোন নাম্বার যোগার করাটা ব্যাপার না। কোচিং-য়ের অফিস থেকেই যোগার করা যায়। আমার বন্ধুদের কারো কাছ থেকেও নেয়া যায়। অতশত ভাবছিই বা কেন? মেয়েটার কন্ঠস্বর শিমুলের কন্ঠস্বরের মত মোটেও না। তাহলে? কে ও? নাহ্, আমি হয়তো ফ্যন্টাসি খুব বেশী করে ফেলছি। এমন হতে পারে ও আমাকে চেনেই না সত্যিই সে ভুল করেছে। তাহলে আবার ফোন করতে চাইল কেন? আজকাল এসব হয়। আমাকে সিনিয়ররা বলেছে। ছেলেমেয়েরা টেলিফোনে প্রেম করে। আমাদের সমাজ খুব বেশী রক্ষণশীল। তাই নারী-পুরুষ সম্পর্কে স্বাভাবিকতা নাই। ইয়াং বয়সের ছেলেমেয়েরা পরস্পরের সান্নিধ্যে আসতে চায়। কিন্তু সামাজিক বাধার কারণে এটা খুব কঠিন। মেয়েদের জন্য আরো বেশী। ছেলেরা যাও একটু গাঁ বাঁচিয়ে চলতে পারে। কিন্তু মেয়েদের বড় সমস্যা, একবার দুর্নাম হলে আর রক্ষা নেই। একদিকে তারুণ্যের চাহিদা, আরেকদিকে সমাজের রক্তচক্ষু, একেবারে শাঁখের করাত। তাই অনেকের কাছেই একমাত্র উপায় ঐ টেলিফোনটি। অনেক মেয়েই তাই মানসিক চাহিদা মেটাতে, টেলিফোনে কোন বন্ধু খুঁজে ফেরে। মনের মতো কাউকে খুঁজে পেলে টেলিফোনেই চলে প্রেমালাপ। কখনো কখনো সেটা সেক্স টকেও পরিণত হয়। আবার কখনো শালীণতার মধ্যেই থাকে। এভাবে অন্তত কিছুটা হলেও মনের ক্ষুধা মেটে।
রাতে একটি খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম। অপার নীল আকাশের নীচে, সবুজ টিলাময় একটি বিস্তির্ণ প্রান্তর, চারপাশে কোন ঘরবাড়ি নেই প্রকৃতির অপরূপ রূপ একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। মায়ের নীচের মাটি ঢাকা পড়েছে ঘন তৃণদলে, আর এখানকার তৃণতরু এত সজল ও সবুজ যা সচরাচর চোখে পড়েনা। বিকেলের উষ্ণ রোদে শ্যামল উপত্যকা জুড়ে ফুটে থাকা ছোট ছোট ঘাসফুলগুলো কি মায়াই না রচনা করেছে। দূরে কোথাও উঁকি দিচ্ছে একঝাক সূর্যমুখী। চকিতে ছুটে গেল একটি চিত্রা হরিণ, কোন এক গাছের আড়াল থেকে বিরামহীন মধুর সুর মৃদুমন্দ বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছিল একটি মায়াবী কোকিল । সেই মায়াময় পরিবেশে সহসা আবির্ভুত হলো একটি রুপকথার রাজকন্যার মত অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ে। মধুর মিষ্টি মুখ, কাধ পর্যন্ত নেমে আসা কোঁকড়ানো চুল, ভ্রুর নীচে পাখীর নীড়ের মত দুটো চোখ, অপরূপ রূপতনু! এই সব কিছু দেখে শিরায় শিরায় রক্ত ছলকে উঠল। ফুলকে ফুল বলতে দ্বিধা কোথায়? বললাম, পাহাড়ী গোলাপ, তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে আঁকা? মেয়েটি অনুরাগে ব্লাশ শুরু করল। আমি ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম, আমার হাতের পাঁচটি আঙুলের অগ্রভাগ ওর ঐ অপূর্ব মুখশ্রীর সাত রঙের স্পর্শ চায়।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অস্বস্তিকর কিছু একটা ঘটছে। চকিতেই বুঝতে পারলাম, আমার খাটটা দুলছে। ভূমিকম্প! হ্যাঁ, ভূমিকম্পই তো! টলমল করে উঠল আমার আত্মা। ধরফর করে উঠে বসলাম। দৌড়ে এলেন মা। “রোমান, রোমান, ভূমিকম্প!” মাকে অত উত্তেজিত মনে না হলেও, আশংকার ছায়া পড়েছে মুখে। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। দৌড় দেব? কোথায় দৌড় দেব? হাউজিং-এ সামনে কিছু ফাঁকা জায়গা আছে। ওখানে যাওয়া যায়। কিন্তু চারপাশে উঁচু উঁচু ছয়তলা দালান। ভাঙলে সব মাথার উপরেই পড়বে। আরেকটু সামনে রাস্তায় গেলে রক্ষা হতে পারে। ভিকারুন নিসা স্কুলের মাঠ আছে। খুব সকাল, ভোর ছয়টা হতে পারে। বাবা বাড়িতে নেই, পার্কে হাটতে গিয়েছেন। বড় আপা, ছোট আপা বাড়ীতে, কাজের মেয়েটিও আছে। সবাইকে নিয়ে দৌড়ে বাইরে চলে যাব কি? এই সব ভাবতে ভাবতেই দুলুনি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মনের আশংকা দূর হয়নি। ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল। দিনটা ছিল ৬ই আগষ্ট, ১৯৮৮। এরপর কয়েকদিন মানুষের মুখে মুখে ছিল ভুমিকম্পের কথা।
আমার ভাগ্নে জাহিদ বলল, “আমি ঘর থেকে বের হওয়ার কথা ভাবিইনি, রাজারবাগের এই গলির মধ্যে কোথায় বের হবো? বের হয়েও কোন লাভ নেই। তাই ঘরেই ছিলাম, রাস্তায় না মরে ঘরেই মরা ভালো।
আমার ফুপাতো বোনের হাসবেন্ড দুলাভাই (বয়সে মুরুব্বী বাবার মতই বয়স) বললেন।
ঃ দেখতো রোমান যদি বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেত, তাহলে কারা বাঁচতো?
ঃ জ্বী কারো তো বাঁচার কথা নয় ঘরবাড়ী ভাঙলে তো সবাইই মারা যাবে।
ঃ না না, তোমার বাবার মত, আমার মতো অনেকেই সেদিন মর্নিং ওয়াক করতে বেড়িয়েছিল। তারা তো বেঁচে যেতেন।
মুরুব্বী মানুষ, উনার সাথে তর্ক করা ঠিক নয়। উনার মন রাখার জন্য বললাম
ঃ জ্বী ঠিক বলেছেন।
ঃ সুতরাং এখান থেকে শিক্ষণীয় হলো এই যে, খুব ভোরে উঠে মর্নিং ওয়াক করা উচিৎ।
পুরান আমলের মানুষ, সব কিছুর মধ্যেই শিক্ষণীয় কি আছে খোঁজে। আমি কোন তর্ক-বিতর্কে না গিয়ে আবারো মাথা নেড়ে সায় জানালাম।
কিন্তু আপা (উনার স্ত্রী) ছাড়লেন না। বললেন
ঃ ব্যাডায় বাইচ্চা থাকলে হইবে কি? ব্যাডার বউ পোলাপান সব মরবে!
দুলাভাইও নাছোড়বান্দা, বললেন
ঃ তারপরেও একটা পরিবারের সবাই মরে যাওয়ার চাইতে কেউ কেউ বেঁচে থাকা ভালো।
আমার মনে পড়ল কলেজে থাকাকালীন দুইটি ভুমিকম্পের কথা।প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে কয়েকদিন যাবৎ দিনের বেলায় শিয়াল ডাকছিল। রাতে শিয়ালের ডাক শুনে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু দিনের বেলায় শিয়ালের ডাক! অবাক হলাম। আমাদের ক্লাসের ইকরাম বলল
ঃ ভুমিকম্প হবে।
বুকটা ছাৎ করে উঠল। ওর কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম। এটা সংস্কার – মানুষের হাজার বছরের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণের ফলাফল। কিন্তু ঐ কথা মন মানতে চাইছিল না। সংস্কারকে কুসংস্কার মনে করতে চাইছিলাম। কিন্তু দুয়েক দিন পর ঘটনাটি ঠিকই ঘটল।রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে, যখন সবাই ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এসময় হঠাৎ দালান কোঠা দুলে উঠল। পড়িমরি করে ছুট লাগালো সবাই। যে যেদিক দিয়ে পারে। যারা একতলায় ছিল তারা চট জলদি পাশের মাঠে নেমে গেল। আর যারা দোতলা তিনতলায় ছিল তারা বিশাল ছাত্রাবাসের তিনটি সিঁড়ি দিয়ে, লাফিয়ে ঝাপিয়ে যে যেভাবে পারে নামতে শুরু করল। কয়েক মিনিটের জন্য কারো হুঁশ বলতে কিছু ছিলনা।
দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ১৯৮৮ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী। আমার জীবনের ইতিহাসে এটাই সব চাইতে বড় ভূমিকম্প। এটি ছিল ১৯৮৬-র ভূমিকম্পের দ্বিগুন। এবারও আগের মতই দিনের বেলায় শিয়াল ডেকেছিল। পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে, কয়েকদিন যাবৎ আমাদের হৃদয়ও দুরু দুরু করছিল। এদিকে বেগ একটা কি সিনেমা দেখে এসে গল্প জুড়ে দিয়েছিল, নস্ট্রাডেমাস নামে এক জ্যোতিষী ছিল। দুনিয়ার সব চাইতে বড় জ্যোতিষী সে। পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে নানা ভবিষ্যদ্বানী করেছে কয়েক শত বছর আগেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলেছে, বলেছে হিটলারের কথা। সবই মিলে গিয়েছে। এখনও কিছু ভবিষ্যদ্বানী ফলা বাকী আছে, এর মধ্যে একটি হলো ১৯৮৮ সালে একটা বিশাল বড় ভূমিকম্প হবে। সেই ভূমিকম্পে নিউ ইয়র্ক সিটি ধ্বংস হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিকে দিনের বেলায় শিয়ালের ডাক, আরেক দিকে নস্ট্রাডেমাসের কাহিনী সব মিলিয়ে বেশ শংকিতই ছিলাম। সেই বিশাল ভূমিকম্পে নিউ ইয়র্ক না হয়ে আমাদের সিলেটই যদি শেষ হয়ে যায়! ঘটনা সত্যিই ঘটল। আমরা তখন ক্লাসরূমে বসে রাতের পড়ালেখা করছিলাম। এসময় দরজায় এসে দাঁড়ালো আমাদের ক্লাসের সব চাইতে চঞ্চল অথবা দুষ্টু ছেলে মাহবুব। ওকে দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম, এখনই এসে ডিস্টার্ব শুরু করবে। কিন্তু ও কিছুই না করে দরজায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। হঠাৎ শুনি পিছনে দুপদাপ আওয়াজ। চকিতে কিছু বুঝতে পারলাম না। জন্মের পর থেকেই যুদ্ধের গল্প শুনেছি। সবাই পালাচ্ছে কেন! যুদ্ধ লেগে গিয়েছে নাকি! বুঝলাম না। যুদ্ধ লাগলে সবাই জানালা দিয়ে পালাবে। এ যে দেখছি সবাই দরজার দিকে ছুটছে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বুঝতে পারলাম না। সবার দেখাদেখি আমিও ছুটলাম দরজার দিকে। করিডোরে পৌঁছে এহতেশামের উৎকন্ঠিত কন্ঠ শুনলাম, “ভূমিকম্প, ভূমিকম্প!” আমার আত্মা উড়ে গেল। একতলায় ক্লাস রূম, সিঁড়ি ভাঙার ঝামেলা রইল না। করিডোরের কংক্রিটের রেলিং ডিঙিয়ে মাঠে নেমে গেলাম। এই রেলিং লাফ না দিয়ে পার হতে পারার কথা না। কিন্তু সেদিন সেটা ডিঙিয়েই পার হলাম। কিন্তু জীবনের ভয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে যে জায়গায় নামলাম, কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম তার তিন দিক দালান দিয়ে ঘেরা। এই একটি জায়গাই ছিল এরকম বদ্ধ, আর আমরা সেখানেই নামলাম! এখানে বিল্ডিং ভাঙলে আমাদের মাথায়ই পরবে। কিন্তু ঐ মুহূর্তে অন্য কোথাও যাওয়ার সময়ও ছিল না। মনে হচ্ছিল কয়েক সেকেন্ডেই দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। যাহোক কিছুক্ষণ পর ভূমিকম্প শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরে সংবাদ মাধ্যম মারফত জেনেছিলাম সেই ভূমিকম্পের স্থায়িত্বকাল ছিল ৩৮ সেকেন্ড।
মানুষ অথবা যেকোন প্রাণী নিজের প্রাণকে যে কতটা ভালোবাসে তা এ সমস্ত পরিস্থিতিতে বোঝা যায়। আবার মানুষের জান-জীবন, তিল তিল করে গড়ে তোলা ধন-দৌলত, অর্থ-বিত্ত, কীর্তি-খ্যাতি সব কিছু যে এক নিমিষেই ধুলিস্মাৎ হয়ে যেতে পারে এটাও সেই মুহূর্তে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই ভয়াবহতার মধ্যে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, জীবন পদ্মপাতায় শিশির বিন্দু।
আমাদের ক্লাসের ক্লাসের সব চাইতে সাহসী দীর্ঘকায় ও শক্তিশালী বুলবুল একা এক রূমে থাকত। ও আমার রূমে এসে চুপিচুপি বলে, “রোমান আমার খুব ভয় লাগছে. তুই কি একটু আজ রাতে আমার সাথে ঘুমাবি?” “কেন?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। “আমার ভয় লাগছে”, প্রথমে আমি ভাবলাম ফাজলামো করছে। তারপর ওর ভয়ভীতির কথা মুখে শংকার ছাপ দেখে বুঝলাম, ফাজলামো না, সিরিয়াসলিই বলছে। আমি অবাকই হলাম আমার দ্বিগুন সাইজের একজন মানুষ, সাহসী হিসাবে যার খ্যাতি আছে, সেইই ভয়ে এত জড়সড় হয়ে আমার কাছে এসেছে, সাহস পাওয়ার জন্য। মায়াই লাগল। একজন মানুষ যখন বিপদে পড়ে আপনার কাছে আসে এর মানে সে আপনাকে ভরসা করছে। সেই সময় তাকে ফিরিয়ে দেয়া মানুষের কাজ না। আমি ওকে বললাম, “চল তোর রূমে যাই”।
পরদিন সকালে আবারো ফোন এলো। পরিস্থিতি আমার পক্ষে ছিল, বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। বাবা আর বড় আপা অফিসে, ছোট আপা ইউনিভার্সিটিতে, মা কাজের মেয়েটিকে নিয়ে মার্কেটে গি্যেছেন।
ঃ হ্যালো, রোমান আছে?
ঃ বলছি। আপনি কে বলছেন?
ঃ ভয় পেলেন মনে হয়?
ঃ না, চিনতে পেরেছি। আপনি গতকালের উনিতো?
ঃ হ্যাঁ, গতকালের উনিই।
ঃ তারপর বলুন।
ঃ আচ্ছা, আমি না আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি।
ঃ কি রকম?
ঃ বলব না থাক।
ঃ আরে বলুন না, বলে ফেলুন।
ঃ না, আপনি মাইন্ড করবেন।
ঃ না, আমি কখনো মাইন্ড করিনা।
ঃ আমি না মাত্র মেট্রিক দিলাম।
ঃ আচ্ছা, আমিও এরকম একটা সন্দেহ করছিলাম।
ঃ তাই?
ঃ হ্যাঁ, ভাবছিলাম নেক্সট টাইম ফোন করলে ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে এমন একটা প্রশ্ন করব, দেখব আপনি উত্তর দিতে পারেন কিনা।
ঃ ওরে বাবা। জানেন কাল আমার খুব খারাপ লাগছিল। আমি কখনো মিথ্যা বলিনা।
ঃ নামটা কি ঠিক আছে? না ওটাও —-
ঃ না। নামটা ঠিক আছে।
ঃ আচ্ছা আপনার বাবা কি করেন?
ঃ তিনি সাংবাদিক।
ঃ আপনি কোথায় থাকেন?
ঃ ইস্টার্ন হাউজিং, সিদ্ধেশরীতে।
ঃ আপনার বাবা আমাদের কথা শুনছেন না?
ঃ বাবা তো অফিসে।
ঃ ও তাইতো। তাহলে মা, মা কি শুনছেন? না কি উনিও জব করেন।
ঃ মা এক সময় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, পাশাপাশি উনি একজন আর্টিস্ট, ছবি আঁকেন।
ঃ উনি কি আমাদের কথা শুনছেন?
ঃ না, উনি এখন বাসায় নেই। আর শুনলেও অসুবিধা নেই।
ঃ আমি ফোনে আপনাকে চাইলে দেবেন।
ঃ হ্যাঁ, দেবেন।
ঃ কিন্তু আমার মা দারুণ বদমেজাজী।
ঃ আপনারা কি রক্ষণশীল?
ঃ না তা নয়। আসলে আপনি ছেলে তো, তাই বোধহয় অসুবিধা হয়না।
ঃ না, তা বলতে পারব না। আসলে এখন তো বড়ই হয়ে গিয়েছি। আর আমার মা লিবারাল।
ঃ ও! তা কি করছিলেন?
ঃ বই পড়ছিলাম।
ঃ অবসর সময়ে কি শুধু বইই পড়েন?
ঃ বেশীরভাগ সময় তাই করি। আপনি কোন স্কুলে পড়তেন?
ঃ সিদ্ধেশরী।
ঃ এখন কোন কলেজে পড়েন?
ঃ একই কলেজ।
ঃ ও, আচ্ছা রাখি।
ফোনটি রেখে দিলাম। আসলে এত তাড়াতাড়ি রাখার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কেমন যেন সংকোচ হচ্ছিল। মেয়েটিকে চিনিনা, জানিনা ওর সাথে টেলিফোনে দীর্ঘ সময় আলাপ করা কি ঠিক হবে? কি করব বুঝতে পারছি না। আমার জীবনে এই প্রথম এটা ঘটছে।
বিকালের দিকে আমিন, গিয়াস আর মোস্তাহিদ এলো আমাদের বাসায় বেড়াতে। আমিন আর গিয়াস তো ঢাকায়ই থাকে, আগেও কয়েকবার বাসায় এসেছে। মোস্তাহিদকে দেখে অবাক হলাম। ওর বাবা সরকারী চাকরী করেন। বর্তমানে যশোরে পোস্টেড। বললাম,
ঃ কিরে কবে ঢাকা আসলি?
ঃ দিন পনের হয়।
ঃ ও কোথায় আছিস?
ঃ তোর কাছাকাছিই। মগবাজারে।
ঃ বাহ্। কোন আত্মীয়ের বাসায়?
ঃ না।
ঃ আংকেল কি ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে?
ঃ তাও না।
ঃ তাহলে কি? (একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম)
ঃ আরে ওতো নতুন হোস্টেল লাইফ শুরু করেছে। (বলল আমিন)
ঃ নতুন হোস্টেল লাইফ! বুঝলাম না।
ঃ রহস্যময় একটা মুচকি হাসি হাসল সুদর্শন মোস্তাহিদ।
ঃ হেয়ালী করিস না ঠিকমতো বল। (ধমক দিলাম ওকে।)
ঃ আমি কোচিং-এ ভর্তি হয়েছি।
ঃ ও কোচিং-এ। সেতো আমিও ভর্তি হয়েছি। এর সাথে হোস্টেলের সম্পর্ক কি?
ঃ এই কোচিংটার হোস্টেল আছে।
ঃ তাই নাকি? তুই কি ঐ হোস্টেলে উঠেছিস?
ঃ হ্যাঁ।
ঃ বাহ্, বেশ মজা তো। সিলেট ছেড়ে আসার পর থেকে আমার মন খারাপ থাকে। সেখানে বন্ধু-বান্ধব মিলে গল্প-গুজব, দুষ্টামি-বান্দরামি করে কত মজায় ছিলাম না? আর এখানে অভিভাবকের হাতে বন্দি।
ঃ আরে মন খারাপ করিস না। চট করে আমাদের হোস্টেলে চলে আসবি। বেশ আড্ডাবাজি করা যাবে। তোর ভালো লাগবে।
ঃ গুড আইডিয়া! তোর ওখানেই আড্ডাবাজী করব। চিনিয়ে দিস হোস্টেলটা।
ঃ আজই আয়।
ঃ না, আজ থাক। সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আরেকদিন। তুই তো বাসা চিনে গেলি।আমি যেহেতু কাছেই আছি, ঝটপট চলে আসবি।
চার বন্ধুতে ভালো আড্ডাবাজী করলাম সারা বিকেল। আমাদের আমিন আবার কৌতুকের রাজা। সারা দুনিয়ার মজার মজার সব কৌতুক ওর ভান্ডারে আছে। ওকে ধরলাম,
ঃ বল লেটেস্ট কৌতুকটা বল।
ঃ লেটেস্ট কৌতুক? তবে শোন। – একটি প্লেনে উঠেছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, রাশিয়ার গর্বাচভ, পাকিস্তানের জিয়াউল হক আর আমাদের খ্যাতিমান হ, ম, এরশাদ। ওদের সাথে উঠেছে এক বৃদ্ধ আর এক হিপি। হিপি যেমন হয় – ছেড়াভেরা কাপড়-চোপর লম্বা লম্বা চুল, সাথে একটা পিঠে ঝোলানো বিশাল ব্যাগ। প্লেন যখন আকাশে অনেক উপরে, এই সময়ে পাইলট ভয়াবহ ঘোষণা দিল, “ভাইসব, আমাদের প্লেনের চারটি ইন্জিনই বিকল হইয়া গিয়াছে। এখন বাঁচতে হলে আপনাদেরকে প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করতে হবে। কিন্ত ছোটখাট একটা সমস্যা আছে। আপনারা সংখ্যায় ছয়জন, আর প্যারাসুট আছে পাঁচটা। একটা শর্ট। এখন আপনারাই ঠিক করেন কারা প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করবেন আর কে প্লেনে থেকে যাবে। (অন্য কথায়, ঠিক করেন কে মরবে)। এই বলার সাথে সাথে জর্জ বুশ বললেন আমি পৃথিবীর সেরা দেশ ক্যাপিটালিস্ট শিবিরের নেতা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, আমার উপর পুরো ক্যাপিটালিস্ট শিবির নির্ভর করছে, আমাকে বাঁচতেই হবে। এই বলেই কারো তোয়াক্কা না করেই একটা প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করলেন। গর্বাচভ বললেন আমার উপর পরো কম্যুনিষ্ট ওয়ার্লড্ নির্ভরশীল, তার উপরে শুরু করেছি পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাস্তনস্ত নীতি, এইগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে বাঁচতেই হবে। বলেই বুশের মতই কারো তোয়াক্কা না করেই একটা প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করলেন। পাকিস্তানের জিয়াউল হক বলেন ইসলামিক রিপাবলিক মাত্র শুরু করলাম তার উপর মুসলিম পারমানবিক বোমা তৈরীও কমপ্লিট। এখন নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করব, আমার বেঁচে থাকা খুবই জরূরী। বলেই পূর্বের দুজনার মত একটা প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করলেন। এবার আমাদের কবি এরশাদ সাহেবের পালা। তিনি অপরের লেখা স্বরচিত একটি কবিতা পাঠ করলেন – “নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম।” গরীব দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছি তাতে কি হয়েছে? নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে শপথ নিয়েছি তা বাস্তবায়ন করার জন্য আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। তা ছাড়া জন বাঁচালো ফরজও। বলেই তিনিও একটা প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করলেন। বৃদ্ধ আর হিপি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ডকারখানা দেখছিল। এবার বৃদ্ধ বলল, ” বাবা রথি-মহারথিরা তো সব যে যার মত নেমে গেল। বাকী রইলাম আমরা দুজন। প্যারাসুট মাত্র একটা। তা বাবা আমি তো বৃদ্ধ মানুষ। কদিন পর তো এম্নিই মারা যাব, তুমি ইয়াং, তোমার আরো অনেকদিন বাঁচা উচিৎ। তুমি বাবা লাস্ট প্যারাসুটটা নিয়ে জাম্প কর আমি প্লেনে থেকে যাই। হিপি বলল, “না দাদাভাই, আপনাকে প্লেনে থাকতে হবেনা। আমরা দুজনেই প্যারাসুট নিয়ে জাম্প করব, দুজনই বেঁচে যাব। বৃদ্ধ বলে তা কি করে সম্ভব? প্যরাসুটতো আছে মাত্র একটা। হিপি উত্তর দিল, “না, প্যারাসুট দুটা আছে।”
ঃ দ্বিতীয়টা আবার কোথা থেকে এলো?
ঃ আসেনি কোথাও থেকে। এখানেই ছিল।
ঃ বুঝলাম না।
ঃ দাদাভাই, জিয়াউল হক তাড়াহুড়োর মধ্যে ভুল করে প্যারাসুটের বদলে আমার ব্যাগটা নিয়ে লাফ দিয়েছে।
হাঃ, হাঃ, হাঃ – আমরা সবাই কোরাসে হাসলাম।
“সেনাপ্রধান থেকে সি, এম, এল, এ, তারপর সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি। এভাবে ক্ষমতায় আসে জিয়াউল হক। আজ দশ বছর ধরে মার্শাল ল দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে।” বলল গিয়াস।
“একই পথ ধরেছে আমাদের এরশাদ, কবে যে এর শেষ হবে”। বলল মোস্তাহিদ।
“আরে শুনেছিস নাকি, এরশাদ সম্পর্কে একটি বিদেশী পত্রিকায় বেড়িয়েছে, ‘দ্যা রিচেস্ট প্রেসিডেন্ট ফ্রম দ্যা পুওরেস্ট কান্ট্রি’। বলল আমিন। “বলিস কি? এই হতদরিদ্র দেশের রাষ্ট্রপতি, পৃথিবীর সবচাইতে ধনী রাষ্ট্রপতি!” বলল গিয়াস। এবার আমি বললাম এরশাদের এই ধন সম্পদ উপার্জন নিয়ে একটা কৌতুক আছে। সবাই আমার দিকে তাকালো।
“বল বল তাড়াতাড়ি বল।” বলল আমিন।
“ফিলিপাইন সফরে গেল এরশাদ। প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক সেখানকার প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস। এত কিছু দেখে এরশাদ বলল, “ভাই তুমি এতো ধনী হলে কি করে?” মার্কোস বলল রহস্য জানতে চাও? চলো তোমাকে নিয়ে যাই। তারপর এরশাদকে নিয়ে হাজির করল একটি নদীর তীরে। “ঐ দেখো” বলল মার্কোস। “কি দেখব?” এরশাদের প্রশ্ন।
ঃ নদীর উপরের ব্রীজটি (মার্কোসের কথা)
ঃ ব্রীজটা তো কমপ্লিট হয়নি। অর্ধেক মাত্র।
ঃ আরে, এভাবেই তো ধনী হয়েছি।
বুঝে গেল এরশাদ, মার্কোসের রহস্য। কিছুকাল পর মার্কোস এলো বাংলাদেশে। এরশাদের অবস্থা আরো বিশাল। এই দেখে মার্কোসের চোখ তো ছানাবড়া।
ঃ ভাই তুমি এতো ধন০-সম্পদ কি করে করলে? (বলল মার্কোস)
ঃ চল তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।
তারপর মার্কোসকে নিয়ে এরশাদ হাজির করল একটি নদীর তীরে। “ঐ দেখো” বলল এরশাদ। “কি দেখব?” প্রশ্ন মার্কোসের।
ঃ নদীর উপরে (এরশাদ বলল)
ঃ ওখানে তো কিছুই নাই। শুধু নদীর তীরে একটা ভিত্তিপ্রস্তর দেখতে পাচ্ছি।
ঃ আরে এভাবেই তো ধনী হয়েছি।
রহস্যময় হাসি হেসে বলল এরশাদ।
আরেক দফা কোরাসে হাসলাম আমরা।
এবার ইয়াং ছেলেদের স্বভাবসুলভ নারী বিষয়ক আলোচনা শুরু হলো।
ঃ তোদের হাউজিং-এ তো সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে আছে। (বলল আমিন)
ঃ তা আছে। ধনীদের মেয়ে। কিছুটা সুন্দরীতো হবেই।
ঃ ইটিশ-পিটিশ করিস না ওদের সাথে?
ঃ মাত্র তো এলাম। ইটিশ-পিটিশের সময় পেলাম কোথায়?
ঃ তাওতো কথা। যাহোক সুন্দরী মেয়ে অনেক আছে। টাংকি মারার ভালো যায়গা।
ঃ আমাদের হোস্টেলেও আছে। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ তোদের হোস্টেলে আছে মানে! ছেলেমেয়ে একই হোস্টেলে থাকিস নাকি?
ঃ না, মানে হোস্টেলে না। হোস্টেলের সাথে একটা বাসা আছে, সেখানে।
ঃ ও। সে তো পাশের বাসায় কোন না কোন মেয়ে থাকতেই পারে।
ঃ আরে এই মেয়েটি একসেপশনাল।
ঃ কি রকম একসেপশনাল?
ঃ হোস্টেলের ছেলেরা ওর সাথে টাংকিবাজি করে। যেখানে অন্য মেয়েরা লজ্জ্বা পায় বা এড়িয়ে যায়, সেখানে এই মেয়েটি টাংকির উত্তর দেয়।
ঃ এত আবার ভিন্নরকম ঘটনা। যেতে হবে তোদের হোস্টেলে।
(মুছে যাওয়া দিন গুলি আমায় যে পিছু ডাকছে,
স্মৃতি যেন আমারই হৃদয়ের রঙে রঙে ছবি আঁকছে।
সে এক নতুন গানের দেশে, দিন গুলি ছিল যে মূখর কতো গানে,
সেই সুর বাজে যেন আমার কানে!)

লিস্ট্নিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ – পর্ব ৭
কৌতুক বলা হয় হাস্যরসিকতার জন্য। কখনো কখনো তা ব্যবহার করা হয় মিস্রির ছুরি হিসাবে। কিন্তু সেই কৌতুক যখন বাস্তবে পরিণত হয় তখন বিস্মিতই হতে হয়, এবং দু’য়েক সময় খারাপই লাগে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে নিয়ে কয়েকদিন আগে যে কৌতুক করলাম, সেটাই যে বাস্তব হয়ে যাবে ভাবিনি। সকালের দিকে মগবাজার ওয়ারলেস মোড় থেকে মৌচাকের দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তার পাশে একটি দোকানে এক ভদ্রলোকের হাতে একটি ডেইলি নিউজপেপারে বড় বড় করে লেখা দেখলাম, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক নিহত’। আমি অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে ঐ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, “পত্রিকাটি একটু দেখতে পারি? জিয়াউল হক কি সত্যি সত্যিই মারা গেছে?” ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, মনে হলো সে বিস্মিত, মনে মনে হয়তো বলছে, ‘ইনি কি এতক্ষণ পরে জানলেন!’ আমি তাকে বললাম, “আমি সকালে পেপার না পড়েই ঘর থেকে বেরিয়েছি, জিয়াউল হক কিভাবে মারা গেল?” “বিমান দুর্ঘটনায়”, লোকটি উত্তর দিল। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। যেই কৌতুক আমরা উনাকে নিয়ে করলাম, সেটাই বাস্তব হলো!
পরবর্তিতে জানতে পারলাম যে, এক রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন দশ বছর ধরে প্রবল প্রতাপে পাকিস্তান শাসন করা প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। দিনটি ছিল ১৭ই আগস্ট ১৯৮৮ সাল। আমার মনে আছে ১৯৭৭ সালে তিনি প্রধান মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে, সামরিক শাসন জারি করেন। এটি ছিল পাকিস্তানের তৃতীয় সামরিক শাসন। সামরিক শাসন জারির কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয় ভুট্টোর শাসনামলে দেশব্যাপি ব্যপক বিশৃংখলা ও পরিশেষে একজন খ্যাতিমান বিরোধীদলীয় নেতার হত্যাকান্ড (যার সাথে ভুট্টোর জড়িত থাকার অভিযোগ শোনা যায়)। এভাবে অবসান ঘটে ভুট্টোর শাসনামলের, এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর দু’বছরের মত তার বিচার হয়, এবং বিচারের রায়ে তার মৃত্যুদন্ড হয়। সেসময় অনেকেই তাকে মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু জিয়াউল হক কারো কথা শোনেনি। জিয়াউল হক ভুট্টো সম্পর্কে বলেছিল, “বেজন্মাটাকে আমি ঝুলিয়ে ছাড়ব”।
পরিশেষে রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেলে ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল তার ফাঁসি হয়। সেই সময় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলেও আমার মনে হয়েছিল উচিৎ শাস্তি হয়েছে তার। এই সেই ভুট্টো, যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গনহত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিল। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে ঘুমণ্ত নিরস্ত্র মানুষের উপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়া অপারেশন সার্চলাইট থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে পুরো নয় মাস জুড়ে বিপুল হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পক ছিল এই ভুট্টো। এই নারকীয়তার আরেক নায়ক ইয়াহিয়া খানও অনেকগুলো বছর রোগভোগ করার পর মারা যায়। এত এত নিরাপরাধ মানুষ হত্যা করে তারা পার পায়নি। এই পৃথিবীতেই তারা অপকর্মের শাস্তি পেল।
যাহোক জিয়াউল হকের বিমান দুর্ঘটনাটি ছিল রহস্যজনক। সেখানে জিয়ার সাথে আরো ৩১ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল পাকিস্তানের টপ লেভেলের ব্যক্তি । অন্যতম ছিলেন Chairman Joint Chiefs of Staff Committee জেনারেল আখতার আবদুর রহমান । এছাড়া পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লুইস রাফেল ও পাকিস্তানে মার্কিন মিলিটারি এইড মিশনের প্রধান জেনারেল হারবার্ট ওয়াসমও নিহত হয়। জানা যায় যে, একটি সি-১৩০ বিমান উড্ডয়নের পরপরই কন্ট্রোল রূমের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। তার কিছুক্ষণ পরই বিমানটি বিদ্ধস্ত হয়। সিনেট চেয়ারম্যান বৃদ্ধ গোলাম ইসহাক খান জাতীয় প্রচার মাধ্যমে শোক সংবাদটি প্রচার করেন। অনেকে বলে থাকেন এই গোলাম ইসহাক খান-ই ছিলেন জিয়াউল হকের শিক্ষাগুরু। পাকিস্তানকে ভুট্টোর হাত থেকে বাঁচাতে, তিনি এমন একজন জেনারেল খুঁজছিলেন যাকে দিয়ে মার্শাল ল কল করিয়ে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। পরিশেষে তিনি জিয়াউল হককে চুজ করেন এবং তাকে দিয়ে কাজটি করান। এই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় পাকিস্তানের ব্যপক ক্ষতি সাধন হয়। বৃদ্ধ গোলাম ইসহাক খানকেই এই কঠিন সময় মোকাবেলার দায়িত্ব নিতে হয়। রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনাটির পিছনে বৃহৎ শক্তির হাত আছে বলে অনেকেই মনে করেন।কেউ কেউ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করেছে, আবার কেউ কেউ ভারত ও ইসরাইলকে দায়ী করেছে। বোর্ড অফ এনকোয়ারির রিপোর্টে বলা হয়, সম্ভবত বিমানের অভ্যন্তরে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে যাত্রী ও ক্রুদের অচেতন করা হয়, যার কারণে কোন মেডে সিগনালও আসেনি। আবার অনেকে বলে বিমানে শেষ মুহূর্তে তোলা আমের ঝুড়িতে বোমা ছিল, তার এক্সপ্লোশনেই দুর্ঘটনা ঘটে।
জিয়াউল হকের মৃত্যুর জন্য যেই দায়ী থাকুক না কেন। তার শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান নিজেই বলেছেন পাকিস্তান আমেরিকার একটি বিরাট মিত্র। এসময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। আফগান মুজাহিদরা সোভিয়েত বাহিনীর সাথে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল তাতে সর্বান্তকরণ সাহায্য করে জিয়াউল হকের পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উপরন্তু জিয়ার শাসনামলেই পাকিস্তান পারমানবিক শক্তির অধিকারি হয়। এই পারমানবিক শক্তি অর্জনই জিয়ার কাল হয়েছে বলে অনেকে মনে করে। এদিকে জুলফিকার আলি ভুট্টোর কন্যা বেনজির ভুট্টোকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বলা হলে, তিনি বলেন, “দীর্ঘ দশ বছর জিয়া দেশকে গণতন্ত্রহীন করে রেখেছিল, এখন তার অবসান হবে আশা করি। ভাবতেই পারছিনা যে, জিয়ার শাসনামল শেষ হয়েছে। যাহোক হায়াত-মউত উপরওয়ালার হাতে।” বেশ কয়েকদিন বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরল, জিয়াউল হকের মৃত্যু কাহিনী।
সকাল নয়টার দিকে কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললাম। দেখি মোস্তাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে খুশী হয়ে গেলাম, বললাম
ঃ ওয়েল কাম, ওয়েল কাম। ভিতরে আয়।
ঃ না ভিতরে আসব না।
ঃ কেন? (অবাক হলাম)
ঃ তুই আয়।
ঃ কোথায়, আমাদের হোস্টেলে চল। অনেক ছেলেপেলে আছে। আড্ডা জমবে ভালো।
ঃ নট এ ব্যাড আইডিয়া। ঘরে বোরিং লাগছিল। ওখানে অনেক পোলাপান পাওয়া যাবে। চল যাই। ও হ্যাঁ, দাঁড়া আমিনকে ফোন করে দেই ওও চলে আসুক।
ঃ কোথায় আসবে ও?
ঃ মগবাজার মোড় বলে দেব। ওখান থেকে একসাথে যাব।
কাপড় পরে বেরিয়ে পরলাম ওর সাথে।
মগবাজার মোড় থেকে একটু ভিতরের দিকে ওদের হোস্টেলটা। আমার বাসা থেকে হাটা পথে দশ পনের মিনিট। রিকশা নিলে পাঁচ মিনিট। (ভি, আই, পি রোড তখন ছিল একটি, শাহবাগ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। আর সব রাস্তায়ই রিকশা চলত। ঐ রাস্তাটি খুব সম্ভবত: ১৯৮৬ সলে রিকশামুক্ত করা হয়, তখন জনগণ খুব খেপে গিয়েছিল চলাচলে অসুবিধা হয় বলে)। মোস্তাহিদদের হোস্টেলে পৌছে বেশ ভালোই লাগল। এটা মুলত চার তলা একটি রেসিডেন্সিয়াল বাসা। ওরা ভাড়া নিয়ে হোস্টেল বানিয়েছে। প্রত্যেকটা রুমে তিনজন করে স্টুডেন্ট থাকে। মোস্তাহিদদের রূমে ঢুকে দেখলাম আরো দুজন আমাদের বয়সী। মোস্তাহিদ ওদের সাথে সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
ঃ আমার বন্ধু আমিন আর রোমান। আর ওরা কামাল আর ইমতিয়াজ।
ইমতিয়াজ ছেলেটিকে খুব ভদ্র মনে হলো।
ঃ এখানে সবাই কি অন্য শহরের? (আমিন প্রশ্ন করল)।
ঃ আরে ব্যটা অন্য শহরের না হলে কি আর হোস্টেলে থাকে নাকি? (আমি বললাম)।
ঃ আমি ময়মনসিংহের। তবে ঢাকার আশ-পাশ থেকেও দু’একজন আছে। যেমন সাভার, ধামরাই, ইত্যাদি।
ঃ পরিবেশ ভালো তো?
ঃ না, পরিবেশ ভালো আছে। সুপারভাইজার সব সময় নজর রাখে।
ঃ তোমাদের কথা মোস্তাহিদ বলে সব সময়। সিলেটে একসাথে পড়তে। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ হ্যাঁ আমরা খুব ঘনিস্ট। সিলেটের কলেজে বেশ মজার জীবন কাটিয়েছি। কোচিং করছ? কোথায় ভর্তি হতে চাও?
ঃ সব জায়গায়ই পরীক্ষা দেব। তারপর যেখানে চান্স পাই। যেখানে ইচ্ছা সেখানেই পড়তে পারব, বাংলাদেশ কি সেই দেশ!
ঃ তা ঠিক। তারপরেও।
ঃ আমি পড়ালেখা করেছি সাধারণ কলেজে, তোমাদের মত নামীদামী ভালো কলেজে পড়তে পারিনি। তাই ইচ্ছা থাকলেও শেখার সুযোগ ছিল না।
ঃ তোমাকে খুব ভালো এবং ভদ্র মনে হচ্ছে ইমতিয়াজ। উপরওয়ালা তোমার মঙ্গল করবেন। আশা করি ভালো জায়গায় চান্স পেয়ে যাবে।
ঃ না তুমি বেশী বলছ। আরে জিয়াউল হক মারা গিয়েছে শুনেছ?
ঃ হ্যাঁ পেপারে পড়লাম।
ঃ মারল কে?
ঃ কে জানে? রাজনীতি বড় টাফ। আজ বাদশা, কাল ফকির, আজ জীবিত, কাল মৃত।
ঃ আমেরিকা নাকি মেরেছে?
ঃ জিয়াউল হক তো আমেরিকার বড় মিত্র ছিল। তাছাড়া আফগান ওয়ারে তো রাশিয়ার এ্যগেইনস্টে জিয়াউল হক ছিল আমেরিকার কী পার্সন।
ঃ পারমানবিক বোমা একটা কারণ হতে পারে।
ঃ পারমানবিক বোমা কি কারণ হবে?
ঃআমেরিকা কখনোই চায়নি যে একটা মুসলিম রাষ্ট্র পারমানবিক শক্তির অধিকারী হোক।
ঃ মুসলিমদের সাথে আমেরিকার শত্রুতা কিসের?
ঃ জানিনা। তবে তারা মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি চায়না। ইজরাইলের কোন ভূমিকা থাকতে পারে।
ঃ পাকিস্তানের পারমানবিক বোমা আছে এরকম আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা তো হয়নি।
ঃ সেতো ইন্ডিয়াও দেয়নি।
ঃ ইন্ডিয়ারও পারমানবিক বোমা আছে নাকি?
ঃ অবশ্যই আছে। অনেক আগে থেকেই আছে। তারা পারমানবিক বোমা তৈরীর পরিকল্পনা করে অনেক আগেই। তারপর বিভিন্নভাবে টেকনোলজী যোগার করতে শুরু করে।
১৯৪৬ সালের ২৪শে জুন জওহারলাল নেহেরু (ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী) ঘোষনা দেন
As long as the world is constituted as it is, every country will have to devise and use the latest devices for its protection. I have no doubt India will develop her scientific researches and I hope Indian scientists will use the atomic force for constructive purposes. But if India is threatened, she will inevitably try to defend herself by all means at her disposal
১৯৬২ সালের অক্টোবরে চীনের সাথে এক যুদ্ধে ভারত হিমালয়ে তার কিছু টেরিটোরি হারায়। যার ফলে ভারত পারমানবিক অস্ত্র সম্পর্কে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করে।
নেহেরু ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী তা বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। টেকনোলজি তারা বিভিন্ন দেশ থেকে যোগার করে ভারী পানিটি যোগার করে কানাডা থেকে। ১৯৫৫ সালে কানাডা পাবলিকলি এ্যানাউন্স করে যে, তারা একটি হেইভি ওয়াটার রিএ্যাক্টর তৈরীতে ভারতকে সাহায্য করবে। ইন্দিরা গান্ধী কানাডা সরকারকে আশ্বাস দিয়েছিল যে এটা তারা পিস পারপাস-এ ব্যবহার করবে। কিণ্তু তিনি তা করেননি বরং অস্ত্র তৈরীতে ব্যবহার করেন। ফাইনালি ইজরাইলের সহায়তা নিয়ে পারমানবিক অস্ত্র তৈরী সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালের ১৮ই মে রাজস্থানের পোখরানের মরুভূমিতে সেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে টেস্ট করা হয়।
ঃ ইস্রাইল হেল্প করেছে? ইজরাইলের পারমানবিক বোমা আছে নাকি? (বলল আমিন)।
আমি বললাম
ঃ আছে। ১৯৫৬ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করলে। বৃটেন ও ফ্রান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসময় ফ্রান্স ইজরাইলকে মিশর আক্রমন করে সিনাই দখল করে নেয়ার পরামর্শ দেয়, যাতে এই ছলে ফ্রান্স ও বৃটেন মিশরে প্রবেশ করে সুয়েজ খালের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিতে পারে। এর বিনিময়ে ফ্রান্স ইজরাইলকে পারমানবিক রিএ্যক্টর তৈরী করে দেবে। যাতে পরবর্তিতে ইজরায়েল পারমানবিক বোমা বানাতে পারে। ইজরাইল এর গুরুত্ব উপলদ্ধি করে ১৯৫৭ সালে প্যারিসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইজরাইল ১৯৬৩ সালে উইপন টেস্ট করলেও পরিপূর্ণরূপে পারমানবিক শক্তির অধিকারী হয় ১৯৬৭ সালে, ছয়দিন ব্যাপি আরব-ইজরাইল যুদ্ধের পরপরই।
ঃ ইন্ডিয়া বানায়, পাকিস্তান বানালো, আর বাংলাদেশ? কবে পারমানবিক বোমা বানাবে বাংলাদেশ? (বলল কামাল)
সবাই হেসে উঠল।
ঃ ককটেল ককটেল আমরা ককটেল বানাই। (বলল আমিন)
আবারো হাসলাম সবাই। এই হাসতে হাসতে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা কি চিরকাল পিছিয়েই থাকব? শৌর্যে বীর্যে মেরুদন্ড সোজা করে কি আমরা কি কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াবো না? আমাদের জাতীয় কবিই তো লিখেছেন, ‘চির উন্নত মম শীর’।
ঃ পারমানবিক বোমা তৈরী করা ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে হালাল না হারাম? (কামাল প্রশ্ন করল)
ঃ আমার তো মনে হয় হারাম। বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীজি (সঃ) বলেছিলেন – যুদ্ধে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের হত্যা না করতে, নিরীহ পশু হত্যা না করতে এমন কি ফলাদি বৃক্ষও না কাটতে। এর মানে তো ম্যাসিভ ডেসট্রাকশন একেবারেই হারাম। পারমানবিক বোমা তো ম্যাসিভ ডেসট্রাকশনই করে। আর রেডিয়েশন তো খুবই খারাপ জিনিস। এটা মানব জাতির জন্য আশির্বাদ নয়, বরং অভিশাপ।
ঃ অভিশাপ। এই যে শুনি নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন খুবই শক্তিশালী অনেক ইলেকট্রিসিটি প্রোডিউস করে, এগুলো কি তাহলে। ভালো না খারাপ? (বলল কামাল)
ঃ আপাততঃ ভালো মনে হলেও, আলটিমেটলি খারাপ। পদার্থবিজ্ঞানীরা কেবল ফিজিক্স নিয়েই আছে। তারা বায়োলজিতে মোটেও ইন্টারেসটেড নয়। এই পৃথিবীর ফ্লোরা আর ফাউনা নিয়ে তারা ভাবেই না। অথচ রেডিয়েশন ফ্লোরা আর ফাউনার ভীষণ ক্ষতি করে। (আমি বললাম)।
কামাল আর ইমতিয়াজ হা করে আমার পান্ডিত্য কথা শুনছিল। মোস্তাহিদ ওদের বলল,
ঃ অবাক হোসনা। রোমান আমাদের ক্লাসে ফিজিক্স-এর সব চাইতে ভালো ছাত্র। বিশ্বাস স্যারের একান্ত প্রিয়। তাছাড়া এস, এস, সি, তে ও ফিজিক্স-এ বোর্ড হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছিল। আমাদের ফার্স্ট বয়ও ওর কাছ থেকে ফিজিক্স বুঝে নেয়।
ঃ তাই বল। তা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কি ফিজিক্স নিয়েই পড়বে নাকি?
ঃ ইচ্ছা তো সেরকমই আছে। দেখি এখন চান্স পাই কিনা!
ঃ ঢাকা ইউনিভার্সিটি? ভালো মনে করেছিস, চল যাই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ঘুরে আসি। (মোস্তাহিদ বলল)
ঃ কি করবি ওখানে গিয়ে? (বলল আমিন)
ঃ আরে ঘরে বসে বোর হয়ে গেছি। চল ঘুরে আসি।
ঃ ঘোরার তো আরো যায়গা আছে, পার্টিকুলারলি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই যেতে হবে কেন?
ঃ ভবিষ্যতে যেখানে পড়বি সেখানে যাবিনা?
ঃ হ্যাঁ, ভালো বলেছিস। চল যাই।
ঃ যাব তবে তার আগে একটু দেখতে চাই। (বলল আমিন)
ঃ কি দেখতে চাস? (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ ঐ যে বলেছিলি না। তোদের হোস্টেলের পাশের বাসায় একটা মেয়ে থাকে সবার সাথে টাংকি মারে।
ঃ ও, আচ্ছা। দাড়া দেখি বারান্দায় আছে কিনা মেয়েটা ।
সবাই মিলে উকিঝুঁকি দিলাম।
ঃ না বারান্দা ফাঁকা, কেউ নেই। চল যাই।
একটু হতাশ হলাম আমরা। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য। তারপরের মুহূর্তে হৈচৈ করে সবাই বেরিয়ে পড়লাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
আণবিক আঘাতে,
হিরোসিমা কাঁদে,
বিপন্ন নাগাসাকি,
বিবেকের ডাকে,
এসো একসাথে,
বন্ধ করি বিশ্বে যুদ্ধ।

লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ৮
বাইরে নেমে একটু চিন্তায় পড়লাম, কিভাবে যাব ঢাকা ইউনিভার্সিটি। মোস্তাহিদ বলল
ঃ চল, বাস ধরি।
ঃ এখান থেকে কোন বাস যায়, জানিনা। (আমি বললাম)
ঃ বাহ ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা, ঢাকার খোঁজ রাখেনা।
ঃ আহা ঢাকার খোঁজ তো রাখি, কিন্তু ঢাকার বাসের খোঁজ তো রাখিনা।
ঃ বড়লোক মানুষ, বাসের খোঁজের দরকার কি?
ঃ আরে সেটা কথা না। চলাফেরা তো মেইনলি রিকসায়ই করি। লং ডিসটেন্স হলে আব্বার ভাঙা গাড়ীটা আছেই।
ঃ ভাঙা না বলে পুরাতন বল। তোদের যখন গাড়ী ছিল, তখন তো মানুষের কাছে গাড়ী ছিল স্বপ্নের মত।
ঃ দোস্ত, তখন সততার মূল্য ছিল। সৎ টাকায় গাড়ি কেনা যেত। সম্মানজনক চাকুরী করে লোকে ভালো স্যালারী ড্র করতে পারত।
ঃ হ্যাঁ, শুনেছি বৃটিশ আমলে একজন সরকারী কর্মকর্তা বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। তার কিছু বর্ণনা পেয়েছি, বাংলা সাহিত্যের অনন্যসাধারণ গ্রন্থ যাযাবরের দৃষ্টিপাতে।
ঃ এতো বৃটিশ আমলের কথা। এমনকি পাকিস্তান আমলেও সি, এস, পি, অফিসার, আর্মি অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রথিতযশা সাংবাদিক ইত্যাদি সম্মানী চাকুরীজিবিরা ভালো স্যালারি পেতেন। যা দিয়ে তারা তাদের স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে পারতেন। আর এখন স্যালারির যা অবস্থা, সংসারই চলেনা। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। কে যেন প্রবচন বলেছিল,”বাংলাদেশে সরকারী কর্মকর্তার বেতন, মেয়েদের মীনস্ পিরিয়ডের সাথে তুলনীয়, উভয় ক্ষেত্রেই একমাস অপেক্ষা করতে হয় এবং আসার পর চারদিনেই শেষ হয়ে যায়।”
হা হা হা!!! সবাই কোরাসে হাসলো ।
ঃ তারপরেও তো দেখি, ঢাকার রাস্তায় দামী দামী গাড়ির চলাচল শুরু হয়ে গি্যেছে। ঐ যে জীপের মত গাড়ীগুলো পাজেরো নাম। দিনদিনতো কেবল বাড়ছেই। কোথায় পায় এত এত টাকা?
ঃ এরশাদ শাসনামল দোস্ত। দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে দেশ। সৎ ভালো মানুষদের করুণ অবস্থা আর দুর্নিতীবাজরা পাজেরো জীপ হাকিয়ে বেড়াচ্ছে।
ঃ হ্যারে, গত ছয় বছর ধরে তো এই চিত্রই দেখছি। ঐদিন আমাকে এক দোকানদার ঠকানোর চেষ্টা করছিল। আমি ধরার পর আমাকে বলে, “আরে মন্ত্রী-মিনিষ্টাররাই চুরি করে, আমি আর ভালো থাইকা কি করমু?”।
ঃ মাছের একটা মড়ক শুরু হয়েছে। প্রথমে রোগটা হয় মাথায়, তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। আমাদের দেশের এখন হয়েছে ঐ অবস্থা।
ঃ কে এই এরশাদ?
ঃ তুই যতটুকু জানিস, আমিও ততটুকুই জানি। ১৯৮২ সালে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসে। সেনাপ্রধান হিসাবে সরাসরি সামরিক শাসন জারি করে। এর কিছুকাল পরে একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি হয়। এখনো ক্ষমতায় আছে।
ঃ এর বেশি কিছু জানা প্রয়োজন। তার অতীত, পেশাগত জীবনের কার্যক্রম, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, ইত্যাদি। আচ্ছা এরশাদ কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল?
ঃ যতদূর জানি, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেনাই। ৭১-এর বিজয়ের পর যে সকল সেনা কর্মকর্তারা পাকিস্তান থেকে ফেরত এসেছিল এরশাদ তাদের একজন। যতদূর জানি তাদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট । শুনেছিলাম, কি কারণে যেন, তার চাকরীও খোয়া গিয়েছিল, পরে তার মামা রাজনীতিবিদ এম, কোরবান আলীকে ধরে চাকরী ফেরত পায়।
ঃ তাই নাকি? এম, কোরবান আলী তো এখন মন্ত্রী।
ঃ আচ্ছা তাকে সরানোর জন্য তো অনেক আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু কাজ তো কিছু হচ্ছেনা। আমরাও তো অনেক মিছিল মিটিং করলাম। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর দেশের মানুষ মনে করেছিল, কঠোর শাসক ক্ষমতায় এসেছে, এবার দেশে শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু কিছুদিন পরে জনগণ বুঝতে পারল যে তারা ভুল বুঝেছে। বাংলাদেশের জনগণ আরো একবার প্রতারিত হলো। শৃংখলা তো দূরের কথা বরং দুর্নীতিকে সে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। আমাদের দেশে যেকোন অপশক্তির বিরূদ্ধে একটি কাউন্টার ফোর্স হলো দেশের ছাত্রসমাজ। তারাই প্রথম নড়াচরা শুরু করল এই দুশাসনের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ১৯৮৪ সালে যখন একটি উদ্ভট জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষিত হলো।
ঃ মজিদ খানের শিক্ষানীতি?
ঃ হ্যাঁ। ঐ মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ব্যপক আন্দোলন গড়ে তোলে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৪ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ছাত্রদের মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এরশাদের অনুগত বাহিনী। তাকে এই কাজে সহযোগীতা করেছিল জেনারেল আবদুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উপর আক্রমণ চালায়, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যারা। এমন ঘটনাও আছে যে শিক্ষকদের কক্ষে ঢুকেও লাঠিপেটা করা হয়, শিক্ষক তার আইডি কার্ড দেখানোর পরও লান্ছিত হন। কয়েকজন ছাত্রও নিহত হয়েছিল। এরপর একটা কথা মুখে মুখে ফিরেছিল আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ১৪ই ফেব্রুয়ারী।
ঃ ন্যাক্কারজনক!
ঃ যাহোক। এখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি যাই কিভাবে। এখান থেকে বাস টেম্পো কিছু কি পাওয়া যাবেনা? (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ দোস্ত, এরশাদের আমলে রাস্তা-ঘাট কিছু পাকা হয়েছে, পান্থ পথের মত দু’য়েকটা লিংক রোড হয়েছে একথা সত্য, কিন্তু ট্রান্সপোর্টের যে কোন উন্নতি হয়নি এটা আরো বেশী সত্য।
ঃ আন্ত নগর ট্রেন ব্যবস্থা তো এরশাদের করা।
ঃ হ্যাঁ, এই উদ্যোগটা ভালো। তাছাড়া ঢাকার বাইরে পাকা রাস্তা-ঘাটও অনেক নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু ঢাকার অভ্যন্তরে ট্রান্সপোর্টের কোন উন্নতি হয়নি।
ঃ তাহলে বাস-টাস এগুলো বাদ দেই। রিকসায় উঠে যাই।
ঃ টাকা অনেক লাগবে। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ টাকা রোমান দেবে। ওর কাছে কিছু পাওনা আছে। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ আমার কাছে তোর টাকা পাওনা আছে! আকাশ থেকে পড়লাম আমি।
দুষ্টামির হাসি হাসল মোস্তাহিদ। তুই টিউশানি পেয়েছিস না? তোর ইনকাম তো ভালো। আমাদের কিছু খাওয়াবি না?
ঃ ও আচ্ছা এই কথা।
ঃ টুউশানি কর নাকি। (বলল কামাল)
ঃ হ্যাঁ, শুরু করেছি গতমাস থেকে।
ঃ কাকে পড়াও?
ঃ ভিকারুন নিসা স্কুলের একটি মেয়েকে।
ঃ মেয়েকে, খুব সুন্দরী নাকি? (বলল কামাল)
ঃ দুরো, ক্লাস এইটের মেয়ে। অনেক ছোট।
ঃ ও। হতাশ কন্ঠ কামালের।
রিকসা ঠিক করা হলো। একটিতে উঠল মোস্তাহিদ, কামাল আর আমিন। আরেকটিতে উঠলাম আমি আর ইমতিয়াজ। মগবাজার মোড় থেকে, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের পদ্মার পাশ দিয়ে মিন্টু রোড হয়ে ইউনিভার্সিটি যেতে যেতে কথা হচ্ছিল ইমতিয়াজের সাথে। আমি বললাম
ঃ এই যে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা দেখছ, এখানে থেকেছিলেন কিংবদন্তীর মুষ্টিযোদ্ধা মোহম্মদ আলী।
ঃ তাই নাকি? তুমি দেখেছিলে?
ঃ হ্যাঁ। একবার দেখেছিলাম। ১৯৭৮ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী মুষ্টিযোদ্ধা মোহম্মদ আলী সপরিবারে বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় বিশ্বব্যাপী তার সুনাম, তিন-তিনবার হেভিওয়েট বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হয়ে খ্যাতির তুঙ্গে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের জনগণ তার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা অনুভব করত, তিনি মুসলমান হয়েছিলেন বলে। এসময়, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁকে আমন্ত্রণ জানা বাংলাদেশ সফর করার। তিনি সানন্দে রাজী হন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র, যেটির মাত্র উদ্ভব হয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে। পৃথিবী যাকে ভালো করেই চেনেই না। ১৯৭৪ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিসিন্জারের বক্তব্যে বাংলাদেশ এসেছিল ‘বট্মলেস বাস্কেট’ হিসাবে। এরপর তার পরিচয় একটি হতদরিদ্র রাষ্ট্র হিসাবে। সেই দেশ সফর করতে রাজী হবেন মোহম্মদ আলীর মত জীবন্ত কিংবদন্তি তা কেউ ভাবতেই পারেনি। কিন্তু তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন। তার অনিন্দসুন্দরী স্ত্রী ভেরোনিকাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল।
এয়ারপোর্টে জনতার ঢল নেমেছিল তাঁকে দেখতে ও অভ্যর্থনা জানাতে। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে খোলা জীপে করে যখন তিনি শহরের দিকে যাচ্ছিলেন চারিদিকে শুধু ধ্বনি উঠছিল, ‘ইয়া আলী, ইয়া আলী’। আমেরিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, হতদরিদ্র বুভুক্ষ মানুষের একটি দেশে তার এতটা জনপ্রিয়তা দেখে তিনি নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন। তিন দিন তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। সরকার তাকে আতিথেয়তার সর্বচ্চো করেছিলেন। তাকে কক্সবাজারে এক খন্ড জমিও উপহার দেয়া হয়। পুরো তিন দিন রেডিও-টিভিতে আলীর সম্মানে একটি গান বাজত, পুরোটা মনে নেই, যেটুকু মনে আছে, ‘ … আলী বলে আমি কালো পাহাড়, এসো লড়বে যদি,..।’ আলী যেখানেই যেতেন তার চারদিকে জনতার ঢল নামত। আমরা পুরো পরিবার একদিন গেলাম রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়, যদি উনার দেখা পাই। সেখানে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম। পুলিস বললেন, “জ্বী উনি একটু পরেই আসবেন।” আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “উনাকে দেখা যাবে?”, “জ্বী, আপনারা দাঁড়ান আসলেই দেখতে পাবেন”, সজ্জ্বন পুলিশটিকে বেশ তৃপ্ত মনে হলো এরকম একটা ভালো ডিউটি দিতে পেরে। পুলিশটি আবার বলল, “সকালে আসলে কথাও বলতে পারতেন।” আমরা অবাক হলাম, “কথাও বলা যেত?”, “হ্যাঁ উনি সকালে গেটের সামনে হাটাহাটি করেন, লোকজনের সাথে কথা বলেন”। এবার আমরা সত্যিই বিস্মিত হলাম। খ্যাতির শীর্ষে থাকা মানুষ নানা কারণেই সাধারণ মানুষের সাথে দেখা দিতে চান না, আর মোহম্মদ আলী ভবন ছেড়ে রাস্তায় বেড়িয়ে আসেন, লোকের সাথে কথাবলার জন্য! একটু পরে একটা গাড়ী আসল মুহূর্তে চারদিকে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। পুলিশটি বলল আপনারা একটু সরে দাঁড়ান গাড়ীটি ঢুকতে দিন। গাড়িটা একটু ধীরে ভিতরে প্রবেশ করল। আনন্দ ও বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, ভিতরে বসে আছেন অতি বিনয়ী, কালোপাহাড়, বিশ্বখ্যাত মোহম্মদ আলী। চারিদিকে রব উঠল, ‘ইয়া আলী, ইয়া আলী’। দুয়েকজন ফুল ছুড়ে দিল আলীর গাড়িতে।
(অনেক কাল পরে, আমার এক প্যালেষ্টাইনি বন্ধু বলেছিল যে, সে মোহম্মদ আলীর জীবনির উপরে ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখেছে। সেখানে আলীর বাংলাদেশ সফরেকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সফর শেষ করে তিনি মস্কো সফরে যান। লিওনিদ ব্রেজনেভের সাথে সাক্ষাৎ করান।)
আফ্রিকান-আমেরিকান বংশোদ্ভূত আলীর আসল নাম ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে। তিনি ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্টাকির লুইভিলেতে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা ক্যাসিয়াস পোস্টার লিখতেন। মা ওডিসা ছিলেন গৃহিণী। তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শেতাঙ্গ আমেরিকানদের ক্রীতদাস। চেষ্টা করেও জীবনে সেই দাগ মুছে ফেলতে পারেনি তার পরিবার। ১২ বছর বয়সে মোহম্মদ আলী ও তার বন্ধুরা, সাইকেলে চড়ে গিয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে স্ট্যান্ডে ফিরে মোহম্মদ আলী দেখতে পেলেন তার সাইকেলটি চুরি হয়ে গিয়েছে। ক্রোধে ফেটে পড়েন তিনি। কলাম্বিয়া অডিটোরিয়ামের বেসমেন্টে যান পুলিশ অফিসার জো মার্টিনের কাছে নালিশ জানাতে। এই জো মার্টিন আবার কলাম্বিয়া জিমের বক্সিং কোচও ছিলেন। মোহম্মদ আলী জো মার্টিনকে বলেন, “যে আমার সাইকেল চুরি করেছে, তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।” জো মার্টিন হেসে বলেন, “ফাইট করতে চাইলে, আগে ফাইট শিখতে হবে।” তার কয়েকদিন পরেই জো মার্টিনের জিমে বক্সিং শিখতে শুরু করলেন মোহম্মদ আলী । খুব ভালো ছাত্র ছিলেন আলী। দ্রুত শিখে নিয়েছিলেন মুষ্টিযুদ্ধের নিয়ম-কানুন। ১৯৬০ সালে সামার অলিম্পিকে সোনার মেডেল পান ১৮ বৎসর বয়স্ক মুহম্মদ আলী ।
মোহম্মদ আলী এমন একটা সময়ে জন্মেছিলেন যখন আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য পুরোদমে চলছিল। কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল. নির্যাতিত, অছুত। একবার এক শপে তিনি গি্যেছিলেন জামা কিনতে। একটি জামা পছন্দ হলে তিনি ট্রায়াল দিতে চাইলেন। কিন্তু ম্যানেজার কিছুতেই ট্রায়াল দিতে দেবেনা। একজন আলীকে চিনতে পেরে তার পরিচয় দিয়ে বলল, “ইনি বক্সার ১৯৬০ সালে সামার অলিম্পিকে সোনার মেডেল পেয়েছেন, আমেরিকার মুখ উজ্জ্বল করেছেন।” কিন্তু ম্যানেজার বলল, “তাতেও কাজ হবেনা। কোন নিগ্রোর চামড়ায় ঐ জামা লাগলে আর কোন শ্বেতাঙ্গ সেটা কিনতে চাইবে না।” এই বৈরী সামাজিক আবহাওয়ার মধ্যে থেকে তিনি যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ করেন, অপরাপর মুষ্টিযোদ্ধাদের সাথে রিং-এ, এবং বর্ণবৈষম্যের মত সামাজিক কুপ্রথার সাথে সমাজে। আমেরিকায় প্রয়োজনের সময় প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনো নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেবার বিধান আছে- ‘ড্রাফট/ড্রাফটিং’ নামে যা পরিচিত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ড্রাফটিং পুরোমাত্রায় চালু ছিলো। মুষ্টিযোদ্ধা মোহম্মদ আলী ড্রাফটে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেছিলেন, “কোন ভিয়েতনামি কং আমাকে কখনোই নিগার বলেনি, কিন্তু আমার স্বদেশী শ্বেতাঙ্গ ভাইয়েরা আমাকে এই কথাটি বলেছে বহুবার”। ড্রাফটে যেতে অস্বীকার করার অপরাধে তাঁর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এই সব কিছুর সাথে সংগ্রাম করে তিনি শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করেছিলেন।
ঃ আচ্ছা মোহম্মদ আলী তো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাই না?
ঃ হ্যাঁ, ১৯৬৪ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী মোহম্মদ আলী বক্সিং করেন শক্তিমান সনি লিস্টনের সাথে। সনি লিস্টন ঘোষণা দিয়েছিল যে, খুব দ্রুতই ক্যাসিয়াস ক্লে-কে নক আউট করবে (মোহম্মদ আলীক-র পূর্ব নাম)। কিন্তু বাটারফ্লাই স্টাইলের মুষ্টিযোদ্ধা ক্যাসিয়াস ক্লে-কে ধরা তো দূরের কথা উল্টা এই মুষ্টিযুদ্ধে সনি লিস্টনই মারাত্মকভাবে আহত হয়, এবং ৭ম রাইন্ডেই পরাজিত হয়। এইভাবে তিনি হয়ে গেলেন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। এই জয়ের ঠিক একদিন পরেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এবং ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে মোহম্মদ আলী হন। এভাবে তার স্লেভ নামটি তিনি পরিত্যাগ করেন। এই পাবলিক এ্যানাউন্সমেন্টটি পাবলিক শুরুতে পছন্দ করেনি। এভাবে মোহম্মদ আলী ‘ন্যাশন অফ ইসলাম’ গ্রপটিতে যোগ দেন। গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এলিজা মোহাম্মদ।
এরপর আলী ভীষণ বিনয়ী হয়ে গেলেন। যেই আলী একসময় বলতেন “I am the greatest of all time!”. তিনি এখন বলতে শুরু করলেন I am the great and Allah is the greatest ।
(মোহম্মদ আলী ছিলেন সকল কৃষ্ণাঙ্গদের অনুপ্রেরণা। তার পথ ধরেই বারাক ওবামা আজকের এ্যামেরিকান রাষ্ট্রপতি।)
গল্প করতে করতে মিন্টো রোড পার হয়ে রমনা পার্কের পাশ ঘেষে চলে এলাম সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। এখানে এসে রিকসা ছেড়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, পার্কের ভিতর দিয়ে হেটে হেটে কলা ভবনে পৌঁছে যাব। ভিতরে ঢুকে সবার মন ভরে গেল। ঢাকা শহরে কোন এক সময় সবুজের ছোঁয়া ছিল। ইট-রডের প্রকান্ড দালান নয়, ছিল মধ্যবিত্তের ছোট ছোট টিনের ঘর আর উচ্চবিত্তের একতলা-দোতলা বাড়ী। মধ্যবিত্ত হোক উচ্চবিত্ত হোক সবার বাড়ির আঙিনায়ই ছিল বাগান। ছিল আম, জাম, পেয়ারা, জামরুল, নারকেল, শুপারি গাছের শোভা। সন্ধ্যার পরপর প্রায় সবগুলো বাড়ীতেই ভাসত হাসনাহেনা অথবা মালতিলতার সৌরভ। ৮৪-৮৫ সালের দিক থেকে হঠাৎ করেই সব উবে যেতে থাকে, ঝপঝপ করে ব্যাঙের ছাতার মত এখানে সেখানে অকপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠতে থাকে নিম্ন মানের বহুতল ভবন। যার যেখানেই সুযোগ হয়েছে গড়ে তুলেছে গায়ে গা ঘেসে বিধঘুটে সব অট্টালিকা। প্রয়োজন নেই বাগানের, চুলোয় যাক গাছপালা, চাই শুধু টাকা। এক একটা তলা ভাড়া হবে, আর আমি টাকার সাগরে ভাসব। একবারও ভাবিনি বিপন্ন পরিবেশের কথা, একবারও ভাবিনি বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার কথা, একবারও ভাবিনি আমাদের শিশুদের খেলার মাঠের কথা।
সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানটি সবুজের সমারোহ। সবুজ ঘাস আর ছোট-বড় নানান সবুজ বীথি। আর এই সবুজ পটভূমিকে অলংকৃত করেছে নানা রঙের ফুল। গাঁদা, কসমস, হরেক রঙের গোলাপ, আরো কত কি নাম না জানা ফুল। ঢালাই করা সরু পায়ে চলা পথগুলোর দুপাশে হাটু পর্যন্ত উঁচু ঝাউ গাছ তার সৌন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শান্ত-নির্জন পরিবেশে মাঝে মাঝে পাখীর কাকলী শুনতে পাচ্ছি, হঠাৎ হঠাৎ ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে দু’একটি বিহঙ্গ। মাথার উপরের উজ্জ্বল সূর্যটা, আর থোকায় থোকায় উড়ে যাওয়া সাদা মেঘগুলো পুরোপুরিই মানিয়ে গেছে এই উদ্দ্যানের সাথে। সব মিলিয়ে মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশ।
রমনার ইতিহাস অনেক পুরাতন। সেই ১৬১০ সালে মোগল আমলে। এগারো শত বছরের পুরাতন ঢাকা শহরকে রাজধানী ঘোষণা করলেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর। ইসলাম খানকে পাঠালেন সুবেদার করে। নব্য রাজধানীতে সুবেদার ইসলাম খান গড়ে তুললেন বিশাল অঞ্চল জুড়ে এক নয়ানাভিরাম নগর অরণ্য বাগ-এ-বাদশাহী। এরই পরবর্তি নাম হয় রমনা। গড়ে উঠে দুটি অপূর্ব আবাসিক এলাকা মহল্লা চিশতিয়া ও মহল্লা সুজাতপুর।
টানা দুশো বছর ঢাকা ছিল বিশাল বাংলার রাজধানী ও প্রাণকেন্দ্র। দিনভর শোনা যেত বাদশাহ-সুলতানদের অশ্বারোহী সৈন্যদের জমকালো কুচকাওয়াজ ও দেশী-বিদেশী বণিকদের ব্যস্ততার গমগম শব্দ। ১৪১২ সালে দরবেশ শাহ আলী বাগদাদী ঢাকা আসেন, এবং এখানকার দরবেশ শাহ বাহারের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। যার টোম্ব এখনো আছে ঢাকার মিরপুরে। পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ জাও দে বারোস ১৫৫০ সালে ঢাকার মানচিত্র স্থাপন করেন তার সুখ্যাত গ্রন্থ ‘ডিকেড্স অফ এশিয়ায়’। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম গভর্ণর উইলিয়াম হেজেস ১৬৮১ সালে ঢাকা এসে নগরীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল, এটি বাগান আর প্রাসাদের একটি অপূর্ব সুন্দর নগরী। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা পাট ও চামড়ার ব্যবসায় সাফল্য লাভ করলে, এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এক সময় রাজধানী স্থানান্তরিত হলো মুর্শিদাবাদে, তার কিছুকাল পরে পলাশির ট্রাজেডি, আর সেইসাথে বহুকালের জন্যে সদ্য স্থাপিত ইংরেজ নগরী কলকাতা দখল করে নিল ঢাকার স্থান। কালের স্রোতে ঢাকা হারালো তার গৌরব। রমনা হয়ে উঠল জঙ্গল। ধীরে ঢাকার এমনই শোচণীয় অবস্থা হলো যে, একসময় লেখক বঙ্কিমচন্দ্র কটাক্ষ করে বলল, “ঢাকাতে থাকে কেবল, কাক, কুকুর আর মুসলমান”।
ঢাকা তার হৃত গৌরব ফিরে পাবার একটা সুযোগ পেল ১৯০৫ সালে যখন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকাকে নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা ও আসামের রাজধানী ঘোষণা করলেন। কিন্তু ঢাকার আকাশে সৌভাগ্যের চাঁদ বেশিদিন রইল না। ১৯১১ সালে পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে, ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা আর একবার হারায়।
১৮২৫ সালে ঢাকার বৃটিশ কালেক্টর মিঃ ডো রমনার পূণঃনির্মানের কাজ হাতে নেন। ডো-র নির্দেশে শ্রমিকরা কয়েক মাস ঘাম ঝরিয়ে সেখান থেকে জংলা ঝোপঝার পরিস্কার করে ও পরিত্যক্ত দালান, মনুমেন্ট ও টোম্বগুলো ভেঙে ফেলে। রেখে দেয়া হয় শুধু গ্রীক টোম্ব (যা বর্তমানে টি, এস, সি-র ভিতরে আছে), কালীমন্দির, ইরাণী বণিক শাহবাজ খান কর্তৃক ১৬৭৯ সালে নির্মিত শাহবাজ মসজিদ ও মীর জুমলা গেট (যা ঢাকা গেট নামেও খ্যাত)। এই রিনোভেটেড এলাকার নতুন নামকরণ হয় রমনা, এবং একে রেসকোর্স হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রেসকোর্সের একপাশে গড়ে ওঠে বৃটিশ মিলিটারি ক্লাব। ঢাকার নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘোড়দৌড় অতি দ্রুতই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কাটাবনে একটি বিশাল আস্তাবলও তৈরী করা হয়। নবাবরা এখানে মনোরম বাগান গড়ে তোলেন এবং একটা অংশের নাম দেন শাহবাগ (বাদশাহী বাগান)।
এই রমনার একপাশে রয়েছে ঢাকা ক্লাব ও শিশু পার্ক (শিশুদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এটি নির্মান করেছিলেন), আরেক পাশে রয়েছে পুরাতন গভর্ণর হাউস (বর্তমানের হাইকোর্ট)। ঠিক তার পাশেই পরম শান্তিতে শুয়ে আছেন আমাদের জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। জাতি তাদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা স্মরণ রেখে, কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসাবে তাদের সমাধির উপর গড়ে তুলেছেন প্রকান্ড স্মৃতিসৌধ। আরেক পাশে ঘুমিয়ে আছেন বীর যোদ্ধা ও বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এখানেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”, এখানেই আত্মসমর্পন করেছিল পাক হানাদার বাহিনী, এখানেই ময়দান প্রকম্পিত হয়েছিল লক্ষ লক্ষ বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার বিজয় উল্লাস জয় বাংলা ধ্বনিতে। এই রমনা ইতিহাসের পাতা উল্টে উল্টে মনে করিয়ে দেয় কয়েক শত বছরের গৌরব গাঁথা। কানপেতে যেন শুনতে পাই শেরে বাংলার ব্যঘ্র হুংকার, সোহ্রাওয়ার্দীর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা, বিদ্রোহী কবির অগ্নিবীণার ঝংকার, বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ, পরাজিত নিয়াজির আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর দেয়ার খসখস শব্দ, আর হাজারো জনতার বিজয়োল্লাস।
(স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে,
পানি টলটল মেঘনা নদীর কাছে,
আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে
বকের ডানায় ছাওয়া চরের কাছে,
চাঁদ জাগা বাঁশ বাগানের কাছে,
আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে)
বিশ্বখ্যাত গায়িকা রূণা লায়লার গাওয়া এই গানটি একসময় আমার মনকে আপ্লুত করত, এখনো করে!
লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ৯
:দেখ দেখ এখান থেকে শিশু পার্কের ঐ নাগরদোলাটি কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে।
: হ্যাঁ, বেশ সুন্দর লাগছে।
ঃ আচ্ছা আমিতো ঢাকার বাইরের, তাই তোমাদের ঢাকা সম্পর্কে আমার আইডিয়া কম। আমাকে ঐ শিশু পার্কটি সম্পর্কে কিছু বল।
: ভালো প্রশ্ন করেছ আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছে ঐ শিশু পার্কটি ।
ঃ কি রকম?
ঃ ঢাকাতে একসময় শিশু পার্ক বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। নয়াটোলাতে একটা জায়গা ছিল, তার নাম ছিল নয়াটোলা শিশু পার্ক।
ঃ কি ছিল ওখানে?
ঃ সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম। প্রায় কিছুই ছিলনা। ছিল কয়েকটা দোলনা, কিছু ঢেকি, আর কয়েকটা লোহার গাছ। ওখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ত আশেপাশের শিশুরা। আমিও যেতাম। যদিও তখন জনসংখ্যা কম ছিল, তারপরেও । আশেপাশের এলাকার শিশুদের সংখ্যার তুলনায় ওটা ছিল এক চিলতে জমি। তুমি ভাবো, বিশাল বড় আবাসিক এলাকা মগবাজার যার আবার অনেকগুলো ভাগ আছে – মধুবাগ, নয়াটোলা, ওয়ারলেস কলোনী, পেয়ারাবাগ, দিলি রোড, শাহসাহেব বাড়ী, ইত্যাদি। এই বিশাল এলাকার জন্য মাত্র ঐ গুটিকতক মামুলি খেলনা নিয়ে, ঐ এক চিলতে জমির শিশু পার্ক!
ঃ হায় খোদা
ঃ শিশুদের ভীড় লেগেই থাকত। এক একটা দোলনার পিছনে বিশাল লাইন। মাঝে মধ্যে আবার এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি মারামারিও লেগে যেত।
ঃ ওরকম পার্ক কি ঢাকা শহরে ঐ একটাই ছিল?
ঃ না। টুকরা টাকরা এরকম আরো কয়েকটি ছিল ঢাকা শহরে।
ঃ রমনা পার্কের ভিতরে, গুলিস্তানের আশেপাশে কোথায় যেন একটা ছিল
ঃ এই ছিল শিশুদের জন্য ব্যবস্থা!
ঃ হ্যাঁ, শিশুদের ভালো মন্দের কথা সম্ভবতঃ কারোই মনে হয়নি।
ঃ তাইতো মনে হয়। তারপরে কি হলো?
ঃ ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতি হলেন জিয়াউর রহমান। তিনি অনুধাবন করতে পরেছিলেন যে, জাতির ভবিষ্যৎ হলো শিশুরা। যে কোন জাতি গঠন শিশুদেরকে দিয়েই শুরু করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেন। এক, শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, দুই, দেশের প্রতিটি বৃহত্তর জেলায় একাডেমির শাখা স্থাপন করেন, তিন, শিশুদের সাংস্কৃতিক প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে নতুন কুঁড়ি নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন, যা বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হতো। পরবর্তিকালে অনেক সুখ্যাত শিল্পি ঐ নতুন কুঁড়িরই প্রডাক্ট, চার, সারাদেশে মেধাবী শিশু ছাত্রদের অনুপ্রেরণা দেয়ার লক্ষ্যে তাদের জন্য একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং সশরীরে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। সেই সম্মেলনে অংশগ্রহনকারী মেধাবী শিশুদের জন্য দিনটি ছিল স্মরণীয়, পাঁচ, মেধাবী শিশুদের (ধনী হোক দরিদ্র হোক) লালণের নিমিত্তে নির্মিত সামরিক মেরিট স্কুল ক্যাডেট কলেজের সংখ্যা চারটি থেকে আটটিতে উন্নিত করেন, ছয়, সুস্থ অর্থবহ ও উন্নত চলচিত্রের নির্মানের লক্ষ্যে তিনি রাষ্ট্রীয় অনুদানের ব্যবস্থা করেন। এই সময়ে বেশ কিছু ভালো ভালো শিশু চলচিত্র নির্মিত হয়, যেমন- ছুটির ঘন্টা, ডুমুরের ফুল, ডানপিটে ছেলেটি, অশিক্ষিত, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, ইত্যাদি,
ঃ আমার মনে আছে। সেই সময় বিটিভিতেও খুব সুন্দর সুন্দর শিশুতোষ অনুষ্ঠান হতো। এরমধ্যে একটি ধারাবাহিক নাটক ছিল, ‘রোজ রোজ’। প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিল শিশুদের মধ্যে। আমরা হা করে গিলতাম।
ঃ হ্যাঁ। আমার মনে আছে। সাজিয়া, শিপলু, অরূপরা অভিনয় করেছিল। একটি শর্ট ফিল্মও হয়েছিল নাম মনে পড়ছে না। শক্তিমান অভিনেতা গোলাম মোস্তফা অভিনয় করেছিলেন।
ঃ সুবর্ণা মোস্তফার বাবা?
ঃ হ্যাঁ। ক্যামেলিয়া মোস্তফা, সুবর্ণা মোস্তফা দুই বোন। উনাদের একটা ছোট ভাই আছে সুমিত ইসমাইল মোস্তফা। এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী-তে শিশু শিল্পি হিসাবে অভিনয় করেছিল।
ঃ ইন্টারেস্টিং! তারপর ঐ ফিল্মটিতে কি ছিল?
ঃ ফিল্মটি ছিল শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগানোর একটা ফিল্ম। তার দুটি কথা মনে আছে। বালুর উপর ম্যাপ এঁকে এক শিশু বলছে – “এই এই এই বেশ, এইতো আমার বাংলাদেশ।” আরেকটা গান ছিল, ‘দেশকে ভালোবেসে, দেশকে ভালোবেসে বসে থাকলে চলবে নারে’।
ঃ চমৎকার তো গানটির কথা।
ঃ সাত, জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালকে বাংলাদেশ শিশু বর্ষ ঘোষণা করেন। পুরো বছর জুড়ে সারাদেশে নানা রকম কর্মকান্ড হয়। আর আট নম্বর হলো ঐ শিশু পার্কটি।
ঃ জিয়াউর রহমান তৈরী করেছেন!
ঃ হ্যাঁ। সেনাবাহিনীর চাকুরী জীবনে তিনি জার্মানীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি নিশ্চয়ই সেখানকার অত্যাধুনিক শিশু পার্কগুলো দেখেছিলেন। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়েও তিনি একাধিক দেশ সফর করেছিলেন এবং সেসব দেশের শিশুপ্রেম ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি তাই ঢাকাতে একটি অত্যাধুনিক শিশু পার্ক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেই চাওয়া সেই কাজ, খুব দ্রুতই কাজ শেষ করে ১৯৭৯ সালে উদ্ধোধন করলেন ‘ঢাকা শিশু পার্ক’। হুমড়ি খেয়ে পড়ল শুধু শিশুরা নয় পুরো ঢাকা শহর। শিশু, কিশোর, যুবা এমনকি প্রৌঢ়-বৃদ্ধরাও বাদ যায়নি। আমাদের কল্পনাতেই ছিলনা এমন কিছু একেবারে বাস্তব রূপে ধরা দিল। জীবনে প্রথম যেদিন এই পার্কে এসেছিলাম আমার মনে আছ্বে। বাবা-মা, আপুরা, আমি, দাদীমা, আর আমাদের আরো কয়েকজন কাজিন সবাই এসেছিলাম। আব্বুর ভাঙা গাড়ীটাতে যতজন পারি উঠলাম, আর কয়েকজনকে রিকশায় তুলে নিয়ে এলেন আমাদের দূর সম্পর্কের এক মামা। পার্কে ঢুকেই আমার মনে হয়েছিল যেন রূপকথার জগতে এলাম।
ঃ এই পার্ক নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাও আছে।
ঃ ও বাবা বিমান ছিনতাই! এই শিশু পার্ক নিয়ে? কি হয়েছিল বলতো?
ঃ এক পাগলাটে যুবক, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী একটি আভ্যন্তরীণ বিমান হাইজ্যাক করে খেলনা পিস্তল দিয়ে। তারপর পাইলটকে বাধ্য করে বিমানটি কলকাতায় নিয়ে যেতে।
ঃ কলকাতায় নিল?
ঃ কি আর করা? পাইলট তো আর বুঝতে পারেনি যে, সেটা খেলনা পিস্তল। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ছিনতাইকারীর কথাই শোনে। ছিনতাইকারীর কাছে তার দাবী শুনতে চাইলে সে বলে, “ঢাকার শিশু পার্কটি চরম বিলাসিতা, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে এমন পার্কের প্রয়োজন নেই। আমি পার্কটি বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছি”।
ঃ এত সুন্দর একটা পার্ক, যা দেখে শিশুরা আনন্দে ভাসছে সেটা সে বন্ধ করার দাবী জানালো!
ঃ এই একটা সমস্যা। আমরা কোন ভালো কিছুকে খুব সহজে গ্রহন করতে পারিনা।
শিশু পার্কটি পিছনে রেখে ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐ গেটের দিকে যেখান থেকে বেরোলেই টি, এস, পাওয়া যাবে। কিছুদূর যাওয়ার পর তিন নেতার মাযারের সৌধটি চোখে পড়ল। তার পাশেই একটা খুব পুরাতন স্থাপনা দেখা গেল।
ঃ ওটা কিরে? (ইমতিয়াজ প্রশ্ন করল)
ঃ অনেক পুরাতন একটা মসজিদ। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ অনেক পুরাতন তা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। কোন আমলর? ইতিহাস কি? রোমান কিছু জানো?
ঃ সামান্য জানি। (উত্তর দিলাম আমি) এটির নাম শাহবাজ মসজিদ। ইরানী বণিক হযরত শাহবাজ (রঃ) এই মসজিদটি রমনায় নির্মান করেছিলেন ১৬৭৯ সালে। তিনি একাধারে বণিক ও ধর্মপ্রান একজন মানুষ ছিলেন। তার জীবদ্দশায় তিনি এই মসজিদটি তৈরী করেন। সম্ভবত শ’তিনেক মুসল্লির নামাজের জায়গা হবে এই মসজিদে। এটি ঢাকার প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। হযরত শাহবাজ (রঃ) ঢাকাতেই ইন্তেকাল করেন এবং মসজিদ সংলগ্নই রয়েছে তাঁর মাযার শরীফ।
ঃ মসজিদটি কোন আমলে করা?
ঃ মোগল আমলে।
ঃ এই যে মোগল আমল, মোগল আমল করছিস, বাংলাদেশে কি সব সময়ই মোগল শাসন ছিল না কি?
ঃ সব সময় থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রথম মোগল সম্রাট ছিলেন জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর (বাবুর) । তিনি ১৫২৬ সালের ২১শে এপ্রিল পাণিপথের যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে লোদি সাম্রাজ্য বা দিল্লির সুলতানাত অন্য কথায় ভারত উপমহাদেশ দখল করেন। সেই ছিল এই উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের শুরু।
ঃ তখন কি বাংলা দিল্লির সুলতানাত-এর অধীনে ছিল না? সেই হিসাবে বাংলা কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাবুরের অধীনে আসে নাই?
ঃ না, বাংলায় তখন হুসেনশাহী যুগ চলছিল। হুসেনশাহীরা স্বাধীনভাবেই বাংলা শাসন করছিলেন।
ঃ কে তথন বাংলার সুলতান ছিলেন?
ঃ ১৪৯৩ সালে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহন করেন। ইতিপূর্বে বাংলায় কিছু পরিমানে বিশৃঙখলা বিরাজমান ছিল। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ অসীম যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করে দেশে শান্তি শৃখলা প্রতিষ্ঠা করেন।
ঃ কত বছর ছিলেন হুসেনশাহীরা?
ঃ ১৪৯৩ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত হুসেনশাহী বংশের চারজন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, নসরৎ শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ও গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ বাংলাদেশ শাসন করেন।তাদের শাসনকালে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সামরিক জীবনে সাফল্য ও বাঙালী প্রতিভার বহুমূখী বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ফলে বাঙালী জীবনে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল। এই সময়ই বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। তাই হুসেনশাহী যুগ বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগ।
ঃ বাবুরের সময় কোন সুলতান বাংলার ক্ষমতায় ছিলেন?
ঃ সুলতান নসরৎ শাহ। স্বাধীন সুলতান।
ঃ তার সাথে কি বাবুরের কোন যুদ্ধ হয়নাই? বাবুর কি বাংলা দখল করেনি?
ঃ ১৫২৬ সালে বাবুর ভারতের অধীশ্বর হলে বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যের জন্য বিপদ উপস্থিত হয়। লোদীর পক্ষের অনেক পলায়মান নেতা নসরৎ শাহের সাহায্যপ্রার্থী হয়। নসরৎ শাহ মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দেন। এদিকে ১৫২৭ সালে বাবুর ঘোগরা নদীর দিকেম অগ্রসর হন। তিনি মোল্লা মাজহার নামক এক দূতকে পাঠালেন নসরৎ শাহের কাছে, নসরৎ শাহের মনোভাব জানার জন্য। নসরৎ শাহ কোন স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে মোল্লা মাজহারকে এক বৎসর নিজের দরবারে রেখে দিলেন। শেষ পর্যন্ত নসরৎ শাহ নিরপেক্ষতার পথ অবলম্বন করেন এবং নসরৎ শাহের পাল্টা দূত ১৫২৯ সালে বাবুরের দরবারে বহু উপঢৌকন নিয়ে হাজির হন। বাবুর নসরৎ শাহের নিরপেক্ষতায় সন্তষ্ট হলেন ও বাংলা আক্রমণের পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। ১৫৩০ সালে বাবুরের মৃত্যু হলে নসরৎ শাহ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।
ঃ আচ্ছা বাবুর পুত্র হুমায়ুন কি বাংলা আক্রমন করেন নাই?
ঃ হুমায়ুন বাংলা আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ নিলে, নসরৎ শাহ মোগল সাম্রাজ্যের অপর সীমান্তের শত্রূ গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের সাথে মিত্রতা স্থাপনের উদ্দেশ্যে মালিক মরজানকে দূত হিসাবে পাঠান। বাহাদুর শাহ হুমায়ুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করছিলেন। এই সংবাদ পেয়ে হুমায়ুন বাংলার বিরুদ্ধে আর অগ্রসর না হয়ে গুজরাট অভিমুখে যাত্রা করেন। নসরৎ শাহের আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলা-গুজরাটের মৈত্রী পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী হলেও নসরতের সময়পোযোগী কুটনীতি বাংলাকে আসন্ন যুদ্ধ হতে রক্ষা করল।
ঃ বাহ্! বেশ ভালো কূটনৈতিক চাল চেলেছিলেন তো নসরত শাহ। আচ্ছা, শুনেছি গুজরাটী জাতির সাথে নাকি আমাদের জাতির মিল আছে?
ঃ হ্যাঁ আছে তো। গুজরাটি ভাষার সাথেও আমাদের বাংলা ভাষার মিল আছে।
ঃ কি বলিস? দুই দেশ ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে। তারপরেও মিল হলো কি করে? অস্বাভাবিকই তো মনে হচ্ছে।
ঃ আপাতঃদৃষ্টিতে অস্বাভাবিকই মনে হয় তবে ওটাই ফ্যাক্ট। অবশ্য এর ব্যাখ্যাও রয়েছে।
ঃ বলতো, ব্যাখ্যাটা কি।
ঃ আরেকদিন বলব। তবে এই মুহূর্তে বাবুরের একজন বিশ্বখ্যত পুর্বপুরুষ সম্পর্কে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল, ওইটা আগে বলি।
ঃ ইন্টারেস্টিং! বাবুরের বিশ্বখ্যত পুর্বপুরুষ? কে তিনি?
ঃ তৈমুর লং।
ঃ বলিস কি! তৈমুর লং বাবুরের পূর্বপুরুষ নাকি?
ঃ হ্যাঁ মায়ের দিক থেকে বাবরের পূর্বপুরুষ ছিলেন চেঙ্গিস খান, আর বাবার দিক থেকে বাবরের গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ছিলেন তৈমুর লং ।
ঃ ভেরি ইন্টারেস্টিং! কি হয়েছিল তৈমুর লং-এর? কি সেই মজাদার তথ্য?
ঃ তৈমুর লং-এর জন্ম ১৩৩৬ সালের ৮ই এপ্রিল কেশ নগরীর স্কারদু নামক শহরে, এর বর্তমান নাম শহর-ই-সবজ মানে সবুজ শহর। বর্তমান উজবেকিস্তান রাষ্ট্রের সমরকন্দ শহরের ৫০ মাইল দক্ষিণে এই শহর-ই-সবজ অবস্থিত। সেই সময় তা ছিল চাঘতাই খানশাহীর (Chagatai Khanate) অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পিতা ছিলেন বারলাস উপজাতির ছোট মাপের ভূস্বামী। এই বারলাস হলো তুর্কী-মঙ্গোল উপজাতি, অথবা মূলতঃ মঙ্গোল উপজাতি যাকে পরবর্তিতে টার্কিফাই করা হয়েছিল। Gérard Chaliand-এর মতে তৈমুর মুসলমান ছিলেন। তৈমুরের মনে চেঙ্গিস খানের সাম্রাজ্যকে পুণঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস জাগে।
Skardu
তৈমুর ছিলেন একজন মিলিটারি জিনিয়াস এবং ট্যাক্টিশিয়ান, যা তাকে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী শাসকে পরিণত করে। তৈমুরের সৈন্যবাহিনী ছিল বিশ্বের ত্রাস। যে স্থানই জয় করত সেখানেই ধ্বংসযজ্ঞের প্রলয় তুলত। এই সৈন্যদলের হাতে ১৭ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়। যা ছিল সেই সময়ের পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা পাঁচ ভাগ। হিটলারের আগমনের পূর্বে তৈমুরই ছিল বিশ্বের সবচাইতে বড় ত্রাস।
আবার এই তৈমুরই ছিলেন আর্ট ও কালচারের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। তিনি সমাজবিদ্যার (Sociology) প্রতিষ্ঠাতা ইবনে খলদুন ও পার্শী কবি হাফিজের মত মুসলিম পন্ডিতদের সংস্পর্শে আসেন।
১৩৬০ সালে তৈমুর সেনা অধ্যক্ষ হিসাবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তিতে ১৩৬৯ সালে সমরকন্দের সিংহাসনে আরোহন করেন। সে সময় যেকোন শাসকই সিংহাসনে আরোহনের পর দ্বিগিজ্বয়ে বের হতেন, তৈমুরও তাই করেন। তার সৈন্যাপত্যের গুনে তিনি পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিমে কাস্পিয়ান থেকে শুরু করে উরাল ও ভলগা পর্যন্ত, দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে পারশ্য, বাগদাদ, কারবালা ও ইরাকের কিয়দংশ দখল করেন। ১৩৯৮ সালে তৈমুর দিল্লি সুলতানাত আক্রমণ করেন। এবং কয়েকমাসের মধ্যে দিল্লি জয় করেন। এখানে তিনি এক লক্ষ যুদ্ধবন্দিকে হত্যা করেন। তিনি অটোমান সাম্রাজ্য, মিশর, সিরিয়া, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া ইত্যাদি দেশেও সামরিক অভিযান চালান। সব জায়গাতেই ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় ও অনেক জনপদ বিরান করে ফেলা হয়।
ঃ তার নামের শেষে লং থাকার অর্থ কি? এটা কি তার পদবী?
ঃ না। তার পদবী ছিল গুরগান, পুরো নাম তৈমুর গুরগান। এক যুদ্ধে আহত হয়ে পায়ে আঘাত পেয়ে তিনি খোঁড়া বা ল্যাংড়া হয়ে যান। সেই থেকে তাঁর নাম হয় তৈমুর লং অর্থাৎ ল্যাংড়া তৈমুর।
ঃ তৈমুর মারা গেল কবে?
ঃ তৈমুর চীন জয় করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন সেখানে রাজত্ব করছিল মিং ডাইনাস্টি। তিনি মিং-দের আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন, কিন্ত শির দরিয়া পর্যন্ত পৌছে ছাউনি স্থাপন করার পরপরই তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। বিশ্বজয়ী কঠোর শাসকের এটিই ছিল শেষ অভিযান। সেই ছাউনিতেই ১৪০৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী তিনি দেহত্যাগ করেন।
তৈমুরের মৃত্যুর অনেকগুলো বছর পর। ১৯৪১ সালে তদানিন্তন সোভিয়েত সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, তৈমুরের মৃতদেহ তুলবে। উদ্দেশ্য, দেহাবশেষ থেকে তার সত্যিকারের চেহারার ছবি আঁকা। কোন কঙ্কাল বা দেহাবশেষ থেকে সেই ব্যক্তিটি জীবদ্দশায় দেখতে কেমন ছিল তার চিত্র অংকন করার বিজ্ঞানটি ইতিমধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নে যথেষ্ট উন্নতি লাড করেছিল। এটা প্রথম করেছিলেন সোভিয়েত প্রত্নতত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানী মিখাইল গেরাসিমোভ (Soviet anthropologist Mikhail M. Gerasimov)। তিনি অতি যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করে দুই শত জনেরও অধিক ব্যক্তির দেহাবশেষ থেকে তাদের চেহারা অংকন করেছিলেন।
সেই উপলক্ষে তদানিন্তন সোভিয়েত একনায়ক জোসেফ স্তালিন (ইউজেফ যুগাশভিলি) একটি টীম গঠন করেন যার নেতৃত্বে ছিলেন গেরাসিমোভ । কিন্ত এই মিশন করতে গিয়ে প্রথম যেই বিপত্তিটি ঘটল তাহলো তৈমুরকে যে ঠিক কোথায় দাফন করা হয়েছিল তা সঠিকভাবে কারোই জানা ছিলনা। তৈমুরের টোম্ব সম্পর্কে একাধিক শ্রতি ছিল। এটা খুব সম্ভবতঃ ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছিল, যাতে তার টোম্ব কেউ খুঁজে না পায়। প্রথমে তারা এক জায়গায় যান। সেখানে খোড়াখুঁড়ি করে যা পেলেন তা হলো একটি শূণ্য কবর। তারপর তারা অন্য একটি জায়গায় যান। সেখানেও তৈমূরের টোম্ব থাকার সম্ভাবনা ছিল। এবারেও হতাশ হন গেরাসিমোভ ও তার নৃবিজ্ঞানী দল। এবার ইতিহাস একটু ঘাটাঘাটি করে মনযোগ দি্যে পড়ে, সমরকন্দের একটি জায়গা তারা চিহ্নিত করলেন, যেখানে তৈমুরের মৃতদেহ থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে তারা উপস্থিত হয়ে খোড়াখুঁড়ি শুরু করলেন এবার পূর্বের চাইতে বেশী আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কিন্তু খোড়াখুঁড়ির শেষ হওয়ার পর আগের চাইতে আরো বেশী হতাশ হলেন নৃবিজ্ঞানীরা। আবারও পেলেন শূণ্য কবর। সন্ধ্যা নাগাদ ঘরে ফিরে গেলেন তারা। কি করবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। খোজাখুঁজি করার কিছুই বাকী রাখেননি তারা। আর কোন সম্ভাব্য জায়গা আছে বলেও মনে হয়না। আরেকবার ইতিহাস ঘাটলেন। না আর কোন জায়গা নেই, হলে এটাই হবে। কিন্তু এখানে তো তারা শূণ্য কবর পেয়েছেন! হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল গেরাসিমোভের মাথায় – ‘আমরা থেমে গেলাম কেন? আরো গভীরে খুঁড়িনা। দেখিনা, কি আছে সেখানে।’
পরদিন তারা ফিরে গেলেন টোম্বে। নব উদ্যমে কাজ শুরু করলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে আরো গভীরে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, কিছু একটা আছে ওখানে। এবার ভারী কয়েকটি পাথরের পাটাতন নজরে পড়ল। স্পস্ট হলো যে, কবরটি কৌশলে নির্মিত। প্রথমে একটি ফাঁকা কবর তারপর আরো গভীরে কিছু আছে। ঐ পাটাতন সরালে কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে। ওগুলো সরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এরকম সময়ে গেরাসিমোভের কাছে সংবাদ এলো যে, আপনার সাথে তিন বুড়ো দেখা করতে চায়।
কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা বিস্মিত হলেন গেরাসিমোভ, কে এলো আবার এই চূড়ান্ত সময়ে। সংবাদদাতা জানালেন, এটা খুব জরুরী, আপনাকে তাদের সাথে দেখা করতেই হবে। কাজ রেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। নিকটবর্তী একটি চাইখানা (মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত বিশেষ ধরনের অতি জনপ্রিয় চায়ের ক্যাফে)-য় তাকে নিয়ে গেল সংবাদদাতা। সেখানে তিনজন বৃদ্ধ বসে আছে। সেই প্রাচীন কালের রূপকথার মত দেখতে তারা । আবার তিন বৃদ্ধ দেখতে ছিল একই রকম, যেন মায়ের পেটের তিন ভাই। তারা রুশ ভাষা জানত না। ফারসী ভাষায় কথা বলতে শুরু করল। অনুবাদক অনুবাদ করে দিল।
ঃ আপনারা কাজ বন্ধ করুন। তৈমুরের মৃতদেহ তুলবেন না। (বলল এক বৃদ্ধ)
ঃ কেন? (গেরাসিমোভ প্রশ্ন করলেন)
ঃ যেটা বলছি সেটা করুন। বাড়তি প্রশ্নের কি প্রয়োজন? (আরেক বৃদ্ধ বলল)
ঃ আমাদের মিশন আছে। কাজটা আমাদের করতে হবে।
ঃ মিশন বন্ধ রাখুন। কাজটা না করাই ভালো।
ঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্বয়ং স্তালিন আমাদের পাঠিয়েছেন। মিশন শেষ না করে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।
ঃ স্তালিন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী উপরওয়ালা। স্তালিনের কথা না শুনলেও চলবে।
ঃ এই সোভিয়েত রাষ্ট্রে বসবাস করে জোসেফ স্তালিনের আদেশ অমান্য করার সাহস আমাদের নেই। তাছাড়া আমরা বিজ্ঞানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে যাচ্ছি।
ঃ বাদ দেন আপনার বিজ্ঞান। মানুষের কথা ভাবুন, পৃথিবীর কথা ভাবুন।
ঃ বুঝলাম না! আপনারাই বা এত জেদ ধরেছেন কেন? একটা সামান্য মৃতদেহ তুলব। এর সাথে মানুষ, পৃথিবী ইত্যাদির সম্পর্ক কি?
ঃ সামান্য মৃতদেহ নয়। এটি স্বয়ং তৈমুর লং-এর মৃতদেহ। আপনাদের স্তালিনের চাইতেও বহু বহু গুনে শক্তিধর ছিলেন তিনি। ভয়াবহ কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই তাকে থামানো প্রয়োজন।
ঃ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন আপনারা? কি ঘটতে পারে?
ঃ বাছা এই দেখ আমার হাতে বই। (গেরাসিমোভ তাকালেন বইটার দিকে, অতি প্রাচীন একটি বই, নিঁখুত হস্তলীপিতে আরবী লেখায় ভরা। বইয়ের একটি জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো শান্ত সৌম্য তৃতীয় বৃদ্ধটি) এই দেখ এখানে লেখা – তৈমুর লং-এর ঘুম ভাঙালে পৃথিবীতে এমন একটি রক্তাত ও ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হবে যা মানব জাতি ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি।
ঃ কিযে বলেন! (পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই মনে হলোনা গেরাসিমোভের)
ঃ আমি দুঃখিত। আপনাদের কথা রাখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আপনারা যেতে পারেন আমার হাতে এখন অনেক কাজ। (বললেন গেরাসিমোভ )
তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গেরাসিমোভের দিকে তাকালেন তারা। এরপর ফারসী ভাষায় গালমন্দ করতে শুরু করলেন গেরাসিমোভকে। দ্বিগুন বিরক্তিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন গেরাসিমোভ। গালমন্দ করতে করতে চলে গেল তিন বৃদ্ধ। যে উৎফুল্ল মনে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি তা আর রইল না। মেজাজটাই খিঁচড়ে গেল। দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২০শে জুন।
(ভূতপূর্ব রুশ সাম্রাজ্যে চালু হয়েছে নতুন শাসন। জারকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে কম্যুনিস্টরা। কেবল রুশ সাম্রাজ্যই নয়, আশেপাশের পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোকেও প্রভাব বলয়ের মধ্যে নিয়ে এসেছে তারা। আত্মবিশ্বাস দিনদিনই বাড়ছে তাদের। স্বপ্ন দেখছে বিশ্ববিপ্লবের নামে সমগ্র পৃথিবী দখল করার। রহস্য, অতিন্দ্রিয়, অতিপ্রাকৃত কোন কিছুই বিশ্বাস করেনা তারা। বড় বেশী প্রাকটিকাল। মান্ধাতার আমলের পোষাক-আশাক পড়া, ফারসী ভাষা বলা, আনইমপ্রেসিভ ঐ তিন বৃদ্ধের আজগুবী কথায় কান দেবে সেই ধাতুতে গড়া নয় কম্যুনিস্টরা।)
ভিতরে ঢোকার সময় হঠাৎ টোম্বের গায়ে নজর পড়ল গেরাসিমোভের, গুর-ই-আমীর (তৈমুরের সমাধী)-এ ফারসী ও আরবী ভাষায় লেখা, “আমি যেদিন জাগব, সমগ্র পৃথিবী প্রকম্পিত হবে।” (“When I rise from the dead, the world shall tremble.”) বোগাস! ভাবলেন তিনি। ভিতরে গিয়ে আরো কিছু কাজের নির্দেশ দিলেন তিনি। পুরো কাজ শেষ হতে আরো দুদিন সময় লাগলো। অবশেষে ১৯৪১ সালের ২২শে জুন পাটাতনগুলি সরানো হলো আর সাথে সাথে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিজ্ঞানীদের। বহু প্রতিক্ষিত কফিন শুয়ে আছে সেখানে। পনের শতকের পৃথিবী কাঁপানো শাসক তৈমুর লং-এর কফিন। গভীর আগ্রহ নিয়ে কফিনের ডালা খুললেন তারা। পাঁচশত বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া, মহাশক্তিধর তৈমুরের নিথর-নীরব দেহ শুয়ে আছে। হঠাৎ মৃতদেহের পাশে কিছু একটার দিকে নজর গেল গেরাসিমোভের। একটি ফলকে সেখানে লেখা, “যেই আমার টোম্ব খুলুক না কেন, সে আমার চাইতেও ভয়াবহ এক টেরর-কে পৃথিবীতে ডেকে আনলো” (“Who ever opens my tomb, shall unleash an invader more terrible than I.) । কিছুটা ভুরু কুঞ্চিত হলো গেরাসিমোভের। একটু চিন্তিত মনে হলো তাকে।
ঃ স্যার কি ভাবছেন? (তরুণ এক বিজ্ঞানী প্রশ্ন করল তাকে)
ঃ উঁ। না কিছুনা।
ঃ বাইরে, কেউ কিছু বলেছে?
ঃ ব্যাপার না। (ছোট একটি শ্বাস ফেলে বললেন তিনি)
ঃ এখন কি কাজ হবে স্যার?
ঃ দেহটাকে আমার এপার্টমেন্টে নিয়ে চল। মুখচ্ছবি তৈরী করতে হবে আমাকে।
তাই করা হলো।
এপার্টমেন্টে নিয়ে গভীর মনযোগের সাথে কাজ শুরু করলেন তিনি। দারুন একটা সুযোগ হয়েছে তাঁর। ইতিহাসের খ্যতিমান এক ব্যাক্তির সত্যিকারের মুখচ্ছবি তৈরী করতে পারবেন তিনি। আঁকা বা কাল্পনিক ছবি নয়, একেবারে আসল। কাজ শেষ হলে পৃথিবীবাসী কেমন বাহবা দেবে তাকে! কিন্তু বাহবা পাওয়ার আগেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। সেই দিনই নাৎসী জার্মানী হামলা চালালো সোভিয়েত ইউনিয়নে, পৃথিবী প্রকম্পিত করা এই অপারেশনের নাম অপারেশন বারবারোসা (Nazi Germany launched Operation Barbarossa, its invasion of the U.S.S.R.)। হতবাক হয়ে গেলেন গেরাসিমোভ। টোম্বের গায়ের লেখাটি মনে পড়ল তার। ছুটে গেলেন ঘনিষ্ট বন্ধু ও এই মিশনে তার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান মালিক কাউমোভার কাছে। খুলে বললেন সব। বন্ধু বললেন,
ঃ এরকমও হয়! বৃদ্ধ তিনজন তো তাহলে, সবার ভালোই চেয়েছিল।
ঃ কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এটা কাকতালীয়ও হতে পারে।
ঃ খোঁজ করব ঐ তিন বৃদ্ধের?
ঃ কোথায় পাবে ওদের? আর বলবই বা কি?
ঃ তারপরেও চলো যাই।
সেই চাইখানায় আবার গেলেন গেরাসিমোভ ও মালিক কাউমোভা।
ঃ আচ্ছা, দুদিন আগে এখানে তিনজন বৃদ্ধ এসেছিল না? (চাইখানার দোকানীকে প্রশ্ন করলেন মালিক কাউমোভা)।
ঃ ঃ হ্যাঁ, আমি দেখেছি, আপনাদের সাথে কথা বলছিল তিন বৃদ্ধ (উত্তর দিন দোকানী)।
ঃ আপনি তো স্থানীয়, ওদের হদিস একটু দিতে পারবেন কি?
ঃ না কমরেড, আমি নিজেই একটু অবাক হচ্ছিলাম। ওদেরকে আমি ঐদিনই প্রথম দেখি এবং ঐদিন শেষ।
একই সাথে হতাশ ও বিস্মিত হলেন গেরাসিমোভ ও মালিক।
ওদের কথাই যদি ঠিক হয়, তাহলে সব দোষ তো আমারই। না, এই মুখ আমি দেখাতে পারব না। আচ্ছা আমরা যেখানে হন্যে হয়ে খুঁজে অনেক কষ্টে সন্ধান পেলাম তৈমুরের আসল টোম্বটি, সেখানে ওরা এই সব কিছু জানলো কি করে বলতো?
ঃ দুপাতা বিজ্ঞান পড়ে আমরা সব জেনে গিয়েছি মনে করি। বিজ্ঞানের বাইরেও তো অনেক কিছু থাকতে পারে।
ঃ ঠিক, এমনও হতে পারে, বংশ পরম্পরায়ে এই সিক্রেট রক্ষা করছিল কেউ। অথবা কোন গ্রন্থে গ্রন্থিত আছে সব, যা সিলেক্টিভ লোকদেরই পড়া আছে।
ঃ কি যেন লেখা ছিল ডালার ভিতরের ফলকটিতে?
ঃ “Who ever opens my tomb, shall unleash an invader more terrible than I.
ঃ পৃথিবী কি তাহলে নতুন টেররের পদভারে কাঁপছে?
ঃ এডলফ হিটলার। বিংশ শতাব্দির ত্রাস! তার ক্ষমতাশীন হওয়ার সাথে সাথেই অশনী সংকেত শুনতে পাচ্ছিল পৃথিবী। চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে, আমার কারণেই ঘটল সব কিছু, তিন বৃদ্ধের অনুরোধ ও সাবধান বাণী, টোম্বের লেখা, কফিনের ভিতর ফলকের লেখা, কিছুই আমি গ্রাহ্য করলাম না।
ঃ থাক মন খারাপ করোনা। এখন পাপের প্রায়শ্চিত কর।
ঃ কি করে?
ঃ তৈমুরের দেহ তার টোম্বে ফিরিয়ে দাও। পুণরায় সমাহিত কর।
ঃ আর ওঁর মুখচ্ছবি? স্তালিন নিজে আমাকে পাঠালেন!
ঃ স্তালিনকে ফোন কর। পুরো ব্যপারটা খুলে বল। আশাকরি বুঝতে পারবে।
ঃ আরেক টেরর। কি জানি শোনে কিনা আমার কথা।
রাতের বেলায় গেরাসিমোভ ফোন করলেন স্তালিনকে। সব কিছু শুনে কি প্রতিক্রিয়া হলো তার বোঝা গেল না। শুধু বললেন, “আপনি মুখচ্ছবিটি তৈরী করুন” ।
একমনে কাজ করে গেলেন গেরাসিমোভ। এদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। বিংশ শতকের ত্রাস হিটলার বাহিনীর কাছে একের পর এক ব্যাটেলে পরাজিত হচ্ছে সোভিয়েত বাহিনী। এদিকে মনের মধ্য থেকে খুতখুতানি কিছুতেই দূর করতে পারছেন না গেরাসিমোভ। সারাক্ষণ কেবল মনে হয়, এই শোচনীয়তার জন্য দায়ী কবর থেকে উথ্থিত তৈমুরের দেহ আর তিনি। কাজের গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি। অবশেষে তৈরী হলো তৈমুরের মুখচ্ছবি বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো দেখলো লৌহমানব (চাঘতাই ভাষায় তৈমুর শব্দের অর্থ লৌহ) তৈমুরের কঠোর মুখচ্ছবি। যুদ্ধ দিনদিন ভয়াবহ রূপ ধারন করতে শুরু করল, এক পর্যায়ে মালিক কাউমোভা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ঝুকোভ-এর সাথে সাক্ষাৎ করে, তাকে সব কিছু খুলে বললেন। তিনি ঝুকোভকে বোঝাতে সমর্থ হলেন যে তৈমুরের দেহ কবরে ফিরিয়ে দেয়া উচিৎ। অবশেষে তাই করা হলো। ১৯৪২ সালের ২০শে নভেম্বরে পূর্ণ মর্যাদায় ইসলামী রীতি অনুযায়ী তৈমুরের মৃতদেহ পুণরায় দাফন করা হয় গুর-ই-আমীর সমাধীতে (Gur-e-Amir Mausoleum)। ঠিক তার পরপরই স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এলো প্রথম আনন্দ সংবাদ – অপারেশন ইউরেনাস-এ হিটলার বাহিনীকে পরাস্ত করেছে সোভিয়েত বাহিনী। এটিই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট।
যিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন, তার ঘুম ভাঙাতে হয়না।
চঞ্চলা হাওয়ারে,
ধীরে ধীরে চলরে
গুন গুন গুঞ্জনে ঘুম দিয়ে যারে
পরদেশী মেঘ রে, আর কোথা যাসনে
বন্ধু ঘুমিয়ে আছে,
দে ছায়া তারে,
বন্ধু ঘুমায় রে

লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১০
লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১০ (ক)
তৈমুর লং-এর মরদেহ উত্তোলনের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনীটি এক নিশ্বাসে শুনলো সবাই।
ঃ অবিশ্বাস্য (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছে (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ আমার একটা প্রশ্ন আছে (বলল আমীন)
ঃ কি প্রশ্ন বল (বলল রোমান)
ঃ ওটা যে তৈমুর লং-এরই মরদেহ ছিল, তার প্রমান কি।
ঃ আরে রোমান তো বললই অনেক খোঁজাখুজি করে, অনেক বই-পত্র পড়ে তারপর খুঁজে বের করেছে ঐ সমাধীটি। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ না, আমার খটকা দূর হচ্ছে না, ওটা অন্য কারো মরদেহও হতে পারে।
ঃ প্রশ্নটা সঙ্গতই। (বলল রোমান) মিশনের বিজ্ঞানীদের মনেও প্রশ্নটা এসেছিল। তাই তারা শেষ ভেরিফিকেশনটাও করেছিলেন।
ঃ কি সেটা?
ঃ ঐ যে তৈমুর লং-এর নামের মধ্যেই আছে, তিনি ল্যংড়া ছিলেন। যে মরদেহটি তারা পেয়েছিলেন সেটাতো মুলত একটি কঙ্কাল ছিল, তার পায়ের দিকে বিজ্ঞানীরা ভালো করে তাকালেন, সেখানে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন ছিল। এভাবে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, এটা তৈমুর লং-এরই কঙ্কাল।
ঃ এত লোক হত্যা করেছে! টেরর ছিল, ভয়াবহ টেরর!
ঃ আশ্চর্য্য যে তার মরদেহ উত্তোলনের সাথে সাথে আরেক টেররের পদভারে প্রকম্পিত হলো সারা বিশ্ব। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ এডলফ হিটলার। জার্মান রাষ্ট্রনায়ক। (বলল আমীন)
ঃ ভালো ছিল, না মন্দ ছিল? (প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ)
ঃ ভালোই ছিল, ভালোই ছিল সবাই সাপোর্ট করে। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ এই কোন অর্থে ভালো ছিল রে? (প্রশ্ন করল আমীন)
ঃ সব অর্থেই। নিজের জাতি, মানে জার্মান জাতিকে ভালোবাসত। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ এই এতো এতো মানুষ মারল, তার কি হবে? (বলল আমীন)
ঃ মনের আনন্দে তো আর করেনি। বাধ্য হয়ে করেছে। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ কে বাধ্য করল? মানুষ মারতে আবার কেউ বাধ্য করে নাকি? (আবারও প্রশ্ন করল আমীন)
ঃ আরে বাবা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানদের যেভাবে অপমান করাছিল ফ্রেন্চরা। আর যুদ্ধের পর কি পরিমান বোঝা আর অবমাননা চাপিয়ে দিয়েছিল জার্মানদের ঘাড়ে। মনে পড়ে ইতিহাসের শিক্ষক মাজহার স্যার পড়িয়েছিলেন? এত অপমান সহ্য করা যায়? এর ফলে জার্মানরা তো রীতিমতো অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছিল।
ঃ নিজের জাতিকে রক্ষা করতেই হয়তো, হিটলার এই পথ ধরেছিলেন। আমারতো মনে হয় ভালো লোকই ছিল। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ না, যে এতো মানুষ মারে, সে ভালো লোক না। আর তা ছাড়া বই-পত্রে তো লেখাই আছে হিটলার খারাপ লোক ছিল। কি বলিস রোমান? (বলল আমীন)
ঃ বলা মুশকিল। (চিন্তিত মুখে বলল রোমান)। ইতিহাস হলো বিজয়ীদের সম্পদ।
ঃ এর মানে কি? (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ মানে ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে। তাই তারা তাদের মত করেই লেখে। বিজয়ীদের সেখানে ভালো মানুষ মহৎ মানুষ হিসাবে লেখা হয়। আর পরাজিতদের সেখানে খারাপ মানুষ হিসাবে দেখানো হয়। ইতিহাসে রাম হিরো রাবণ ভিলেন।
ঃ হ্যাঁ, বাংলার শিক্ষক শফিক রায়হান স্যার বলেছিলেন। রাবণকে রামায়ণে রাক্ষস হিসাবে দেখানো হয়েছে, আসলে তিনি রাক্ষস ছিলেন না, তার ছিল নান্দনিক চেতনাবোধ। কেবলমাত্র মানুষেরই থাকে নান্দনিক চেতনাবোধ। (বলল আমীন)
ঃ নান্দনিক চেতনাবোধ কিরে? (প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ)
ঃ ও, ভারী শব্দ। আমরাও জানতাম না। শফিক রায়হান স্যার শিখিয়েছেন। (বলল রোমান)। ইংরেজীতে একে বলে Aesthetic Sense মানে সৌন্দর্য্যবোধ।
ঃ তুখোড় শিক্ষক এই শফিক রায়হান স্যার। উনার লেখা বই খুব ভালো মানের। (বলল আমীন)
ঃ তোদের কলেজের শিক্ষক? বই লিখেছেন নাকি? কই নাম শুনিনাই তো কখনো। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ নাম শোনার কথা নয় দোস্ত। লেখক থাকে দুই ধরনের জনপ্রিয় লেখক এবং উচ্চমার্গের লেখক। হুমায়ুন আহমেদের নাম তো শুনেছিস?
ঃ তা শুনব না? এত জনপ্রিয়! উনার লেখা অনেক বই পড়েছি। ইদানিং বিটিভিতে একটা ধারাবাহিক নাটক হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদের ।
ঃ হাঃ হাঃ হাঃ ‘বহুব্রীহি’, ভালো জমিয়েছে। প্রতি অলটারনেট মঙ্গলবারে হয়, মিস করিনা। শুধু আমিনা, সারা বাংলাদেশেই ঐ এক ঘন্টা টিভি সেটের সামনে। (বলল আমীন)
ঃ হুমায়ুন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক, আর শফিক রায়হান স্যার উচ্চ মার্গের লেখক।
ঃ ও আচ্ছা।
ঃ হিটলারের প্রসঙ্গ থেকে তো সরে আসলাম। কি যেন কথা হচ্ছিল হিটলার প্রসঙ্গে? (প্রশ্ন করল মোস্তাহিদ)
ঃ ঐ যে তুই বলছিলি হিটলার ভালো ছিল, আর আমি বলছিলাম খারাপ ছিল। (বলল আমীন)
ঃ আলবত ভালো ছিল। বদমাস ইহুদীগুলোকে কেমন পিটানো পিটিয়েছে দেখেছিস? ব্যাটাদের একটা শিক্ষা হয়েছে।
ঃ আচ্ছা, জার্মানদের গোলমাল ছিল ফ্রেন্চ, বৃটিশ এদের সাথে, হিটলার হঠাৎ ইহুদী পিটানো শুরু করল কেন? (প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ)
ঃ রোমান কিছু বল। আমাদের ইতিহাসবিদ (ঠাট্টা করে মুচকি হাসলো মোস্তাহিদ)।
অন্য কেউ হলে ক্ষেপে যেত। কিন্তু রোমান জানে মোস্তাহিদ ওকে খুব ভালোবাসে। কলেজে যেকোন সমস্যায় যারা রোমানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মোস্তাহিদ তাদের একজন।
বলতে শুরু করল রোমান।
ঃ বিষয়টা আমার কাছেও ঘোলাটে। জার্মানীর সংঘাত যেখানে ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের সাথে, সেখানে ইহুদীদের উপর হঠাৎ ক্ষেপে গেল কেন হিটলার? তবে আমি আব্বার কাছ থেকে নিয়ে একটা বই পড়েছি। হিটলারের নিজের লেখা।
ঃ কি নাম বইটির?
ঃ মাইন কাম্প্ফ (Mein Kampf)।
ঃ জার্মান নাম মনে হচ্ছে, অর্থ কি?
ঃ My Struggle – আমার সংগ্রাম।
ঃ হিটলার নিজে লিখেছে?
ঃ হ্যাঁ।
ঃ বাংলায় অনুবাদ আছে?
ঃ না, আমি ইংরেজীতে পড়েছি। খুব কষ্ট হয়েছে। আব্বা বুঝতে হেল্প করেছে।
ঃ কি আছে ঐ বইতে?
ঃ অনেক কিছুই। হিটলার আত্মপক্ষ সমর্থন করে অনেক কিছু লিখেছে। আবার নিজের লাইফ হিস্ট্রিও কিছু লিখেছে।
ঃ ইন্টারেস্টিং, হিটলারের লেখা বই আছে জানতাম না। তাকে তো শুধু যুদ্ধবাজই মনে হয়েছে। (বলল আমীন)
ঃ সেখানে ইহুদী প্রসঙ্গ এসেছে?
ঃ হ্যাঁ, এসেছে। সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম।
ঃ বল তাহলে। সবাই মনযোগ দিয়ে শুনি।
আবার শুরু করল রোমান।
বই লেখায় হিটলারের তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। তারপরেও তিনি বইটি লেখেন কয়েকটি কারণে। এ প্রসঙ্গে তিনি তার বইয়ে লিখেছেন
১ এপ্রিল ১৯২৪, মিউনিখ গণআদালতের বিচারে লেখ্ নদীর তীরবর্তী ল্যাণ্ডস্বার্গের দুর্গে আমার কারাজীবন শুরু হয়।…গত কয়েক বছরের অমানুষিক পরিশ্রমের পর, আমার ভাগ্যে একটি কাজ করার মত সময় এই প্রথম আসে। অনেক আগেই অনেকে আমাকে এই অনুরোধটি করেছে। আমি নিজেও ভেবেছি যে, আমাদের সংগ্রামের পক্ষে এর মূল্য অনেকখানি। সুতরাং এগুলো ভেবেই আমি বইটি লিখতে শুরু করি।…
…আমি জানি মুখের কথায় যত মানুষকে কাজ করানো যায়, লেখার মাধ্যমে তা’সম্ভব নয়। পৃথিবীতে সংঘটিত প্রতিটি সৎ এবং মহৎ সংগ্রাম জন্ম নিয়েছে মহৎ কোন বক্তার বক্তৃতা থেকে, কোন বড় লেখকের লেখা থেকে নয়। যাই হোক, মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দৃঢ় হাতিয়ার হিসেবে লেখারও প্রয়োজন আছে।…
বইটির বিভিন্ন জায়গায় ছাড়া ছাড়া ভাবে ইহুদী প্রসঙ্গ এসেছে। যা যা তিনি লিখেছেন তার কিয়দংশ আমি তুলে ধরছি
হিটলার নিজেকে আর্য মনে করতেন। তার বইয়ের বিভিন্ন যায়গায় তিনি আর্যদেরকে পৃথিবীর সেরা জাতি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে আর্যরা সৎ ও নিষ্ঠাবান। আর ইহুদীদের সম্পর্কে বলছেন।
ইহুদীরা জাতি হিসাবে আর্যদের সম্পুর্ণ বিপরীত। সারা পৃথিবীতে আর এমন একটি জাতিও নেই যাদের মধ্যে আত্মসংরক্ষণের প্রবৃত্তিটি এত প্রবল। যারা মনে করে তারা ইশ্বর প্রেরিত জাতি। পৃথিবীতে এমন কোন জাতি আছে হাজার বছরের মধ্যেও যে জাতির চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি। আর কোন জাতি সর্বাত্মকভাবে বিপ্লবে অংশগ্রহন করেছে? কিন্তু এত বিরাট পরিবর্তন সত্বেও ইহুদী জাতি যেখানে ছিল সেখানেই আছে। তাদের মনপ্রাণের কোন পরিবর্তন হয়নি। তাদের জাতিগত সংরক্ষণ ও বাঁচার প্রবৃত্তি এমনই দুর্মর।
ইহুদীদের বুদ্ধিগত কাঠামোটা হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে। আজকাল লোকে ইহুদীদের ধুর্ত বলে। অবশ্য একদিক দিয়ে ইহুদীরা বহু যুগ থেকে তাদের ধুর্তামীর পরিচয় দিয়ে আসছে। তাদের বুদ্ধিগত শক্তি ও চাতুর্যের কাঠামোটি তাদের কোন অন্তর্নিহিত বিবর্তনের ফল নয়, যুগে যুগে বাহিরের অভিজ্ঞতা ও ঘটনা থেকে যে বাস্তব শিক্ষা লাড করেছে, তার উপাদানেই গড়ে উঠেছে তার বুদ্ধিগত কাঠামোটি। মানুষের মন বা আত্মা পর পর ক্রমপর্যায়ের স্তরগুলো পার না হয়ে কখনো উপরে উঠতে পারেনা। উপরের যেকোন স্তরে উঠতে হলে আগে তার নিচের স্তরটি অতিক্রম করতে হবে। যে কোন সভ্যতার ক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থে অতীতের একটি জ্ঞান আছে। মানুষের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই তার সকল চিন্তা ভাবনার উদ্ভব হয়। যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত পুন্জিভুত অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষের অধিকতর চিন্তা ভাবনা গড়ে ওঠে। সভ্যতার সাধারণ স্তরের কাজ হলো মানুষকে এমন এক প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করা, যার উপর ভিত্তি করে সে সকলের সঙ্গে জাতীয় উন্নতির ও অগ্রগতির মান এগিয়ে নিয়ে চলতে পারে। যারা আজকের যুগের অগ্রগতিকে বুঝতে চায় ও সেই অগ্রগতিকে অব্যহত রাখতে চায়, তাদের কাছে এইসব জীবন জিজ্ঞাসা গুরুত্বপূর্ণ। গত শতাব্দির দ্বিতীয় দশকের কোন প্রতিভা সম্পন্ন মহাপুরুষ বা মণিষী সহসা তার কবর থেকে যদি উঠে আসেন, তিনি এ যুগের অগ্রগতির কথা কিছুই বুঝতে পারবেন না। অতীতের কোন প্রসিদ্ধ ব্যাক্তিকে এ যুগে এসে এ যুগের গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে তাকে অনেক প্রাথমিক জ্ঞান সঞ্চয় করতে হবে, যে জ্ঞান আজকের যুগের ছেলেরা আপনা থেকে খুব সহজভাবে পেয়ে যায়।
ইহুদী জাতির নিজস্ব কোন সভ্যতা ছিলনা। কেন ছিলনা তা আমি পরে বলব। যেসব সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব বিভিন্ন দেশে চোখে দেখেছে বা হাতের কাছে পেয়েছে – সেইসব কৃতিত্বের দ্বারাই তারা তাদের এ বুদ্ধিবৃত্তিকে উন্নত করেছে। এর উল্টো ঘটনা কখনো দেখা যায়নি।
যদিও ইহুদীদের আত্মোন্নতির প্রকৃতি অন্যান্য জাতি থেকে আরো বেশী প্রবল এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তি অন্যান্য জাতির থেকে কিছুমাত্র কম নয়, তথাপি একটা দিক দিয়ে বড় রকমের একটা অভাব দ্বেখা যায় তাদের জাতীয় চরিত্রে। সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশী দরকার সেই আদর্শবোধ তাদের একেবারেই নেই। ইহুদীদের মধ্যে দেখা যায় তাদের আত্মত্যাগের প্রবৃত্তিটা আত্মসংরক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ব্যাক্তিগত স্বার্থপরতার উর্ধ্বে তারা উঠতে পারেনা কখনো। তাদের মধ্যে যে জাতীয় সংহতি দেখা যায় তা আদিম সঙ্গপ্রবনতা ছাড়া আর কিছু নয়। এটা উল্লেখযোগ্য যে যতদিন কোন বিপর্যয় তাদের জাতীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে দেবার ভয় দেখায়, ততদিনই তারা পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য ঐক্যবদ্ধ ও সংহত থাকে। এই জাতীয় বিপর্যয়ই তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবকে অপরিহার্য্য করে তোলে। একদল নেকড়ে যেমন একযোগে তাদের শিকারের বস্তুকে আক্রমন করার পর তাদের ক্ষুধা মিটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে পৃথক হয়ে পড়ে, ইহুদীরাও ঠিক তাই করে।
ইহুদীরা ছাড়া যদি পৃথিবীতে অন্য কোন জাতি না থাকত তাহলে তারা নিজেরা মারামারি করে একে অন্যকে ধ্বংস করে ফেলতো।
ইহুদীরা সব সময় পরের রাজ্যে বসবাস করেছে, এবং আশেপাশের আরো কিছু রাজ্য দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এইসব রাজ্যগুলোর মধ্যে তারা ধর্ম সম্প্রদায়ের মুখোস পরিয়ে তাদের একটা নিজস্ব রাষ্ট্র গড়ে তুলতো। যখন তারা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠা লাড করে, তখন তারা সে মুখোস খুলে ফেলে আপন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করত, তাদের এই রূপ দেখতে কেউ চায়নি।
যে জীবন ইহুদীরা যাপন করত, সে জীবন হলো পরগাছার জীবন। এইজন্য এক বিরাট মিথ্যার উপর গড়ে উঠেছিল ইহুদীদের জীবন। দার্শনিক শোপেন হাওয়ারের মতে ইহুদীরা বিরাট মিথ্যাবাদি।
লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১০ (খ)
ঃ তাহলে কি তুই বলতে চাস যে, সব ইহুদীই বিরাট মিথ্যাবাদি, ওরা সবাইই খারাপ? (অনেকটাই ক্ষুদ্ধ হয়ে প্রশ্ন করল আমীন)
ঃ আমি আবার কখন কি বললাম? (অধিকতর বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল রোমান)
ঃ ঐ যে হিটলারের বইয়ের অংশ পড়ে শোনালি।
ঃ সেটাই তো বলছি। আমার কথা নয়, হিটলারের কথা।
ঃ আহা রোমান তো ইহুদীদের সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেনি। ও হিটলারের বইয়ে কি লেখা আছে তাই বলছিল। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ ওর মনোভাব একই রকম কিনা সেটা জানতে চাচ্ছিলাম। (বলল আমীন)
ঃ আমার আবার কি মনোভাব হবে? আমি তো এই জীবনে কোন ইহুদী দেখিই নাই। ওদের সম্পর্কে জানতে হলে আমাকে বইয়ের আশ্রয় নেয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। (বলল রোমান)
ঃ বইতো নানা লোকে নানা রকম লেখে।
ঃ তাতো লেখেই। মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে, আবার অভিজ্ঞতারও পার্থক্য থাকে তাই লেখাও ভিন্নরকম হবে এটাই স্বাভাবিক।
ঃ চুপ করে থাকার চাইতে লেখা ভালো। (বলল ইমতিয়াজ) তাহলে সে তার অভিজ্ঞতাটা আর দশজনের সাথে শেয়ার করতে পারে। আমরাও অজানাটা জানলাম। এভাবে জাজ করা আরো সুবিধাজনক হয়।
ঃ আচ্ছা এই যে আমরা ইহুদীদের একতরফা দোষারোপ করে যাচ্ছি সেটা কেমন? তাদেরও তো নিজস্ব কিছু মতামত থাকতে পারে। (বলল আমীন)
ঃ থাকতেই পারে। একবার শুনেছিলাম সেরকম কিছু মন্তব্য, (বলল রোমান)
ঃ কোথায় শুনেছিলি? কি সেই মন্তব্য?
ঃ রেডিও বাংলাদেশের একটি নাটকে।৮২-৮৩ সালের দিকে শোনা । প্যালেস্টাইনে ইস্রাইলীরা বোম্বিং করলে সেখান থেকে প্রাণভয়ে প্যালেস্টাইনি পরিবারগুলো পালিয়ে যায়। এই সময়ে একজন প্যালেস্টাইনি শিশু হারিয়ে যায়। তার বাবা-মা অনেক খুঁজেও আর শিশুটির সন্ধান পায়নি। এদিকে সেই শিশুটিকে খুঁজে পেয়েছিল একটি ইহুদী পরিবার। তারা তাকে লালন-পালন করতে শুরু করে এবং প্যালেস্টাইনি পিতা-মাতার পুত্র একজন ইহুদী সন্তান হয়ে বড় হয়ে উঠতে শুরু করে। একসময় যুবকটি প্রাপ্ত বয়স্ক হয় ও যথানিয়মে ইস্রাইলী সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয়। সে নিজেকে একজন ইস্রাইলী ইহুদি বলেই জানে এবং তার পালক ইহুদী পিতা-মাতার মতই দৃষ্টিভঙ্গী ধারন করতে থাকে। হঠাৎ বিপত্তি ঘটে গেল। তার প্যালেস্টাইনি পিতা-মাতা কোন এক সোর্স থেকে জানতে পারল যে, তাদের পুত্র জীবিত আছে এবং সে এখন একজন ইস্রাইলী সৈন্য। তার তাদের পুত্রকে দেখতে চাওয়ার অনুমতি চাইলে সেই অনুমতি দেয়া হয়। ছেলেটির পিতামাতা তেলআবিবে তাদের পুত্রের সাথে দেখা করতে যান। সেই কথপোকথন ছিল অনবদ্য। এটাকে নরমাল কনভারসেশন না বলে তর্ক-বিতর্ক বলাই ভালো। সেখানে পুত্র নিয়েছিল ইস্রাইলীদের পক্ষ আর পিতা প্যালেস্টাইনিদের পক্ষ।
ঃ কি বলেছিল তারা?
ঃ সেটা আরেকদিন শোনা যাবে। আপাততঃ মেইন কাম্প্ফ-এর কথা শেষ করি। (বলল মোস্তাহিদ)। হ্যাঁ রোমান বলত, আর কি কি হিটলার লিখেছে ইহুদীদের সম্পর্কে?
ঃ শোন তাহলে।
যাতে অন্যের মধ্যে পরগাছা হয়ে থাকতে পারে সেইজন্য ইহুদীরা নিজেদের স্বরূপ প্রকাশ করত না। তারা জানতো ব্যাক্তিগতভাবে তারা যত বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে ততোই তারা অপরকে ঠকাতে পারবে। তারা এতদূর মানুষকে প্রতারিত করতে সফল হতো যে তারা যে জাতির আশ্রয়ে থাকত তাদের এই ধারণা হতো যে তারা যে ইহুদীরা ফরাসী হতে পারে, আবার ইংরেজও হতে পারে। ওদের জাতিভেদ বলে কোন জিনিস নেই। ওদের সাথে তাদের একমাত্র অর্থ ছাড়া অন্য বিষয়ে কোন সার্থকতাই নেই। যে সমস্ত রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রে কার্যরত লোকদের কোন ঐতিহাসিক কাল নেই, ইহুদীরা হলো সেই জাতের। ব্যাভেরিয়া সরকারের অনেক কর্মচারী জানেনা যে ইহূদীরা এক স্বতন্ত্র জাতি, তারা শুধু এক বিশেষ ধর্মমতের প্রতিনিধি মাত্র। কিন্তু ইহুদীদের পত্র-পত্রিকাগুলি একথা মানতেই চায়না। বহু প্রাচীন কালে ইহুদীরা সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে গিয়ে এমন সব উপায়ের আবিষ্কার করে যার দ্বারা তারা যেখানে থাকে সেখানকার মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতিটুকু লাভ করে।
কিন্ত ধৈর্যের ক্ষেত্রেও ইহুদীরা পরের অনুকরন করেছে। তাদের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্র জুড়ে প্রসারিত হয়। ইহুদীদের চেতনা ও অনুভুতি হতে স্বতস্ফুর্তভাবে উড্ভুত কোন ধর্মবিশ্বাস গড়ে ওঠেনি। এই পার্থিব জীবন ও জগতের বাইরে এক মহাজীবনের প্রতি বিশ্বাস ছাড়া কোন ধর্মমতের বন্দনা সম্ভব নয়। ইহুদীদের ধর্মশাস্ত্রে এই মৃত্যুত্তীর্ণ মহাজীবনের কোন কথা লেখা নেই। তাতে শুধু এই পার্থিব জীবন যাপনের জন্য কতগুলি আচরণবিধি লেখা আছে।
ঃ বলিস কি ওদের ধর্মে পরকাল সম্পর্কে কোন কিছু লেখা নাই নাকি?
ঃ আমি বলতে পারব না। ওদের ধর্মগ্রন্থ পড়া নাই।
ঃ কি নাম ওদের ধর্মগ্রন্থের?
ঃ সঠিক জানিনা, তাওরাত হতে পারে।
ঃ কিনে পড়তে হবে। বইয়ের খনি নীলক্ষেতে পাওয়া যাবেনা?
ঃ খোঁজ নিয়েছিলাম, বাংলাদেশে নাই।
ঃ পৃথিবীর সেরা সেরা গ্রন্থগুলোর তো বাংলায় অনুবাদ থাকা উচিৎ।
ঃ এ উদ্দেশ্যেই, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক বাংলা এ্যাকাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একসময় কাজ অনেক হয়েছিলোও। কিন্তু বাংলা এ্যাকাডেমী এখন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না।
ঃ প্রাইভেট সেক্টরে করা যেতে পারে।
ঃ উহু, তা হবার নয়। সব কিছু প্রাইভেট সেক্টরে করা যায়না।
ঃ এরশাদ যে বলে।
ঃ চাচায় অনেক কিছুই বলে। নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত এই ব্যক্তিটির কটা কথার মূল্য দেয়া যায়?
ঃ কেন এই যে বলে, প্রাইভেটাইজেশন হলে ভালো হবে এটা কি ঠিক না।
ঃ এটা ক্ষেত্র বিশেষের উপর নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরের চাইতে সরকারী উদ্যোগের প্রয়োজন অনেক বেশী। শিক্ষা ক্ষেত্র এমন একটি ক্ষেত্র।
ঃ তাহলে এরশাদ চাচা এত ব্যাক্তি মালিকানা, ব্যাক্তি মালিকানা করছে কেন?
ঃ তার উদ্দেশ্য অসৎ। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নাম মাত্র মূল্যে, তুলে দেবে তার চামচাদের হাতে। ফলে তার পদলেহনকারী একটা চামচা গ্রুপ তৈরী হবে, ফলস্বরূপ তার ক্ষমতা মজবুত হবে এই আরকি।
ঃ আরেব্বাস! এক কার্যক্রমের পিছনে কত জটিল-কুটিল থাকে!
ঃ আচ্ছা, বাদ দে। প্রাইভেটাইজেশন আরেকদিন আলাপ করা যাবে। হিটলারের কথা শেষ কর। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ শোন তাহলে। হিটলার আরো লিখেছে (আবার বলা শুরু করল রোমান)
ইহুদীদের ধর্ম শিক্ষার মূল কথা হলো এমন কতগুলো নীতি উপদেশ যার দ্বারা তারা তাদের জাতিগত রক্তের শুচিতা অক্ষুন্ন রেখে জগতের অন্যান্য জাতিদের সাথে মিশতে পারে। ইহুদী অ-উহুদীদের সাথে কিভাবে মেলামেশা করবে তার কথা সব বলা আছে। কিন্তু ইহুদীদের ধর্ম শিক্ষার মধ্যে কোন নীতিকথা নাই, আছে শুধু অর্থনীতির কথা। এই কারণে ইহুদীদের ধর্ম আর্যদের ধর্মের সম্পুর্ণ বিপরীত। এই কারণেই খ্রীষ্টধর্মের প্রবর্তক ইহুদী জাতি সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করে এবং সমস্ত মানব জাতির শত্রু এই জাতিকে ইশ্বরের স্বর্গরাজ্য হতে বিতারিত করে। তার কারণ ইহুদীরা সবসময় ধর্মকে ব্যবসা ও কাজকারবারের কাজে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করত। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে ইহুদী জাতির লোকেরা খৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে, সেই খ্রীষ্টানরা পর্যন্ত ইহুদী জাতির লোকদের কাছে নির্বাচনের সময় ভোট ভিক্ষা করে। এমন কি নাস্তিক ইহুদী জাতির সঙ্গে রাষ্ট্রনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করে সমগ্র খ্রীষ্টান জাতির বিশুদ্ধকরণ করে থাকে।
ইহুদীদের এই ধর্মগত ভন্ডামীর ওপর আরো অনেক মিথ্যা পরবর্তিকালে জমা হতে থাকে। এইসব মিথ্যার অন্যতম হলো ইহুদীদের ভাষা। ইহুদীদের কাছে ভাষা মানুষের মনের গভীর ভাব ও চিন্তা-চেতনার প্রকাশের মাধ্যম নয়। বরং ভাব ও ভাবনা ঢেকে রাখার উপায়মাত্র। ইহুদীরা যতদিন অন্য কোন জাতিকে জয় করতে না পারে, ততোদিন তাদের দেশে গিয়ে তাদের ভাষা রপ্ত করে।
ইহুদীজাতির সমগ্র অস্তিত্বটি যে মিথ্যায় ভরা তার প্রমাণ হলো ইহুদীদের ধর্মশাস্ত্র। কোন্ ধ্যানতন্ময়তা থেকে এই শাস্ত্রের উদ্ভব তা কেউ জানেনা। তবে এর থেকে ইহুদীদের ভাবধারা ও জাতীয় চরিত্রের অনেক বৈশিষ্টের কথা জানা যায়। তার সঙ্গে যে লক্ষ্যের দিকে তাদের সকল জাতীয় কর্মধারা প্রবাহিত হচ্ছে তাও জানা যায়। এমন কি তাদের সংবাদপত্রগুলোও এই শাস্ত্রের কোন মহত্ব স্বীকার করতে চায়না। যে মুহুর্তে বিশ্বের মানুষ এই শাস্ত্র হাতে পাবে তাতে কি আছে তা সব জানতে পারবে, সেই মুহুর্তে ইহুদী জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে।
ঃ দোস্ত তোর কথাগুলো আমার কাছে ভালো লাগছে না। তুই কি এই বলতে চাস যে সব ইহুদী খারাপ।
ঃ আরে জ্বালা। আবারও একই সমস্যা। আমার কথা কোথায়? আমি তো হিটলারের কথা পড়ে শোনাচ্ছি। (বলল রোমান)
ঃ তুই যেরকম আগ্রহ নিয়ে পড়ে শোনাচ্ছিস, আমার মনে হয় তুইও একই মত পোষণ করিস।
ঃ এটা কেমন কথা হলো? ইহুদীদের সম্মন্ধে মত পোষণ করার মত অবস্থানেই তো আমি নেই।
ঃ না থাকার কি আছে!
ঃ আরে আমার এই জীবনে আমি কস্মিনকালেও কোন ইহুদীর সাথে সাক্ষাৎ তো দূরের কথা, চোখেও দেখিনি। তাহলে তাদের সম্পর্কে মত পোষণ করন কি করে বল?
ঃ না দেখলেও মত পোষণ করা যায়। বই-পত্র পড়ে।
ঃ হ্যাঁ, তা করা যেতে পারে। তবে ঐ একই ব্যাপার, এক্ষেত্রে অন্যের মতামতের উপর ভর করতে হয়। তবে মতামতের পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়।
ঃ মতের পার্থক্য হয় কেন?
ঃ এক একজন একেক দৃষ্টিভঙ্গী দি্যে দেখে। তাছাড়া সময় ও অভিজ্ঞতার পার্থক্যও থাকে।
ঃ আচ্ছা তুই আমার প্রশ্নের জবাব দে, সব ইহুদীই কি খারাপ?
ঃ তোকে তাহলে অন্যভাবে বলি, আমরা প্রায়ই কথাবার্তায় পাকিস্তানীদের শাপ-শাপান্ত করি। মূল কারণ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ। আবার ভারতীয়দের প্রতিও ঘৃণা বর্ষণ করি, কারণ – ফারাক্কা সহ বিভিন্ন নদীতে বাধ দিয়ে বাংলাদেশকে কারবালা বানানো, বর্ডার কিলিং, দাদাগিরী ইত্যাদি। তাহলে এখন কি একই প্রশ্ন জাগেনা, যে সব পাকিস্তানী বা সব ভারতীয়ই কি খারাপ?
ঃ হু কঠিন প্রশ্ন। পাকিস্তানীরা যুদ্ধের সময় ব্যপক নির্যাতন চালিয়েছে। নিরীহ-নিরাপরাধ মানুষদের হত্যা করেছে। ভারতীয়রা আমাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কম করছে না। তাই বলে সব পাকিস্তানী তো আর এটা করেনি। অনেকের হয়তো এর সাথে কোন সম্পর্কই নেই। অনুরূপভাবে বাংলাদেশকে কারবালা বানানোর জন্য ভারতীয়দেরও সকলকে দায়ী করা যায়না।
ঃ এই মাত্র ভূমিষ্ঠ হলো যেই ইহুদী শিশুটি, অথবা একজন উদার মনের ইহুদী যিনি কোন প্রকার অপরাধের সাথেই জড়িত নন, তাকে কি খারাপ বলা যা্য?
ঃ ঠিকআছে রোমান তাহলে কি বলব? পাকিস্তানীরা ১৯৭১-এ বাংলাদেশ আক্রমণ করেছিল, না বলব পাকিস্তানীদের একটি অংশ ১৯৭১-এ বাংলাদেশ আক্রমণ করেছিল। অথবা ভারতীয়দের একটি অংশ বাংলাদেশকে কারবালা বানিয়েছে, সীমান্তে নিরাপরাধ মানুষ হত্যা করছে।
কিন্তু আমরা তো এভাবে বলিনা, আর বই-পত্রেও এভাবে লেখেনা।
ঃ আসলে যখন আমরা বলি পাকিস্তানী, ভারতীয় বা ইহুদী, তখন আমরা ওদের কম্যুনিটি বা জাতি সম্পর্কে এ্যজ এ হোল বলি।
ঃ তাহলে এ্যজ এ হোল ইহুদীদের সম্পর্কে কি বলব? ভালো না খারাপ?
ঃ যেভাবে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে, বই-পত্রে তাদের সম্পর্কে যা পড়ছি এসবের ভিত্তিতে তো খারাপই বলতে হয়।
ঃ এরপর হিটলার আরো বলেছেন
ইহুদীজাতিকে ভালোভাবে জানতে হলে, কয়েক শতাব্দী আগে থেকে তাদের গতিবিধির কথা জানতে হবে। তাদের এই গতিবিধির ইতিহাসটিকে কয়েকটা স্তর বা পর্যায়ে ভাগ করে দেখালে ভালো হয়। হিটলার ক থেকে জ পর্যন্ত আটটি পয়েন্টে ভাগ করে তা তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন।
ঃ কি সেই স্তরগুলো?
ঃ ক্ষুধা লেগেছে। ঐ দেখ চটপটির দোকান। আগে চটপটি খাই তারপর বলছি।
সবাই এগি্যে গেল চটপটির দোকানের দিকে
লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১০ (গ)
ঃ চটপটি একটা মজার খাবার তাইনা? (বেশ মজা করে খেতে খেতে বলল মোস্তাহিদ)
ঃ মজার তো নিঃসন্দেহে। তাই তো সবাই হুমড়ি খেয়ে পরি। তোকে চটপটি নিয়ে একটা মজার ঘটনা বলি। (বললাম আমি)
ঃ বান্ধবিকে নিয়ে চটপটি খেতে এসেছিলি, তারপর কি হয়েছিল তাই বলবি তো। (হাসতে হাসতে বলল আমীন)
ঃ বান্ধবি কোথায় পাবো আবার?
ঃ কেন ঐ যে তোর একটা কাজিন আছে।
ঃ আমার কাজিন? (একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। লাবণীর কথা ওরা জানে নাকি? না, নাও হতে পারে। হয়তো ফল্স মারছে। আমার মুখ থেকে কথা বের করার জন্য। সাবধান থাকতে হবে যাতে মুখ ফসকে আবার ওদের কিছু বলে না ফেলি) না, না কোন কাজিন-ফাজিন নেই।
ঃ তাহলে টিউশানি করিস যেই মেয়েটির। ওকে নিয়ে এসেছিলি?
ঃ কি যে বলিস! ও তো ছোট।
ঃ কত ছোট? (মুচকি হেসে বলল ইমতিয়াজ)
ঃ ক্লাস সিক্সে পড়ে।
ঃ ও তাহলে তো অনেক ছোট (হতাশ কন্ঠ আমীনের)।
ঃ কিরে হতাশ হয়ে গেলি নাকি? (এবার মৃদু হেসে বললাম আমি)
ঃ টিউশানি তোর, আমাদের হতাশ হওয়ার কি আছে? তারপরেও একটু বড় দেখে চুজ করতে পারিস না? এই আমাদের বয়সের কাছাকাছি। তুই না হলেও, আমরা না হয় একটু লাইন মারতাম।
ঃ তুই এরকম একটা টিউশানি খুঁজে এনে আমাকে দে।
ঃ আমি পারলে কি আর তোকে বলতাম। শোন মজার ঘটনা – আমি একবার এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। কি করা যায়, কি করা যায়? কাছাকাছি এক সো কল্ড ফকিরের সন্ধান পেলাম। তাকে গিয়ে বলতে সে সাথে সাথেই অনেক কিছু ডিমান্ড করে বসল। সাত ঘাটের পানি চাইল, একটা কালো কুচকুচে ছাগল চাইল, ছাগলটির ছদকা বাবদ আরো কিছু টাকা চাইল, পরিশেষে বলল যে, মেয়েটির মাথার চুল লাগবে। তারপর সে মেয়েটিকে এমনভাবে মোহগ্রস্ত করে ফেলবে যে, মেয়েটি রাতদিন শুধু আমার পিছনে ঘুরঘুর করবে। আমার মেজাজ তো সপ্তমে উঠে গেল, আমি মুখের উপর ভন্ডটাকে বলেই দিলুম, “ব্যাটা, মাইয়ার চুলই যদি আমি যোগার করতে পারতাম, তাইলে কি আর তোর সাথে কনট্রাক্ট করি নাকি?”
হোঃ, হোঃ, হোঃ সবাই কোরাসে হাসলাম।
ঃ রোমানের চটপটির মজার ঘটনাটা তো শোনা হলোনা। বল রোমান (বলল মোস্তাহিদ)।
ঃ কাহিনী অনেক আগের। আমাদের জন্মেরও আগের। মার কাছ থেকে শুনেছি। আমার বড় খালা থাকেন ঢাকার বাইরে। একবার ঢাকায় বেড়াতে এলেন। সবাই বলল, ঢাকাতে একটা মজার খাবার আছে এর নাম চটপটি। বড় খালা বললেন, তাই নাকি খাওয়া তাহলে খেয়ে দেখি”। উনাকে কোথাও নিয়ে চটপটি খাওয়ানো হলো। সবার জন্যে এক প্লেট করে অর্ডার দেয়া হয়েছিল। খাওয়ার পর বড় খালাকে প্রশ্ন করা হলো, “আপা কেমন লাগলো?” তিনি বললেন, “বুঝি নাই, আর এক প্লেট দে”। খাওয়ানো হলো আরো এক প্লেট। দুই প্লেট চটপটি খেয়ে তিনি বললেন, “কি বলিস তোরা চটপটি, চটপটি , কোথায় আমি তো কোন মজা পেলাম না।”
হাঃ, হাঃ, হাঃ, আর এক দফা কোরাসে হাসলাম সবাই ।
ঃ টিউশানি নিয়ে একটা মজার ঘটনা বলি শোন (বলল আমীন)
ঃ বল
ঃ গল্প না কিন্ত, ঘটনাটা সত্যি। রামপুরার ওদিকের একটি মেসে থাকত সজল নামের একটি ছেলে। ছেলেটি শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতায় ছিল একজন ডিপ্লোমা ইন্জিনীয়ার। পাশাপাশি টিউশানিও করত। তো ও মেসের কাছাকাছি একটা বাসায় একটি মেয়েকে পড়াত। মেয়েটি তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। তো যা হয় আরকি। দুজনাই ইয়াং। ধীরে ধীরে একে অপরের প্রেমে পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত মেয়ে তার বাবাকে জানালো, এই ছেলে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। বাবা তো কিছুতেই রাজী হয়না। একে তো মেয়ের বয়স কম। তার উপর ছেলেকে তার পছন্দ হয়নাই। ছেলে পুরো ইন্জিনীয়ার না, সাধারণ ডিপ্লোমা ইন্জিনীয়ার। তার উপর ছেলের লম্বা লম্বা চুল, জীনস্-এর প্যান্ট পড়ে। চোর-ছ্যাঁচড়ের মতো লাগে। সজল তার মেসের মুরুব্বীদের ধরল। “আপনারা একটু আমার পক্ষ থেকে প্রস্তাব নিয়ে যান, একটু বুঝিয়ে বলুন উনাকে।” যাহোক মেসের মুরুব্বীরা সদয় হয়ে মেয়ের বাবার কাছে গেলেন প্রস্তাব নিয়ে। মেয়ের বাবা বলে ছেলের লম্বা লম্বা চুল, চোর-ছ্যাঁচড়ের মতো লাগে। মেসের মুরুব্বীরা বুঝালেন, “না না ছেলে ভদ্র, কোন প্রকার চুরি ছ্যাচড়ামির মধ্যে নাই। লম্বা চুল, জীন্সের প্যান্ট এগুলো জাস্ট ইয়াং ছেলেদের ফ্যাশন আর কি। ও বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।” শেষ পর্যন্ত রাজী হতে বাধ্য হলেন মেয়ের বাবা। কথাবার্তা মোটামুটি ঠিক। বর-কনে দুজনাই খুশী। এবার কেবল অপেক্ষা বিয়ের। এদিকে এক জুম্মাবারে, জুম্মার নামাজে গিয়েছেন মেয়ের বাবা। কাছাকাছি থাকার কারণে ঐ একই মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছে ভাবী জামাতা। নামাজের শেষে বাইরে বেরিয়ে এসে ভাবী জামাতা দেখল তার স্যান্ডেল জায়গা মত নেই। এদিক-সেদিক খোঁজ করেও যখন স্যান্ডেলের খোঁজ পাওয়া গেলনা তখন সে নিশ্চিত হলো যে, তার স্যান্ডেল চুরি হয়ে গিয়েছে। মেজাজ খিচড়ে গেল তার। ভাবল আমার স্যান্ডেল যেমন চুরি হয়েছে, আমিও তেমনি আরেক জনার স্যান্ডেল নিয়ে যাব ব্যাস সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। পাশেই একটি ঝকঝকে নতুন স্যান্ডেল দেখতে পেয়ে ওটিই পড়ে নিল। এদিকে ঐ স্যান্ডেলটি ছিল তার ভাবী শ্বশুড়ের স্যান্ডেল। শ্বশুড় মহাশয় নামাজ শেষে বাইরে এসে তার স্যান্ডেল না পেয়ে ভীষণ হৈচৈ শুরু করে দিলেন।
ঃ দাড়া, দাড়া এটা তুই সত্যি ঘটনা বলছিস, না গল্প? (খটকা নিয়ে প্রশ্ন করল মোস্তাহিদ )
ঃ হাঃ, হাঃ, হাঃ এই সমস্যাটা সব সময়ই হয়। শুরুতেই বলে নেই যে এটা গল্প নয় সত্যি ঘটনা, তার পরেও ঘটনার এই জায়গায় এসে সবাই প্রশ্ন করে, এটা সত্যি ঘটনা কিনা।
বিস্মিত মোস্তাহিদ ও অন্যান্য সবাই বলল
ঃ আচ্ছা কনটিনিউ।
ঃ তারপর শ্বশুড় মহাশয়ের হৈচৈ-এ লোক জড় হয়ে গেল। তিনি গোয়ার্তুমি শুরু করলেন, খুঁজে বের করতেই হবে কে আমার স্যান্ডেল নিল। এদিকে ভাবী জামাতার কপালটা ঐদিন সত্যিই খারাপ ছিল। সে মসজিদের কাছেই দেয়ালে টাঙানো দৈনিক পত্রিকা পড়ছিল। শ্বশুড় মহাশয় খুঁজতে খুঁজতে ঐ পর্যন্ত এসে পেয়ে গেলেন তার স্যান্ডেল। “আরে হ্যাঁ, এই তো আমার স্যান্ডেল”। খেকিয়ে উঠলেন তিনি। এবং তিনি ও বাকী সকলে আবিস্কার করলেন যে, স্যান্ডেলটি তার ভাবী জামাতার পায়ে। হবু শ্বশুড় মহাশয় বললেন, “আমি যে বলেছিলাম, চোর-ছ্যাচড়, ভুল তো কিছু বলিনি, এই দেখেন চোখের সামনেই দেখেন”। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক ছেলেটি কিছু বলার কোন ভাষাও খুঁজে পেলনা। গোয়ার-গোবিন্দ মেয়ের বাবা শেষ পর্যন্ত বিয়েই ভেঙে দিল।
হাঃ, হাঃ, হাঃ, আরও এক দফা কোরাসে হাসলাম সবাই ।
ইমতিয়াজ বলল
ঃ নারে, ঘটনাটা দুঃখজনক। ছেলেটার জন্য খারাপই লাগছে।
ঃ এটা ওর কপালের দোষ বলতে হবে, না হলে এরকম কোইন্সিডেন্স হয়!
ঃ বেচারা ভালোবাসার মেয়েটিকে পেয়েও হারালো!
আচ্ছা রোমান এবার বল ইহুদীদের সম্পর্কে হিটলারের ঐ আটটি পয়েন্ট।
ঃ শোন তাহলে। আমি শুরু করলাম।
জার্মানিয়া নামে অভিহিত প্রথম কয়েকজন ইহুদী আসে রোম আক্রমণের সময়। তারা আসে বণিকের বেশে, আপন জাতীয়তা গোপন করে। ইহুদীরা যখন আর্যদের ঘনিষ্ট সম্পর্কে আসে একমাত্র তখনই তাদের কিছু উন্নতি দেখা যায়।
(ক) স্থায়ী বসতি হওয়া মাত্র ইহুদীরা সেখানে বণিকের বেশে উপস্থিত হয়। তারা তখন সাধারনত দুটি কারণে তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে সমর্থ হয়। প্রথমত তারা অন্যান্য জাতির ভাষা জানত না। একমাত্র ব্যবসাগত ব্যাপার ছাড়া আর কোন বিষয়ে কোন কথা বলতো না বা মিশত না কারো সঙ্গে। দ্বিতীয়ত তাদের স্বভাবটা ছলচাতুর্যে ভরা ছিল বলে কারো সঙ্গে মিল হতোনা তাদের।
(খ) ধীরে ধীরে তারা স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে তারা কোন উৎপাদকের ভূমিকা গ্রহণ করেনি, গ্রহণ করে দালালের ভূমিকা। হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবসা করা সত্বেও তাদের ব্যবসাগত চাতুর্য আর্যদের হার মানিয়ে দেয়। কারণ অর্থনীতির ক্ষেত্রেও আর্যরা সবসময় সততা মেনে চলত। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপারটা যেন ইহুদীদের একচেটিয়া কারবারে পরিণত হয়। তাছাড়া তারা চড়া সুদে টাকা দিতে থাকে। ধার করা টাকায় সুদের প্রবর্তন তাদেরই কীর্তি। এই সুদ প্রথায় অন্তর্নীহিত জটিলতার কথাটা ভেবে দেখা হয়নি, সাময়িক সুবিধার জন্য এ প্রথা তখন মেনে নিয়েছিল সবাই।
ঃ আরে এতো সাংঘাতিক। আমাদের ইসলাম ধর্মেও তো সুদপ্রথার বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে সেই ১৪০০ বছর আগে। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ হিটলার কি তবে কোরান-হাদিস পড়েছিল? (বলল আমীন)
ঃ আমার এক চাচা আছেন, ইকোনমিষ্ট। উনি প্রায়ই অর্থনীতিতে সুদ প্রথার নানা রকম ইমপ্যাক্ট-এর কথা বলে থাকেন আর বলেন ইসলাম ধর্ম ঠিকই বলেছে সুদ খাওয়া হারাম বা নিষিদ্ধ। (বলল ইমতিয়াজ )
আচ্ছা তারপর?
আবারো শুরু করলাম আমি।
(গ) এইভাবে ইহুদীরা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে নিজেদেরকে। ছোট বড় বিভিন্ন শহরের এক-একটা অংশে বসতি গড়ে ফেলে তারা। এক একটা রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে ওঠে এক একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। তারা ভাবে ব্যবসা বাণিজ্য ব্যাপারটাতে যেন একমাত্র তাদেরই অধিকার। আর এই অধিকার বশে প্রমত্ত হয়ে তারা স্বর্ণ সুযোগ নিতে থাকে।
(ঘ) ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য লাভ করলেও ইহুদীরা যুদ্ধের কারবারের জন্য হেয় হয়ে ওঠে জনগণের কাছে। ক্রমে ইহুদীরা ভুসম্পত্তি অর্থাৎ জমি জায়গা নিয়েও কেনাবেচা শুরু করে। তারা অনেক জমি কিনে কৃষকদের খাজনার বন্দোবস্ত করে বিলি করতে থাকে। যে কৃষক তাদের বেশি খাজনা দিত সেই কৃষক জমি চাষ করতে পারত। ইহুদীরা কিন্তু নিজেরা জমি চাষ করতে পারত না। তারা শুধু জমি নিয়ে ব্যবসা করত। ক্রমে ইহুদীদের অত্যাচার বেড়ে উঠলে ঋণগ্রস্ত জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। তৎক্ষনাৎ স্থানীয় অধিবাসীরা ইহুদীদের স্বরূপ বুঝতে পারে। তাদের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। ইহুদীদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোকে তখন তারা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।
চরম দুরাবস্থার মধ্যে পড়ে জনগণ ক্রদ্ধ হয়ে ওঠে এবং ইহুদীদের বিষয় সম্পত্তি কেড়ে নেয়। তখন তারা ইহুদীদের মনে-প্রানে ঘৃণা করতে থাকে এবং তাদের দেশে ইহুদীদের উপস্থিতি বিপজ্জনক বলে ভাবতে শুরু করে।
(ঙ) ইহুদীরা এবার খোলাখুলিভাবে আপন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। তারা সরকারকে হাত করে, তোষামোদ দ্বারা প্রশাসনের লোকজনদের বশিভুত করে টাকা উৎকোচ দ্বারা অনেক অসৎ কাজ করিয়ে নেয়। এইভাবে তারা শোষনের সুবিধা করে নেয়। ক্রুদ্ধ জনগণের রোষে পড়ে তারা একসময় বিতারিত হতে বাধ্য হলেও আবার তারা ফিরে আসে। আবার তারা সেই ঘৃণ্য ব্যবসা শুরু করে দরিদ্র জনগণকে শোষন করতে থাকে।
এ ব্যপারে ইহুদীরা যেন খুব বেশিদূর এগুতে না পারে তার জন্য আইন প্রনয়ন করে কোন ভুসম্পত্তির অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়।
(চ) রাজা মহারাজাদের শক্তি যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ইহুদীরা ততোই তাদের দিকে চলে। তাদের তোষামোদ করতে থাকে। তাদের কাছ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা লাভের চেষ্টা করে। মোটা মোটা টাকার বিনিময়ে রাজা-রাজরাও সেই সুবিধা দিতে থাকে। কিন্তু ধুর্ত ইহুদীরা রাজাদের যত টাকাই দিক, অল্প সময়ের মধ্যেই তারা কম শোষণ করে না। রাজাদের টাকার দরকার হলেই নতুন সুবিধা লাভের জন্যে ইহুদীরা আবার তাদের টাকা দিত। এইভাবে রক্তচোষা জোঁকের মত একধার থেকে সকল শ্রেণির লোককে শোষণ করতো তারা।
এই বিষয়ে জার্মান রাজাদের ভূমিকা ইহূদীদের মতই ছিল সমান ঘৃণ্য। তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই এতখানি উদ্ধত হয়ে ওঠে ইহুদীরা এবং তাদের জন্য জার্মান জনগণ ইহুদীদের শোষণ থেকে মুক্ত করতে পারছিল না নিজেদেরকে। পরে অবশ্য জার্মান রাজারা শয়তানদের কাছে নিজেদের বিক্রি করে বা চিনে নিয়ে তার প্রতিফল হাতে হাতে পায়। শয়তানদের প্রলোভনে তাদের দেশের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তা বুঝতে পারে।
(ছ) এইভাবে জার্মান রাজারা ইহুদীদের প্রলোভনে ধরা দিয়ে শ্রদ্ধা ও সম্মান হারিয়ে ফেলে। শ্রদ্ধা ও সম্মান লাভের পরিবর্তে তাদের ঘৃণা করতে থাকে দেশের জনগণ। কারণ রাজারা তাদের প্রজাদের স্বার্থ রক্ষা করতে সমর্থ তো হয়নি বরং প্রকারান্তেরে দেশের জনগণকে শোষণ করতে সাহায্য করত ইহুদীদেরকে। এদিকে চতুর ইহুদীরা বুঝতে পেরেছিল জার্মান রাজাদের পতন আসন্ন। অমিতব্যায়ী জার্মান রাজারা যে অর্থ অপব্যয় করে উড়িয়ে দিয়েছে, সেই অর্থ যোগারের জন্যে তাদের একজনকে ধরে নিজেদের উন্নতি ত্বরান্বিত করে তুলতো তারা। টাকা দিয়ে তারা বড় বড় সম্পদও লাভ করতে থাকে সমগ্র জার্মান সমাজ দূষিত হয়ে পড়ে ঘরে ও বাইরে।
(জ) এই সময় হঠাৎ এক রুপান্তর দেখা দেয় ইহুদীদের জগতে। এতোদিন তারা সবদিক থেকে তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র ও চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলছিল। কিন্তু এবার তারা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহন করতে থাকে। খ্রীষ্টান চার্চের যাজকেরা এক নতুন মানব সন্তান লাভ করে।
এবার ইহুদীরা জার্মান ভাষা শিক্ষা করতে থাকে। কেন? কারণ তারা জার্মান রাজশক্তির পতন ঘটিয়েছে। এখন আর রাজাদের উপর নির্ভর করে থাকার উপায় নেই। সমাজের সর্বস্তরে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে হলে ঐ দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করতে হবে। সমাজের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হলে চাই ভাষাশিক্ষা। একদিন প্রাচীনকালে বিশ্বজয়ের ও বিশ্বশাসনের যে অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি তাদের গোচর হয়েছিল, তখন সেই সুযোগের অপূর্বক্ষণ এসে গেছে বলে মনে হয় তাদের।
ঃ আরেব্বাস এতো কিছু তো কোনদিনই জানতাম না। এ যে সাংঘাতিক। ইহুদীরা তো ভয়াবহ! (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ হিটলার যা লিখেছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো তাই বলতে হবে। (বলললাম আমি)
ঃ যেভাবে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের মারে তাতে তো শয়তানের সাক্ষাৎ চেলা বলে মনে হয়। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি বিশ্ব রাজনীতির এই কূটিলতা। (বলল আমীন)
ঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমনই জটিল। (বলললাম আমি)
ঃ আচ্ছা আমাদের দেশের প্রতি ইস্রাইলের রাজনীতি কেমন? (প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ)
ঃ আমাদের সাথে তো কোন ডিপ্লোমেটিক রিলেশন নাই। আমাদের পাসপোর্টে দেখবে লেখা আছে All countries except Israel, Taiwan and South Africa। কিন্ত ওরা যা কূটিল কোননা কোন পথে আমাদের প্রতি কোন রাজনৈতিক পলিসি খাটাচ্ছে কিনা?
ঃ আমরা সাধারন মানুষ এতদূর বুঝতে পারিনা।
ঃ তোর বাবা তো নামী সাংবাদিক। উনাকে জিজ্ঞেস করনা।
ঃ হু জিজ্ঞেস করতে হবে বাবাকে।
ঃ ভারতের সাথে ওদের সম্পর্ক কেমন?
ঃ ভালোইতো মনে হয়। ঐযে বলেছিলাম না, ভারতকে পারমানবিক শক্তির অধিকারি হতে ইস্রাইলই সাহায্য করেছিল।
ঃ কেন করল সাহায্য?
ঃ বলা মুশকিল। মুসলিমদের এ্যাগেইনস্ট-এ হতে পারে।
ঃ কি রকম?
ঃ ভারতের দুই দিকে দুই মুসলিম রাষ্ট্র, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।
ঃ আচ্ছা, হিটলারের লেখা পড়ে তো মনে হচ্ছে ইউরোপীয়ানরা ওদেকে ঘৃণা করে। তাই বুঝি হিটলার ওদেরকে ধোলাই দিয়েছে? (প্রশ্ন আমীনের) প্রশ্ন মোস্তাহিদের
ঃ হিটলারের আগে কেউ ধোলাই দিল না কেন? (প্রশ্ন মোস্তাহিদের)
ঃ দিয়েছে, হিটলারের আগেও ইউরোপে বহুবার ইহুদী নিধন হয়েছে। (বললাম আমি)
ঃ তাই নাকি?
ঃ হ্যাঁ, এই সময়ে ওদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল ইসলামী খিলাফত। যখনই ইউরোপে ওদের উপর আক্রমণ শুরু হতো সাথে সাথে ওরা ছুটে এসে আশ্রয় নিত ইসলামী খিলাফতের বুকে।
ঃ আশ্চর্য সেই মুসলমানদেরকেই আজ ওরা নির্বিচারে মারছে!
ঃ একেই বলে বেঈমান!!!
ঔপন্যাসিক এ জে কুইনেল একটা কথা বলেছিলেনঃ
“নৈরাজ্য যেখানে সর্বগ্রাসী, নৈতিকতা সেখানে পরাজিত সৈনিক..”
হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;
ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ ॥
নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী–
কর’ ত্রাণ মহাপ্রাণ, আন’ অমৃতবাণী,
বিকশিত কর’ প্রেমপদ্ম চিরমধুনিষ্যন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
করুণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ এই পর্বটি লিখতে আমি মিথিলা পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত এডল্ফ হিটলার রচিত ‘মাইন কাম্প্ফ’ গ্রন্থের অনুবাদের সাহায্য নিয়েছি। প্রকাশক সোপান আহমেদ ও মিথিলা পাবলিকেশন্স-কে ধন্যবাদ।

লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১১
রমনার সবুজ বুকে দাঁড়িয়ে চারদিকটাকে ছবির মত সুন্দর মনে হলো হঠাৎ। পায়ের নীচে ঘন সবুজ ঘাঁসে ছাওয়া তেপান্তর, ছোট-বড় হরেক রকমের সবুজ গাছে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া চতুর্দিক, তাদের কোন কোনটাতে ভাবী সন্তানের আগমনের ইঙ্গিত, অর্থাৎ ফুটে আছে মন কাড়া সব নানা রঙের ফুলের শোভা, সন্তান বরণ করবার জন্যেই বোধহয় ওগুলোর গোড়ায় জন্মানো সবুজ ঘাঁসের ওপর আল্পনা এঁকেছে ঝরা ফুলের পাঁপড়ি। আর মাথার উপরে উদাসী আকাশটি যেন নীল চাদোয়া, তার ঠিক মাঝখানটাতে একেবারে মাথার উপরেই গনগন করছে মাঝ দুপুরের ঝকঝকে সূর্যটা, এই অপরূপ শোভার মাঝে সদ্য কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য প্রাপ্ত আমরা চারজন নিজেদেরকেই মনে করলাম শিল্পির তুলিতে আঁকা ছবি যেন।
যে বড় গাঁছটির নীচে আমরা বসে ছিলাম, সেটিতেও ফুটে আছে অদ্ভুত একটি ফুল। বেশ মিষ্টি একটা গন্ধ এবং দেখতেও বেশ সুন্দর। ফুলের লাল পাপড়ীর মধ্যেখানে নাগ বা সাপের মতো ফণা তুলে আছে হালকা গোলাপী হলুদে মিশ্র রং এর পুং কেশরের একগুচ্ছ ক্ষুদে পাপড়ী। ফুলটির প্রতি আমি দারুন ভাবে আকৃষ্ট হই। আকারে যেমন বড়, রূপে তেমনি নয়নাভিরাম, সৌরভে মনোহরা। শহরের ভিতর এমন গাছ সচরাচর চোখে পড়েনা। কি নাম গাছটার? বোঝার চেষ্টা করলাম। বুঝতে হলোনা, গাছটির গায়েই নাম লেখা আছে, ‘নাগলিঙ্গম’। এখন বুঝতে পারলাম, এর অপর নাম ‘নাগকেশর’। নামটা আমার খুব ভালো লাগে। নাগলিঙ্গম নামটি তামিল নাম এর বাংলা নামটিই নাগকেশর এই কিছুদিন আগেই আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে একটি উপন্যাস পড়েছি, ‘নাগকেশরের দিনগুলি’। নামটি মোহনীয়, খুলে পড়লাম, ভালো লাগলো। রোমান্টিকতা ও সামান্য যৌনতার ছোঁয়া আছে এমন কাহিনী। আমার এই বয়সে যেমন ভালো লাগে, আরকি। এর ফল দেখতে কামানের গোলার মতো। সে কারণেই ইংরেজিতে এর নাম ক্যাননবল। নাগলিঙ্গমের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চলে। বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis। নাগলিঙ্গম আমাদের দেশে বেশ দুর্লভ। এখানে এর নাগলিঙ্গম নাম হয়েছিল সাপের ফণার মতো বাঁকানো পরাগচক্রের কারণে। নাগকেশরের ফল আমাজান বনের সামান জনগোষ্ঠীর এটি একটি প্রিয় খাবার । এর ফুল, পাতা এবং বাকলের নির্যাস ঔষধ হিসেবে বহুল প্রচলিত। এটি এনটিবায়েটিক, এনটিফাঙ্গাল এবং এনটিসেপটিক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে থাকেন। পেটের পীড়া দূরীকরণে এর ভূমিকা ব্যাপক। পাতা থেকে উৎপন্ন জুস ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে খুবই কার্যকর। দক্ষিণ আমেরিকার সামানরা এর পাতা ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে থাকে। বহুল গুণ সম্পূর্ণ এই উদ্ভিদের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে খুবই কম।
উজ্জ্বল গোলাপি রঙের ফুল। পাপড়ি ছয়টি। বসন্তে যেমন শিমুল গাছতলা ঝরা ফুলে ভরে থাকে, নাগলিঙ্গমের তলাও তেমনি এর অজস্র পাপড়িতে ছেয়ে থাকে। প্রকাণ্ড বৃক্ষ। পাতা লম্বা, ডগা সুচালো। শাখার সঙ্গে প্রায় লেগে থাকে। নাগকেশরের সৌন্দর্য্যে এতটাই মুগ্ধ হলাম যে, মনে হলো, উজ্জ্বলতায় তরুরাজ্যে অনন্য নাগলিঙ্গম ছাড়া বড় কোনো বাগান পরিপূর্ণ হয় না সেই নাগকেশর গাছের নীচেই দাঁড়িয়ে আছি।
ঃ খুব সুন্দর গাছটা! তাইনা (আমীন বলল)
ঃ ফুলগুলো কি অদ্ভুত! (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ আগে কখনো দেখিনি (ইমতিয়াজ বলল)
ঃ দেখার কথা না। এটা বিরল প্রজাতির গাছ। যতদূর জানি সারা শহরে খুব কমই আছে। (বললাম আমি)
ঃ সুন্দর গাছ দেখলে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। (বলল ইমতিয়াজ) তোমাদের ঢাকা শহরে গাছ খুব একটা নেই। আমরা ময়মনসিংহে কিছু বেশি গাছ দেখি।
ঃ এরকম ছিলা না কিন্তু। (আমি বললাম) এক সময় ঢাকাতে অনেক গাছ ছিল। মানুষের বাড়িতে তো অবশ্যই, তার পাশাপাশি, মূল শহরেও গাছের কমতি ছিলনা। এই যে কাছের রাস্তাটি যার নাম এখন কাজী নজরুল ইসলাম এ্যাভিনিউ। এর মাঝখান দিয়ে ছিল চওড়া আইল্যান্ড, পুরো আইল্যান্ড জুড়ে ছিল সারি সারি কৃষ্ণচূড়া। মৌচাক থেকে রামপুরা পর্যন্ত রাস্তাটিও একই রকম ছিল। শেরাটন হোটেলের হোটেলের সামনেও ছিল কৃষ্ণচূড়ার সারি। সারা শহরে এত বেশী কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল যে এটাকে মাঝে মাঝে কৃষ্ণচূড়ার শহর বলা হতো।
ঃ এত এত গাছ সব গেল কোথায়? (প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ)
ঃ এই শেরাটনের সামনে একটা বিশাল বড় গাছ ছিল না? আমার মনে আছে। কি হলো পরে গাছটার? (প্রশ্ন করল আমীন)
ঃ হ্যাঁ, ছিল। (একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি)। সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম আমি। গাছগুলো কাটা হয় ‘৭৮-‘৭৯ সালের দিকে।
ঃ কিন্তু কেন?
ঃ ঢাকা শহরে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। রাস্তা চওড়া করার প্রয়োজন পড়ল। তাই আইল্যান্ড তুলে দিয়ে রাস্তাগুলো চওড়া করা হয়। সবুজ ঘাসের জায়গা দখল করে নিল, কালো পিচ।
ঃ এটা কি অন্য কোনভাবে করা যেত না? সিটি এক্সপানশন কি কেবল উর্ধ্বমূখী করতে হবে?
ঃ জানিনা, যারা করে তারা বলতে পারবে।
ঃ আর শেরাটনের সামনের গাছটি? ওটা কেটে তো রাস্তা চওড়া করা হয়নি, ওটার কি দোষ ছিল?
ঃ আসলে রাস্তা চওড়া করা একমাত্র কারণ নয়। আব্বা বলেছে প্রচ্ছন্ন আরো একটি কারণ ছিল।
ঃ কি সেটা?
ঃ সেই সময়ে কম্যুনিস্ট সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এরা উঁচু গাছের উপরে বসে থাকত। ডানপন্থী শাসকদের গাড়িবহরে ঢিল মারত। কখনো সখনো অস্ত্র নিয়েও বসে থাকত। পরিস্থিতি ভয়ংকরই ছিল বলা যেতে পারে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই অনেক স্ট্রাটেজিক জায়গায় গাছ কাটতে হয়েছে। শেরাটনের সামনে, কোনার দিকে, ঐ তিন রাস্তার মোড় যেখানে এখন একটি প্রপাত টাইপের ফোয়ারা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ছিল ঐ বিশাল গাছটি। পুরো মোড়টি ঢেকে রাখতো তার বিশাল গাছপালা, বিদেশীরা তো নিঃসন্দেহে আমরা বাংলাদেশীরাও ঐ গাছটির বিশালত্ব দেখে মুগ্ধ হতাম। সেই গাছটি হঠাৎ কাটা শুরু হলো। প্রকৃতি প্রেমিকরা অনেক প্রতিবাদ করেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র মন কাড়া একটা কবিতাও লিখেছিল ঐ গাছটি নিয়ে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
শেষ পর্যন্ত গাছটি কাটাই হয়েছিল। গাছটি বিশাল বলে কাটতে কয়েকদিন সময় লেগেছিল। আমার বুকে ঘটনাটি ক্ষত সৃষ্টি করেছে কারণ গাছটি কাটার দিন আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোন এক কারণে আব্বা ঐ দিন ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল, আমি আব্বার সাথে ছিলাম। গাছ কাটা দেখে আব্বা সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা দু’জন অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে হত্যা করার ঐ দুঃখজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলাম।
ঃ কি নাম ছিল গাছটির?
ঃ নাগকেশর।
এই দুঃখজনক ঘটনা শুনে সবই বিমর্ষ হয়ে গেল।
ঃ নাঃ! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ তোদের মন ভালো করে দেই? (বলল আমীন)
ঃ কি করে? (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ ঐ দেখ।
একটু সামনেই দুপাশে ঝাউ গাছের শোভা নিয়ে ঢালাই করা পার্কের পথ। ভর দুপুর বলে প্রায় খালি। হঠাৎ সেই পথ ধরে হেটে আসতে দেখলাম এক অপরূপা তরুণীকে।
সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হলুদ রঙের ফ্যশনেবল সালোয়ার কামিস পড়া। এরকম সালোয়ার-কামিসের ডিজাইন আজকাল হিন্দী ফিল্মগুলোতে দেখা যায় বোম্বের নায়িকাদের পড়নে। মেয়েটির পায়ে বাহারি পেন্সিল হিল। কাট কাট শব্দ তুলে হেটে যাচ্ছে। এই কাট কাট শব্দ শুনলে যে কোন পুরুষেরই দৃষ্টি ঐ দিকে চলে যায়। আশেপাশের বাতাসে ঢেউ তুলে মেয়েটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেল। খুব সম্ভবতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই গেল। ওখানকার ছাত্রী হবে হয়তো। যতক্ষণ মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছিল, আমরা দেখছিলাম, দূরে মেয়েটির মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত।
চাপা কৌতুকে চিকচিক করছে আমীনের চোখ।
ঃ তোদের একটা কৌতুক বলি? (বলল আমীন)
ঃ বল (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ একবার সাদা জোব্বা পরিহিত, টুপি মাথায় তিন মোল্লা যাচ্ছে পথ দিয়ে, প্রথম জনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, দ্বিতীয় জনার বয়স চল্লিশোর্ধ, আর তৃতীয় জন একেবারেই তরূণ বছর বিশেক বয়স। হঠাৎ অপরূপা এক অষ্টাদশী তরুণী গেল তাদের সামনে দিয়ে। তার রূপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে প্রথম মোল্লা বলল, “মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ”, দ্বিতীয় মোল্লা বলল, “সোবাহানাল্লাহ, সোবাহানাল্লাহ”, আর তরুণ মোল্লাটি বলল, “ইনশল্লাহ, ইনশল্লাহ”।
সবাই হেসে উঠলাম।
ঃ উহ্, খালি খালি মোল্লাদের বদনাম না? (ক্ষেপে গেল মোস্তাহিদ)
ঃ আহা এটা একটা কৌতুক মাত্র, তুই সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ খালি খালি না, তোদের মোল্লারা সব ঐ কিসিমেরই। (ঘাঁড় বাকিয়ে বলল আমীন)
ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ শুধু মোল্লাদের দোষ। আর আমরা? আমরা কি মেয়েটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকিনি?
ঃ তা তো তাকিয়েছিই। (একটু দমে গিয়ে বলল আমীন)
ঃ তাহলে?
ঃ আরে এটা বয়সের দোষ। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ না, বয়সের গুন (বললাম আমি)
এবার সবাই হেসে উঠল। আসলেই তো সুন্দরী তরুণী সামনে দিয়ে গেলে তরুণরা তাকিয়ে দেখবে এটাই তো স্বাভাবিক।
ঃ তোদের মোল্লারা মাদ্রাসায়, ঘোড়ার ডিম পড়ে। (আবার একটু কটাক্ষ করল আমীন)
ঃ কেন ঘোড়ার ডিম কেন? আধ্যাত্মিক লেখাপড়াকে ঘোড়ার ডিম বলছিস কেন? (আবারও প্রতিবাদ মোস্তাহিদের)
ঃ ঘোড়ার ডিম না তো কি? ঐ পড়ে ঘোড়ার ঘাস কাটা ছাড়া আর কি করতে পারবে?
ঃ নামাজ-রোজা, মিলাদ শরীফ ধর্মীয় কাজ কর্মকে তোর কাছে ঘোড়ার ঘাস কাটা মনে হয়?
ঃ অবশ্যই ঘোড়ার ঘাস কাটা। উৎপাদনের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে? এই আমাদের মুসলমানগুলোর মাথার মধ্যে কেরা পোক আছে। এইজন্যই আরবগুলা জোব্বা পড়ে উটের পিঠে চড়ে মরুভূমীতে বেহুদা ঘুরে বেড়ায়, আর ইতিউতি তাকায় কোথায় কোন রমনি দেখা যায় যাতে তিসরি শাদি মোবারকটা করা যায়।
ঃ এই, এই এটা কিন্তু বেশী হয়ে গেল। (ক্ষেপে গেল মোস্তাহিদ)। আর ঐ আরবদের দ্বারে দ্বারে তোমরা বাঙালীরা ভিক্ষা কর।
ঃ (একটু দমে গেলেও উত্তর দিন আমীন) ভিক্ষা করতাম না। ওরাই ভিক্ষা করত শুধু তেল থাকাতেই বেঁচে গেছে। আর ঐ তেলের কারণেই শালারা আজ দাঁত কেলিয়ে হাসে।
ঃ আরে থামাও তো তোমাদের ঝগড়া। (বলল ইমতিয়াজ)। কই আরব আর কই মোল্লা এই সব নিয়ে আমরা বন্ধুরা বন্ধুরা ঝগড়া করছি।
ঃ উহ্। তেলের টাকায় তেল হয়েছে ওদের। (আবারও খেকিয়ে উঠল আমীন)। বল, তিন-চারটা বিয়ে করা ছাড়া, মুসলমানরা কোনকালে কোন অবদান রাখতে পেরেছে?
এবার আর থেমে থাকতে পারলাম না আমি। বললাম
ঃ নারে, আমীন। এমন ধারণা ঠিক না। মুসলমানরা মানব সভ্যতায় অনেক অবদানই রেখেছে।
এবার সবার দৃষ্টি গেল আমার দিকে। বিভিন্ন বিষয়ে জানার চেষ্টা করি বলে ওরা আমার কথা বরাবরই মনোযোগ দিয়ে শোনে।
ঃ বলত, বলত (উৎসাহ নিয়ে বলল মোস্তাহিদ)
আমি শুরু করালাম
ঃ আমাদের মানব সভ্যতার উন্নয়নে বেশ কয়েকটি যুগ এসেছে, এদের মধ্যে একটি হলো Islamic Golden Age – ইসলামের স্বর্ণ যুগ।
ঃ কবে থেকে শুরু হয়েছিল এটা?
ঃ ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে।
ঃ কিসের সাথে মিল আছে যেন সালটির?
ঃ আমাদের নবীজি (স) জন্মগ্রহন করেছিলেন ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে, আর নবুয়ত পেয়েছিলেন ৪০ বৎসর বয়সে। ৫৭০ যোগ ৪০ সর্বমোট ৬১০।
ঃ ও হ্যাঁ তাইতো! চমৎকার হিসাব। তারপর?
ঃ ইউরোপ তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। ক্যাথলিক চার্চের অনুশাসনে শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি। চার্চ তখন সারা ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা বন্ধ করে দিয়েছে। এ সময়ে মানব জাতির ত্রাণকর্তা হিসাবে আবির্ভুত হন, আমাদের নবীজি (স)। তিনি এসেই সব চাইতে বেশী গুরুত্ব দিলেন লেখাপড়া ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়। তোরা তো জানিস হেরার গুহায় অনেকগুলি বছরের ধ্যানমগ্নতা থেকে তিনি পেলেন ঐশী বাণী, পবিত্র কোরান। যার শুরুটাই হলো, “ইকরা —-“, মানে “পড়….”। তিনি বললেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর জন্যে ফরজ।” যখন ইউরোপে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল, তখন নবীজি নারীদের বাধ্য করলেন শিক্ষা গ্রহন করতে।
ঃ ইউরোপে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল নাকি? (প্রশ্ন আমীনের)
ঃ ছিল তো।
ঃ তারপর বল (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ নবীজি (স) আরো বললেন, “জ্ঞান অর্জন করতে হলে ……।
আমি শেষ করার আগেই সবাই সমস্বরে আমার সাথে গলা মিলালো
” প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও”
ঃ হঠাৎ চীনের কথা বললেন কেন?
ঃ খুব সম্ভবত দুটি কারণে, এক, চীন তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অনেক উন্নত ছিল দুই, চীন অনেক দুর্গম ছিল। অর্থাৎ জ্ঞান চর্চা করতে হলে উন্নত দেশে যাও, সেটা যত দুর্গমই হোক না কেন।
ঃ আচ্ছা এখন ইসলামিক গোল্ডেন এজ সম্পর্কে বল (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ এটা অনেক বিশাল। অল্প কথায় শেষ করা যাবেনা। শুধু এইটুকু বলি যে ৬১০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ছিল এই যুগ। এই কয়েক শতাব্দী দীর্ঘ এই সময়ে শত শত মুসলিম মণিষী মানব জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অভূতপূর্ব অবদান রেখে মানব সভ্যতাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
ঃ শত শত মুসলিম মণিষী! নাম বলত কয়েক জনার (উষ্মা জড়িত কন্ঠে বলল আমীন)
ঃ আল বিরুণী, আল তুসি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, আল কিন্দি, আল জাবির, আল খাওয়ারিজিমি, আল রাজী, আল হাসান ইবনে আল হাইয়াম, ইবনে খলদুন, তকি-আল-দিন এমনি আরো অনেকে চিকিৎসা থেকে শুরু করে ফিজিক্স পর্যন্ত বহু বিষয়ে তাদের অবদান অনস্বীকার্য্য।
ঃ আল বিরুণীর নাম তো শুনেছি। গণিতবিদ ছিলেন।
ঃ ওমর খৈয়ামের আবার বিজ্ঞানে কি অবদান? কবি ছিল জানি। ঐ যে লোচ্চার মত সুরা ও সাকী নিয়ে কি কি সব কবিতা লিখেছেনা? (আবারও উষ্মা নিয়ে বলল আমীন)
ঃ তোর আবারও সেই ইসলাম বিরোধী মনোভাব। (বলল মোস্তাহিদ)। খৈয়ামের রুবাইয়াত পড়েছিস?
ঃ রুবাইয়াত পড়া লাগেনা। শুনেছি, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, …।” এই সব হাবিজাবি।
ঃ ও, না পড়েই পন্ডিত! হুইন্যা মাতব্বর! (এবার ঠেস দিয়ে বলল মোস্তাহিদ)
ঃ রুবাইয়াৎ বিশ্বসেরা কাব্য ।পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তা বহু আগেই অনুদিত হয়েছিল। আমাদের দেশে প্রথম অনুবাদ করেছিলেন সম্ভবতঃ কাজী নজরুল ইসলাম। তাছাড়া ওমর খৈয়াম কেবলই কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন পলিম্যাথ। (বললাম আমি)
ঃ পলিম্যাথ আবার কিতা? (প্রশ্ন করল আমীন)
ঃ পলিম্যাথ মানে যিনি একই সাথে অনেক বিষয়ে পান্ডিত্য রাখেন। ওমর খৈয়াম ছিলেন এমনই একজন। তিনি একাধারে ছিলেন দার্শনিক, গণিতবিদ ও জোতির্বিদ। পাটিগণিত ও জ্যামিতিকে সমন্বয়কারী যে কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় ওমর খৈয়ামই তার প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া তিনি মেকানিক্স, ভূগোল, খনিজবিজ্ঞান, সঙ্গিত এবং ইসলামী থিওলজী-র উপর একাধিক গবেষণামূলক গ্রন্থ (treatises) লেখেন।
ঃ এবার বুঝলে বাছাধন, মুসলমানদের অবদান কতখানি! (আবারো ঠেস দিল মোস্তাহিদ)
ঃ হুঁ (রিকোগনাইজ না করার ভঙ্গিতে বলল আমীন)। ঐ কিছু বই-পত্র লেখা আর কি। বিজ্ঞান? আধুনিক বিজ্ঞান তো ইউরোপীয়দের সৃষ্টি, নিউটন, গ্যালিলিও, বেকন ওরাই তো স্টার।
ঃ না ওদের অনেক আগেই মুসলমানরাই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করে। Islamic Golden Age সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে আজ থাক আরেকদিন বলব। আজ শুধু একটা বিষয়ে বলি।
ঃ বল বল, বলে ওর থোতা মুখ ভোতা করে দে। (ক্ষেপে গিয়ে বলল মোস্তাহিদ)
রাগত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো আমীন।
ঃ না না এভাবে বল না, বল ওর ভুল ভাঙিয়ে দিতে। (বলল শান্ত স্বভাবের ইমতিয়াজ)
ঃ আধুনিক বিজ্ঞানে একটি মেথড আছে। তাকে বলা হয় Experimental Scientific Method এরিষ্টটল বলেছিলেন বিশুদ্ধ চিন্তা থেকে থিওরী তৈরী করা যায়। অর্থাৎ বিজ্ঞানের মধ্যে পরীক্ষার বিষয়টি তিনি ভাবেনই নি। এদিকে কোন সত্য যাচাইয়ের জন্য তা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করা উচিৎ এই ধারণাটি প্রথমবারের মত ইনট্রোডিউস করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা ।
বিভিন্ন বইয়ে বিষয়টি এইভাবে পাওয়া যাবে – Reaching the rational experimental scientific method – based on induction and measurement, as well as sighting, experiment and representation – is considered an important Islamic addition to the march of science worldwide.
Such a method is completely different from that of the Greek, Indians or others, as such civilizations used often to content themselves with assuming theories without attempting to scientifically prove them. They were almost theoretical philosophies that are not applied in most cases even if they were true.
পুর্ববর্তি সকল থিওরীকে মুসমান বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণের সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন। কে বা কত খ্যাতিমান ব্যাক্তি এই এই থিওরীর জনক ঐদিকে নজর না দিয়ে তারা থিওরীগুলোতে এক্সপেরিমেন্টাল মেথডের প্রয়োগ ঘটান। এর ফলস্বরূপ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সত্য মেনে আসা অনেক থিওরীই ভুল প্রমাণিত হয়।
এবং তারা ঐ থিওরী কেবল ভুল প্রমাণ করেই ক্ষান্ত হননি। পাশাপাশি তারা নতুন এ্যসাম্পশন করে আবারো এক্সপেরিমেন্টাল মেথড প্রয়োগ করে নতুন থিওরী তৈরী করেন। এই করতে গিয়ে তারা আগ্রহের সাথে অজস্র এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন।
মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে যারা এই সকল এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনার নাম উল্লেখ করছি। জাবের ইবনে হাইয়ান – আধুনিক রসায়নের জনক বলেছেন – “… and the perfection of that making is science and experiments; he who did not work or carry out experiment never won anything.”। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-খাওয়াস-আল-কাবির'(The Great Book of Properties)-এ তিনি বলেছেন, “এই বইয়ে আমি ঐ সমস্ত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি যা আমরা কেবল শুনিনাই বা দেখিনাই বা পড়িনাই বরং যা পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। যা সত্য হিসাবে গৃহিত হয়েছে কেবল সেটাই প্রকাশ করছি, আর যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে তা বর্জন করছি”।
এভাবে জাবের ইবনে হাইয়ান ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি laboratory scientific experiment ইনট্রোডিউস করেন। তিনি মাঝে মাঝে Experiment-কে The Experience বলতেন। তিনি আরো বলেছেন, ” যিনি Experience করলেন না তিনি বিজ্ঞানী নন, বরং যিনি Experience করলেন তিনিই বিজ্ঞানী, যেকোন ইন্ডাস্ট্রীতে Experienced maker হলো দক্ষ আর inexperienced হলো অলস।”
আল রাজী ছিলেন প্রথম ডাক্তার (physician) যিনি যেকোন চিকিৎসা প্রথমে পশুদের উপর প্রয়োগ করে পরীক্ষা করতেন। যোকোন ঔষধ বা চিকিৎসা মানুষের উপর প্রয়োগের আগে পশু বিশষতঃ বানরের উপর পরীক্ষা চালাতেন। তিনি বলেছিলেন, “যদি কোন থিওরী পরিক্ষার দ্বারা ভুল প্রমাণিত হয় তবে সেটাকে ভুলই মেনে নিতে হবে সেই থিওরী যত খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর দ্বারাই সৃষ্ট হোক না কেন।”
আল-হাসান-ইবনে-আল-হাইয়াম ১১ শতকের বিজ্ঞানী যাকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, তিনি এক্সপেরিমেন্টাল মেথডের সফল প্রয়োগ করেন। তার লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘কিতাব-আল-মানাযির'(A book on Optics) অজস্র এক্সপেরিমেন্টাল মেথড প্রদর্শন করেন। তিনিও একজন পলিম্যাথ ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন গণিতবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী ও প্রজ্ঞী। তিনি তার কিছু লেখায় ইউক্লিড ও টলেমির সমালোচনাও করেন। ইউরোপে তিনি আল হাযেন নামে পরিচিত, তাকে দ্বিতীয় টলেমিও বলা হয়। তিনি induction ও syllogism গ্রহন করেন এবং আনালজি-র দিকেও মনযোগ দেন। এভাবে তিনি ১৭শতকের ফ্রান্সিস বেকন আল হাযেনকেই অনুসরন করেন।
এভাবে মুসলিম বিজ্ঞানীরাই মানব জাতিকে প্রথম দেখিয়েছেন Experimental Scientific Method-এর মাধ্যমে কিভাবে সন্দেহ ও মায়া(illusion)-কে কাটিয়ে উঠে থিওরীকে যাচাই করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
ঃ বুঝলাম Experimental Scientific Method ভালো জিনিস। মুসলমানরা ইনট্রোডিউস করেছে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? খোনকার মোল্লা তৈরীর মাদ্রাসা ছাড়া আর কিছু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে মুচলমানেরা। (ইচ্ছা করেই ‘ছ’ এর জায়গায় ‘চ’ ব্যবহার করল আমীন)।
ঃ কি বলিস (বললাম আমি), আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও মুসলমানরাই।
ঃ কেন, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছিলনা?
ঃ ছিল। কিন্তু সেগুলো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নয়। সেখানে মুলতঃ ধর্ম শিক্ষা দেয়া হতো। ইউরোপে এরকম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া হতো ক্যাথলিক খ্রীষ্টান ধর্মীয় শিক্ষা, আর আমাদের এখানকার ময়নামতি, নালন্দা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেয়া হতো বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা।
ঃ আর মুসলমানরা কিধরনের বিশ্ববিদ্যালয় চালি করে?
ঃ যেখানে আধুনিক সাবজেক্টগুলো অর্থাৎ রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা শাস্ত্র, আলোকবিজ্ঞান, জোতির্বিদ্যা, প্রকৌশল, দর্শন, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি পড়ানো হয়।
ঃ কোথায় তা চালি করা হয়েছে শুনি?
ঃ বেশ কয়েকটি জায়গায়, যেমন বাগদাদের বায়তুল হিকমা (House of Wisdom), কায়রোর আল আজ হার বিশ্ববিদ্যালয়, কর্ডোভা ও তালাআদের বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি।
ঃ তাহলে আমাদের মুসলমানদের আজ এমন করুন অবস্থা কেন?
ঃ সে অনেক কথা, তবে এই উপমহাদেশ সম্পর্কে এক কথায়ই বলব, এর কারণ বৃটিশ শাসনামল।
ঃ কি করল তারা। আর তারা আসার আগেই বা কোন ঘোড়ার ডিম ছিল?
ঃ তারা আসার আগে অনেক কিছুই ছিল। আমরা স্বাধীনতা হারাই ১৭৫৭ সালে পলাশীর ট্রাজেডিতে। তার আগে আমাদের এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হতো নিসঃন্দেহে।
ঃ কে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করত, সিরাজউদ্দৌলা? ওতো একটা লোফার ছিল। (বলল আমীন)
ঃ না, প্রথম কথা সিরাজউদ্দৌলা লোফার ছিল না। এগুলো সবই ইংরেজদের প্রচারণা। তিলকে তাল করা হয়েছে। তিনি খুব কাঁচা বয়সের ছিলেন। কোন কোন সোর্স থেকে পাই, তার বয়স ছিল উনিশ বছর আবার কোথাও কোথাও লেখে, তার বয়স ছিল একুশ বছর। যাহোক বেশিটাই যদি ধরি অর্থাৎ একুশ হলেও তো খুবই কম বয়স। ঐ কাঁচা বয়সে একটু-আধটু নারী আসক্তি থাকতেই পারে।
ঃ সেটাই বা থাকবে কেন?
ঃ থাকবে কেন? ঐ যে একটু আগে হলুদ পরীটার দিকে তুমি যেমন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে তেমনি কারণে। (আবারো ঠেস দিল মোস্তাহিদ)। আর তোমার এক মামা আছেনা? ঐ যে এরশাদের পদস্থ আমলা, তার সাথে খুব দহরম-মহরম। এই চল্লিশ বছর বয়সেও তো ইটিশ-পিটিশ করে। গভীর রাতে খেয়ে ফুল হয়ে ঢাকা ক্লাব থেকে বের হয়।
ঃ আসলে সেটা বড় কথা না। সিরাজউদ্দৌলা তার নানা ইংরেজদের পিলে কাঁপানো কঠোর শুশাসক আলিবর্দী খানকে মৃত্যু শয্যায় কথা দিয়েছিলেন আর কোনদিন তিনি শরাব স্পর্শ করবেন না। তিনি বাকী জীবন কথা রেখেছিলেন। দেশকেও তিনি ভালোবাসতেন, প্রজাহিতৈষী ছিলেন। একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখ সেই চরম সংকটে, ঐ একুশ বছরের যুবকই তো ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে, আর এই দেশের জন্যই তিনি প্রাণ দিয়েছিলেন।
ঃ দেশের জন্য না। ধরা পড়ে নিহত হয়েছিল। (জোড় দিয়ে বলল আমীন)
ঃ না, তিনি কাপুরুষের মত পালাচ্ছিলেন না। বীর যোদ্ধা আলিবর্দী খান-এর সাথে একাধিক যুদ্ধে সিরাজ অংশ নিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। প্রাণ ভয়ে লেজ গুটানোর মানুষ তিনি ছিলেন না। তিনি পাটনা যাচ্ছিলেন সৈন্য-সামন্ত জোগাড় করে আবারও যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু আমাদের কপালের দোষ, তিনি ধরা পড়লেন ও নিহত হলেন। তাকে জনসমক্ষে বিচার করে জনমত যাচাই করে ফাঁসি দেয়া হয়নি। মীরজাফরের আপত্তি সত্ত্বেও ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে মিরনের নির্দেশে কাপুরুষের মত তাকে হত্যা করে সিরাজের সাথে একই থালায় ভাত খাওয়া বেঈমান মোহম্মদী বেগ। আমাদের কপালের লিখন, আমাদের নবাবকে বাঁচাতে পারলাম না। আর এর খেসারত আমাদের দিতে হয়েছে পরবর্তি দু’শো বছর।
মোস্তাহিদের চোখে জল চলে এলো। ভারী কন্ঠে সে বলল,
ঃ আমার দাদা বলেছে। সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে কলকাতায় একটা মনুমেন্ট তৈরী হয়েছিল। তার নাম ছিল হলওয়ের মনুমেন্ট। পরবর্তিতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে, ৩রা জুলাই, ১৯৪০ এ হলওয়ের মনুমেন্ট অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিলেন । বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানেরা এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে ইংরেজদের বাধ্য করে ঐ হলওয়ের মনুমেন্ট তুলে নিতে।
ঃ আচ্ছা এখন বলো আলিবর্দী-সিরাজউদ্দৌলার সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেমন ছিল। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা আলিবর্দী খান শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। শিক্ষার প্রতি তার প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। তিনি শিক্ষিতদের সমাদর করতেন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার আমলে বাংলার ফার্সী সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-এর বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেন তাবাতাবাই লিখেছেন, নবাব আলিবর্দী খান প্রতিদিন দুই ঘন্টা আলেমদের সাথে জ্ঞানালোচনা করে কাটাতেন। মুহম্মদ আলী ফাজিল, হাকিম হাদী আলী খান, নকী কুলী খান, মির্যা হোসেন সেসেবি এবং আরো অনেক পন্ডিত ব্যাক্তি এই আলোচনায় যোগ দিতেন।
মুহম্মদ আলী ফাজিল ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। হাকিম হাদী আলী খান চিকিৎসা শাস্ত্রে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাকে সে যুগের গ্যালেন আখ্যায়িত করা হয়েছিল। হাকিম তাজুদ্দিন মুর্শিদাবাদের আরেকজন বড় চিকিৎসা বিশারদ ছিলেন। কাযী গোলাম মুজাফফর, মুহম্মদ হাযিন, শাহ মুহম্মদ হাসান, আবুল কাশিম ও সৈয়দ মুহম্মদ আলী সেই সময়ের খ্যাতনামা পন্ডিত ছিলেন। ইতিহাস লেখক ইউসুফ আলী নবাবের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাক্ষেরীণ’ রচয়িতা গোলাম হোসেন তাবাতাবাইও নবাব আলীবর্দী ও সিরাজউদ্দৌলার অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। নবাব আলীবর্দী এতই সুশাসক ছিলেন যে তার সময়ে বাংলা ঐশ্বর্য্যশালী হয়ে উঠেছিল। সেই ঐশ্বর্য্যশালী বাংলাকে রক্ষা করারই প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন তার আদরের নাতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা মনসুর-উল-মুল্ক। কিন্তু গুটিকতক বেঈমানের হঠকারিতায় সেই ঐশ্বর্য্য পড়ে শঠ-প্রতারক-লোলুপ ইংরেজদের হাতে। শুরু হয় লুন্ঠনের এক নবযুগের সূচনা – প্রটেস্টান্ট সাম্রাজ্যবাদ। বাংলার সকল ঐশ্বর্য্য স্থানান্তরিত হয়ে যায় ইংল্যন্ডে।

লিস্টনিং টু দ্য উইন্ড অফ চেইঞ্জ ১২
সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবন প্রাপ্ত আমরা চারজন যুবক বেড়িয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। মাত্র শেষ করেছি কলেজ জীবন, চোখে রঙিন স্বপ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হব। সবুজ শান্তির সমারোহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পেরিয়ে বেরিয়ে এলাম তারুণ্যের উচ্ছলতায় মুখরিত টি, এস, সি, চত্বরে। বিশাল চত্বরে ঢুকে খুশীতে ছেয়ে গেল মনটা। চার রাস্তার মোড়ে আছে একটি সড়ক দ্বীপ। একপাশে টিচার্স স্টুডেন্টস সেন্টার ( টি, এস, সি,), আরেক পাশে মহীয়সী বাঙালী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের নামানুসারে মেয়েদের হল রোকেয়া হল, আরেক পাশে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী ও কলা ভবন এলাকা। এই সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির কেবলমাত্র শিক্ষার ইতিহাস নয়, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ইতিহাসও। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই অংশ নিয়েছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে, বিশেষ অবদান রেখেছিল ভাষা আন্দোলনে, সর্বপোরী একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে। তারপর সেখানেই থেমে যায়নি তাদের অন্যায়ের বিরুদ্বে প্রতিবাদের সুর। স্বাধীনতার পরও তারা যেকোন চক্রের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি কাউন্টার ফোর্স হিসাবে কাজ করতে থাকে। নির্ভীক, দুঃসাহসী এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
ঃ কোথায় যাবি? (প্রশ্ন করল আমীন)
ঃ ইউনিভার্সিটিতে যাব (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ আরে এটাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ হ্যাঁ, তবে কলা ভবনে অপরাজেয় বাংলার সামনে না দাঁড়ালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি বলে মনে হয়না। (বলল মোস্তাহিদ)
ঃ চল তাহলে। (বললাম আমি)
সমান লয়ে হেটে ধীরে ধীরে কলা ভবন চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতীকে অমর ভাষ্কর্য্য অপরাজেয় বাংলার সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা চারজন যুবক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও আক্রমণে পাক বাহিনী পরাজিত হয়। সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের প্রতীকী চিহ্নই ‘অপরাজেয় বাংলা’। ১৯৭২-৭৩ সালে ডাকসুর ভিপি ছিলেন কম্যুনিজমে বিশ্বাসী মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস ছিলেন মাহবুব জামান। এ সময় ডাকসুর উদ্যোগে অপরাজেয় বাংলার কাজে হাত দেয়া হয়। এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর চোখেমুখে স্বাধীনতার চেতনা উদ্দীপন নিরাপোস। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙ্গিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়। একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন। তবে অপরাজেয় বাংলার কাছে ভাস্করের নাম খচিত কোন শিলালিপি নেই। স্বাধীনতার এ প্রতীক তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন গুণী শিল্পী ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। এ ভাস্কর্যে সব শ্রেণীর যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। বেদীর উপর নির্মিত এর উচচতা ১২ ফুট, দৈর্ঘে ৮ ফুট ও প্রস্থে ৬ ফুট। অপরাজেয় বাংলার তিন মডেলের একজন হাসিনা আহমেদ বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।
ঃ আমি ছোট বেলায় বড় বোনের হাত ধরে অনেক এসেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যতবার এসেছি অপরাজেয় বাংলা মিস করিনি একবার হলেও এর সামনে দাঁড়াতাম। আমার বুক ভরে যেত। বাংলাদেশী নারী ও পুরুষের সাহসীকতার প্রতীক এই তিন মুর্তি। শহীদ বুদ্ধিজীবি মুনীর চৌধুরীর ছেলে সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র মিশুক ভাইকে অনেকবার দেখেছি অপরাজেয় বাংলা-র সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ক্যামেরা বন্দি করতে। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। বাংলাদেশীরা যে বিজয়ীর জাত অপরাজেয় এই তিন মূর্তিই সদম্ভে তা ঘোষণা করছে। (আমি বললাম)
ঃ গত পহেলা বৈশাখে এসেছিলাম এখানে। খুব সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ইউনিভার্সিটিতে। দেশের সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রও এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। (বলল আমীন)
ঃ আব্বা বলেছেন, ১৯৭২ সালে দেশের স্বাধীনতার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারীর অনুষ্ঠান খুব ঘটা করে পালন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে এসেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল সেক্টর কমান্ডাররা। ছাত্রছাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল জাতীয় বীরদের দেখার জন্য। এ ওকে বলছিল, “দেখ, দেখ ঐ জিয়াউর রহমান”, “দেখ, দেখ ঐ খালেদ মোশাররফ”, “ঐ যে আবু তাহেরকে দেখা যাচ্ছে”, ইত্যাদি। (আমি বললাম)
ঃ সেদিন দু’চারটি রাজাকার ছাড়া সমগ্র জাতি কেমন ঐক্যবদ্ধ ছিল! আজ আমাদের মধ্যে এত বিভেদ কেন? (প্রশ্ন করল ইমতিয়াজ)
ঃ কঠিন প্রশ্ন। শুধু এই দ্বিধা-বিভক্তি নয়, আরো আছে দেশের সেনাবাহিনীকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা।
ঃ এতে তো শেষমেষ দেশ মানে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এরকম কেন হচ্ছে? (মোস্তাহিদ)
ঃ জানিনা, এটা আমাদের দেশের বিরুদ্ধে কোন গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। (বললাম আমি)
হঠাৎ করে আমাদের সামনে দিয়ে একটা মিছিল যেতে শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই মিছিল মনে হচ্ছে। একদল তরুণ-তরুণী মিছিল করছে। তরুণদের সংখ্যাই বেশি, তরুণীদের সংখ্যা স্বল্প। মিছিলটি নাতিদীর্ঘ, তবে সবাইকে খুব দৃপ্ত মনে হলো। মিছিলের ভিতর থেকে কিছু শ্লোগান ভেসে এলো, ‘অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই’, ‘ভাত কাপড় জমি কাজ, ইউনিয়নের এক আওয়াজ’, ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও’। হেলাল হাফিজের কবিতা মনে পড়ল, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, …………….।’
ঃ এটা বোধহয় ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল। (আমীন)
ঃ কোন পার্টি এটা? (ইমতিয়াজ)
ঃ বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠন। (আমি)
ঃ কি চায় কম্যুনিস্টরা? (ইমতিয়াজ)
ঃ শুনলি না? ভাত চায়, কাপড় চায়। (কৌতুক করে বলল মোস্তাহিদ)
ঃ সে তো সবাই চায়। মজদুরের কথা বলল কেন? ওরা তো ছাত্র।
ঃ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে চায়। (আমীন)
ঃ শোষণ কি?
ঃ সমাজতন্ত্র।
ঃ সমাজতন্ত্র কি?
ঃ পুঁজিবাদ বিরোধী।
ঃ পুঁজিবাদটাই বা কি? (আবারও প্রশ্ন ইমতিয়াজের)
ঃ অতশত বুঝিনা। এই তুই কিছু বল না রোমান। (আমীন)
ঃ আমিও ভালো বুঝিনা। যা বুঝি আমাদের দেশে বা আমেরিকায় যেই সিস্টেমটা আছে এটা পুঁজিবাদ আর রাশিয়ায় যেই সিস্টেমটা চলছে সেটা সমাজতন্ত্র। (আমি)
ঃ রাশিয়া কি ভালো? (মোস্তাহিদ)
ঃ খারাপ হবে কেন? খারাপ হবে কেন? রাশিয়া ভালোই। (খেকে উঠল আমীন)। তোমাদের মোল্লা-মাওলানাদের দেশ সৌদি আরব খারাপ।
ঃ সৌদির কথা আসল কিসে? (মোস্তাহিদও ক্ষেপে গেল)
ঃ আহা তোমাদের আবার শুরু হয়ে গেল! (একটু বিরক্ত হয়েই বলল ইমতিয়াজ)। রোমান বুঝিয়ে বলোতো ওদের।
ঃ বললাম, না আমি নিজেও ভালো বুঝিনা। আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
ঃ ঢাকা ইউনিভার্সিটি দেখা তো হলো। এখন কোথায় যাবে চল। (ইমতিয়াজ)
ঃ কি বলিস দেখা হলো? সবে তো শুরু। (আমীন)
ঃ আর কি দেখবি? (মোস্তাহিদ)
ঃ কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে।
ঃ তুই আছিস তোর মেয়ে নিয়ে।
ঃ আহা তোমার বুঝি পছন্দ হয়না?
ঃ ওরা আমাদের সিনিয়র।
ঃ তাতে কি? মেয়ে তো। আর দু’এক বছরের সিনিয়রিটি ব্যাপার না। (হাসতে হাসতে বলল আমীন) আধুনিক যুগ না?
এবার সবার ঠোটের কোনায়ই মুচকি হাসি দেখা গেল।
ঃ ও বোধহয় সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ পড়ে প্রভাবিত। (মোস্তাহিদ)
আবারও সবাই হাসলো।
ঃ চল তোদের একজন চমৎকার লোকের কাছে নিয়ে যাই। (আমি)
ঃ এখানে? কে উনি? (ইমতিয়াজ)
ঃ রোমানের খালু আছেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। (মোস্তাহিদ)
ঃ খালু ঢাকা ইউনিভার্সিটির না, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।
ঃ আচ্ছা, কি নাম? কোন ডিপার্টমেন্ট? (ইমতিয়াজ)
ঃ ডঃ বজলুর রহমান খান। ইতিহাসের অধ্যাপক।
ঃ নামটা চেনা চেনা লাগছে, ডঃ বজলুর রহমান খান, ডঃ ফজলুর রহমান খান, কানে বাজছে। শুনেছি মনে হয়।
ঃ শোনার কথা, ডঃ ফজলুর রহমান খান শহীদ বুদ্ধিজীবি, ঢাকা ইউনিভার্সিটির সয়েল সায়েন্স-এর টিচার ছিলেন। ‘৭১-এ পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে শহীদ হন। উনার বড় ভাই-ই ডঃ বজলুর রহমান খান।
ঃ রাইট মনে পড়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবি ডঃ ফজলুর রহমান খান। উনার নামে স্মারক ডাকটিকেটও আছে। তোমার খালু, খালুর ভাই! ভালো ভালো বেশ ভালো। তা এখন কার কাছে নিতে চাও?
ঃ ডঃ জামান ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের প্রফেসর, খালুর জুনিয়র বন্ধু। (বলললাম আমি)
ঃ উনার কাছে আবার যাওয়ার দরকার কি? (আমীন)
ঃ তোর যাওয়ার দরকার নাই। তুই এখানে বসে বসে মেয়ে দেখ। (মোস্তাহিদ ঠেস দিয়ে বলল)। আমরা যাব। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এসেছি, ভবিষ্যতে এখানকার ছাত্র হওয়ার স্বপ্ন দেখি, আর এখানকার একজন প্রফেসরের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েও দেখা করব না? চল রোমান কোথায় যাবি চল।
কলা ভবনের ভিতর ঢুকে ইতিহাস বিভাগের দিকে গেলাম। অনিচ্ছা সত্বেও আমীনও আমাদের সাথে এলো। যাওয়ার পথে বাইরে, ভবনের ভিতরে বিভিন্ন পিলারের পাদদেশে জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে কপোত-কপোতীরা। দেলোয়ার হোসেন স্যারের কথা মনে হলো। স্যার বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিলার নিয়ে কবিতা আছে, ‘আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিলার হতাম, আমার পাদদেশে নতুন স্বপ্ন নিয়ে হাত ধরাধরি করে বসে থাকত প্রেমিক যূগল’।
ডঃ জামান স্যারের রুমটা খোলাই ছিল। পর্দা ঠেলে ঢুকে গেলাম আমি। আমার পিছনে পিছনে ওরা তিনজনও ঢুকল। আমাদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে ঐ মুহুর্তে স্যার একাই ছিলেন। আমাদের চার যুবকের কৌতুহলী আটটি চোখ পড়ল উনার দিকে। ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ জামান। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। পরনে ছিল এ্যাশ কালারের প্যান্ট, গায়ে সাদা শার্ট, তার উপরে মানাসই হালকা নীল রঙের টাই। একজন অধ্যাপক বললে যেমন চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠিক তেমনি। মুহুর্তেই আমাদের মন শ্রদ্ধাবোধে ছেয়ে গেল।
ঃ আস সালামু আলাইকুম আঙ্কেল। (আমি)
ঃ আরে রোমান যে! এসো এসো। (সানন্দে স্বাগত জানালেন ডঃ জামান ) হঠাৎ এদিকে? ওরা কারা?
ঃ জ্বী, আঙ্কেল, আমরা আসলে এখানে বেড়াতে এসেছি। ওরা আমার বন্ধু।
ঃ বেড়াতে বলতে স্রেফ ঘুরতে?
ঃ না মানে, আমাদের তো এইচ, এস, সি, পরীক্ষা শেষ। এখন ইচ্ছা আছে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবো। তাই ভাবলাম একটু ঘুরে দেখি।
ঃ ও তাই বলো। না এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। বন্ধুদের নিয়ে তীর্থ দর্শন। গুড, আই এ্যাম রিয়েলি প্লিজ্ড। তা তোমার খালু কেমন আছেন, ডঃ বি, আর, খান স্যার?
ঃ জ্বী, ভালো আছেন।
ঃ উনি এসেছিলেন এখানে গতমাসে। একটা কনফারেন্স ছিল। ওয়েল কি খাবে বলো?
ঃ না, না, আমরা কিছু খাবনা। আপনার সাথে শুধু দেখা করতে এসেছি।
ঃ আঙ্কেল, আমার দু’য়েকটা জিনিস জানার ইচ্ছা ছিল। (অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল মোস্তাহিদ)
ঃ আরে দু’য়েকটা কেন যত খুশী জানতে চাও, কোন সমস্যা নেই। আমাদের শিক্ষকদের কাজই তো হলো তোমাদের সবকিছু জানানো। ইতিহাস সংক্রান্ত কিছু হলে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব আশা করি।
ঃ মানে, এই ঢাকা ইউনিভার্সিটি সম্পর্কেই। আমরা আসলে তেমন কিছুই জানিনা। শুধু জানি বাংলাদেশের সব চাইতে পুরাতন, সব চাইতে ভালো ইউনিভার্সিটি। এর বেশি কিছু জানিনা।
ঃ ওয়েল, তোমার আগ্রহ দেখে খুব ভালো লাগলো। কি নাম তোমার, বাবা?
ঃ জ্বী, মোস্তাহিদ।
ঃ ওকে শোন মোস্তাহিদ।
ধীরে ধীরে বলে যেতে থাকলেন, ডঃ জামান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় । এটি একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় । এ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এখানে প্রায় ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রী এবং প্রায় ১৩০০ শিক্ষক রয়েছে। এটি ১৯২১ সালে স্থাপিত হয়। প্রতি বছর এখানে প্রায় ৫,০০০ ছাত্র ভর্তি হয়। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এর উত্তর দিকে নিউ এলিফ্যান্ট রোড। পশ্চিমে ইডেন কলেজ, দক্ষিণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্বে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।
ঃ আঙ্কেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটা যদি বলতেন।
ঃ শোন তাহলে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ঢাকার স্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে ঢাকার নবাব স্যার সলিমল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের দাবীর প্রেক্ষিতে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাশ করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’। সৃষ্টির শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। কলকাতার তৎকালীন একটি শিক্ষিত মহল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। এ ছাড়া ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ হতাশা প্রকাশ করে। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। এ আইনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এ আইনের বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমন্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির উপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতিবছর “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস” হিসেবে পালন করা হয়।
ঃ শুরুতে কতগুলো ডিপার্টমেন্ট ছিল স্যার (এবার আমীনও আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল)
ঃ তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজী, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবী, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসী ও উর্দূ, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন।
প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ (ইংরেজী বিভাগ; এমএ-১৯২৩)। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও ভারত বিভক্তি আন্দোলনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকান্ড শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫ টি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯৪৭-৭১ সময়ের মধ্যে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রী সহ শহীদ হয়েছেন বহুজন।
ঃ রোমানের খালুর ভাইও তো শহীদ হয়েছিলেন। (বলল ইমতিয়াজ)
ঃ আমি জানি। ডঃ ফজলুর রহমান আমার সিনিয়র কলিগ ছিলেন। অত্যন্ত অমায়িক ও কর্মঠ ব্যাক্তি ছিলেন। উনার অকাল মৃত্যুতে সয়েল সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট তথা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়। ভেবে দেখ এরকম একজন মানুষকে তৈরী করতে পিতা-মাতা থেকে শুরু করে শিক্ষক, বিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কত সাধনা করতে হয়। আর তাকে হারাতে একটি গুলিই যথেস্ট ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবি আছেন। গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ,ডঃ এ. এন. এম. মনিরুজ্জামান, ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা,
এ. এন. মুনীর চৌধুরী , মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডঃ আবুল খায়ের,
ডঃ সিরাজুল হক খান, রাশীদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, ডঃ জি. সি. দেব, ডঃ ফজলুর রহমান, ডঃ ফয়জুল মহি, আব্দুল মুকতাদির, শরাফৎ আলী,
সাদত আলী, এ. আর. খান খাদিম, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ সাদেক, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, ডাঃ মোহাম্মদ মর্তুজা, প্রমূখ।
‘৭১-এর যুদ্ধে আমাদের দেশের জেনেটিক ফান্ডের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। একারণেই যুদ্ধের পরে উঠে দাঁড়াতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে।
ঃ স্বাধীনতার পরে কি বিশ্ববিদ্যালয় কোন মৌলিক পরিবর্তন এসেছিল? (আমি প্রশ্ন করলাম)
ঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের সরকার প্রবর্তিত অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ উক্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার-১৯৭৩ জারি করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এই অর্ডার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে।
ঃ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কি?
ঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত প্রতিষ্ঠান দেশের সর্ব প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১০ টি অনুষদ, ৫১ টি বিভাগ, ৯ টি ইনস্টিটিউট এবং ৩৩ টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্যে রয়েছে ১৩ টি আবাসিক হল ও হোস্টেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ ও এর অন্তর্গত বিভাগগুলো হল:
কলা অনুষদ :
কলা অনুষদের বিভাগ সমূহ-
বাংলা, ইংরেজী, ফারসী ও উর্দূ, দর্শন, ইতিহাস, আরবী, ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সংস্কৃত ও পালি, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা, ভাষাবিজ্ঞান, নাট্যকলা ও সঙ্গীত, বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগ ।
বিজ্ঞান অনুষদ :
বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগ সমূহ
পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, পরিসংখ্যান বিভাগ।
আইন অনুষদ
আইন অনুষদের বিভাগ
আইন বিভাগ
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগ সমূহ-
অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, লোক প্রশাসন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, নৃবিজ্ঞান, পপুলেশন সায়েন্সেস, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, উইমেন্স স্টাডিজ ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ।
বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ
বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের বিভাগ সমূহ-
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, মার্কেটিং, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং, হোটেল এন্ড টুরিজ্যাম ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ।
জীববিজ্ঞান অনুষদ
জীববিজ্ঞান অনুষদের বিভাগ সমূহ-
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, প্রাণ রসায়ন ও অনুপপ্রাণ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অণুজীব বিজ্ঞান, মৎস বিজ্ঞান, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ।
ফার্মেসি অনুষদ
ফার্মেসি অনুষদের বিভাগ সমূহ
ফার্মাসিউটিকাল কেমিস্টি, ক্লিনিকাল ফার্মেসি এন্ড ফার্মাকোলজি, ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগ।
ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টেকনোলজী অনুষদ
এই অনুষদের অন্তর্ভূক্ত বিভাগগুলো হচ্ছে:
ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স এবং কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদ
ভূগোল ও পরিবেশ এবং ভূতত্ত্ব বিভাগ
চারুকলা অনুষদ
চারুকলা অনুষদের বিভাগ সমূহ-
অংকন ও চিত্রায়ন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, প্রিন্ট মেকিং, প্রাচ্যকলা, ভাষ্কর্য, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ।
অন্যান্য অনুষদের মধ্যে রয়েছে-
চিকিৎসা অনুষদ
স্নাতকোত্তর চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদ
শিক্ষা অনুষদ
ইনস্টিটিউট সমূহ
১। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
২। পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট
৩। ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট
৪। পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট
৫। চারুকলা ইনস্টিটিউট
৬। সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
৭। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট
৮। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট
৯। তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট
আবাসিক হলসমূহ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীকে কোনো না কোনো হলের সাথে আবাসিক/অনাবাসিক ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে যুক্ত থাকতে হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রিদের জন্য ১৪ টি আবাসিক হল রয়েছে। এছাড়া চারুকলা ইনস্টিটিউট ও ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা হোস্টেল এবং বিদেশী ছাত্রদের জন্য আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস। হলগুলোর নাম এই দেখ এখানে লেখা আছে।
বলে তিনি একটি কাগজ বাড়িয়ে দিলেন। আমরা পড়লাম
হলের নাম:
১। সলিমল্লাহ মুসলিম হল ২। শহীদুল্লাহ হল ৩। জগন্নাথ হল ৪। ফজলুল হক মুসলিম হল ৫। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ৬। রোকেয়া হল ৭। মাস্টারদা সূর্যসেন হল ৮। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ৯। শামসুন নাহার হল ১০। কবি জসিম উদ্দিন হল ১১। স্যার এ. এফ. রহমান হল ১২। শহীদ জিয়াউর রহমান হল, ১৩। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ১৪। স্যার ফিলিপ হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল
ঃ স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র কি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন?
ঃ না, এ পর্যন্ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ এই সম্মানে ভূষিত হন নি। তবে আমাদের মনে অনেক আশা,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস নোবেল পুরস্কার লাভ করবেন। এছাড়া, বরেণ্য পাকিস্তানী বিজ্ঞানী নোবেল বিজয়ী প্রফেসর সালাম একাধিকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধুলী দিয়েছিলেন। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, জামাল আব্দুল নাসের ও কাজী নজরুল ইসলামের মত বিশ্বখ্যাত ব্যাক্তিদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়েছে।
ঃ আঙ্কেল, সত্যেন বোস কি এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন না? (আমি প্রশ্ন করলাম)
ঃ না তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না, তবে এখানকার শিক্ষক ছিলেন এবং এখানে থাকাকালীন সময়েই তিনি পৃথিবীখ্যাত বোস-আইনস্টাইন থিওরী আবিস্কার করেছিলেন, আরো আবিষ্কার করেছিলেন বিশেষ ধরণের কণিকা গ্রুপ, ‘বোসন’।
ঃ স্যার আপনাদের সমাবর্তন নাকি রেগুলার হয়না? (ইমতিয়াজ)
ঃ হুঁ, এই সমালোচনা করতে পারো। তারপরেও যা হয়েছে তা নিম্নরূপ।
আরেকটি কাগজ বাড়িয়ে দিলেন তিনি। আমরা আবার পড়লাম।
সমাবর্তন : পিছনে ফিরে দেখা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই (২৪ বার) সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলের শেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ২১ নভেম্বর। পাকিস্তান আমলে ১৫ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ এবং শেষবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৮ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর। এরপর ২০০১, ২০০৪, ২০০৭ ও ২০০৮, ২০০৯ সালে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।
ঃ আঙ্কেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য কে ছিলেন? (আমি প্রশ্ন করলাম)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পি. জে. হার্টগ তার কার্যভার গ্রহণ করেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে তাকে সাহায্য করেন মি. ডাব্লিউ হোরনেল, স্যার নীলরতন সরকার, স্যার আশুতোষ মুখপাধ্যায়, নবাব স্যার শামসুল হুদা ও নবাবজাদা খান বাহাদুর কে এম আফজাল। ১৯২১ সালে খান বাহাদুর নাজিরুদ্দীন আহমেদ প্রথম রেজিস্টার হিসেবে নিযুক্ত হন। বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে মোট দশটি সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা কলেজে সাবেক অধ্যক্ষ মি এফ সি টার্নার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। ঢাকা সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ শামসুল ওলামা আবু নছর ওয়াহিদ অস্থায়ীভাবে ঐ বিভাগের প্রধান হন। তিনি একই সাথে ঢাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদেও বহাল ছিলেন। পরে ঐ পদে ১৯২৪ সালের ১ জুলাই ড. আবদুস সাত্তার সিদ্দিকী যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্বতন্ত্র সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ খোলা হয়। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ছিলে ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজেস বিভাগের অন্তর্গত। সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রথম অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ‘বৌদ্ধ গান ও দোহা’র আবিষ্কারক কলকাতা সংস্কৃত কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (সিআইই)। এ বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম কমপারেটিভ ফিললজি বা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ছাত্র ও এম এ রিসার্চ এসিসটেন্ট মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও বিশিষ্ট লিপি বিশারদ শ্রী রাধাগোবিন্দ বসাক। ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেছিলেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও এ এফ রহমান। পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিভাগে উপমহাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের নাম উল্লেখযোগ্য। রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম প্রধান ছিলেন ড. জ্ঞানচন্দ্র। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রথম আইন বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯২১ সালের ১জুলাই ২৮ জন কলা, ১৭ জন বিজ্ঞান এবং ১৫ জন আইনের শিক্ষক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। ইংরেজি, সংস্কৃত ও বাংলা, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, ফার্সি ও উর্দু, ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, অঙ্ক বা গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন আইন এবং শিক্ষা এই ১২ টি বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করে। বিভিন্ন বিভাগের বিএ, বিএসসি ও অনার্স এবং এমএ ক্লাসে মোট ৮৭৭ জন ছাত্র নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয়। সকল ছাত্রকে কোন না কোন হলে আবাসিক বাস সংশ্লিষ্ট থাকতে হত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম তিন বছরের অনার্স চালু হয় যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু ছিল দুইবছরের।এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মটো বা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় Truth shall prevail অর্থাৎ সত্যের জয় সুনিশ্চিত।
ঃ আঙ্কেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয় কেন?
এবার হেসে ফেললেন, ডঃ জামান।
ঃ না মানে, এটা আক্ষরিক অর্থে নয়। সিম্বোলিক। একটা ক্যাচিং ওয়ার্ড বলতে পারো। তখন বৃটিশ শাসনামল চলছিল, সাহেবদের আমরা অনেক উঁচু দৃষ্টি দিয়ে দেখতাম। সেই সাহেবদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে পূর্ব বাংলায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা বোঝানোর একটা রাজনৈতিক চেষ্টা আরকি।
ঃ মানের দিক থেকে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বখ্যাত নয়?
ঃ প্রশ্নই ওঠে না। অক্সফোর্ড তো দূর অস্ত, তার ধারে কাছেও নেই। এই কিছুদিন আগে একটা আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গিয়েছে, মানের দিক থেকে বিশ্বের ৫০০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। আচ্ছা তোমরাই বলতো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন গ্র্যাজুয়েট কোন অবদান রেখে বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছে?
ঃ কেন সত্যেন বোস, তাছাড়া শ্রীনিবাস কৃষ্ণাণ নামেও একজনার কথা শুনেছি।
ঃ হ্যাঁ তবে উনারা কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ছিলেন না, কেবল শিক্ষক ছিলেন। আমি অস্বীকার করব না যে বিজ্ঞানের বইয়ে তাদের নাম এসেছে। তবে তাদের কেউই নোবেল বিজয়ী নন। পক্ষান্তরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতাশ (২৭) জন গ্র্যাজুয়েট নোবেল বিজয়ী, তাছাড়া শিক্ষকদের মধ্যে থেকে পেয়েছেন চৌদ্দ (১৪) জন এবং আরো সাত জন নোবেল বিজয়ী হবার পর অক্সফোর্ড-এ কর্মরত ছিলেন। এখন তোমরা বল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি কোনভাবেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনীয়?
ঃ তাহলে এটা শুধুই বুলি? (আমীন)
ঃ একটা বিষয়ে মিল আছে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন আবাসিক ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্সফোর্ডের মত আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একটি বই নিয়ে একটা পাতা খুলে এগিয়ে দিলেন,
ঃ পড়
আমি পড়লাম
ক্যাম্পাস:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শুরু থেকেই সুপরিকল্পিত ভাবে একটি আবাসিক বিম্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হয়। অধুনালিপ্ত পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানীর জন্য ঐতিহাসিক বাগ-এ-বাদশাহীতে গড়ে উঠেছিলো রমনীয় রমনা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মনোলোভা দৃশ্যাবলী একদিকে যেমন ছিলো প্রগতিশীলতার ধারক, তেমনি তারুণ্যের উন্মত্ততাকে যেনো হাতছানি দিয়েছিলো এক উদাত্ত আহবানে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তার পূর্ব পাশে অবস্থিত ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), লিটন হল, কার্জন হল, বিজ্ঞান ভবন সমূহ, ঢাকা হল এর পূর্ব পাশে বিরাট দীঘি, অপর পাশে ফজলুল হক মুসলিম হল। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে প্রধান প্রবেশ পথ ছিলো ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল)- এর দিক থেকে, মাঠে ঢুকতেই ডানে জিমনেসিয়াম আর বামে একটি পুকুর; বিশ্ববিদ্যালয় মাঠটি ত্রিকোণাকৃতি এবং তাতে দুটি ফুটবল গ্রাউন্ড ছিলো। মাঠের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব তিনদিক দিয়েই বৃক্ষশোভিত রাজপথ প্রসারিত; বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণদিকের রাস্তাটি ইউকেলিপটাস শোভিত, যে রাস্তাটি মুসলিম হল পর্যন্ত সম্প্রসারিত এবং মুসলিম হলের সামনে শিরিষ বা রেইনট্রি জাতীয় বৃক্ষ শোভিত; পুরাতন রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরাল সাবেক পূর্ববাংলা ও আসাম সরকারের সেক্রেটারিয়েট ভবন, সামনে ইউকেলিপটাস শোভিত প্রশস্ত রাজপথ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দান। ঐ সেক্রেটারিয়েট ভবনের দোতলায় প্রথমে মুসলিম হল এবং একতলায় বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য বিভাগ বিশেষত কলা অনুষদের বিভাগ এবং ক্লাশরুম প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এ বিশাল ভবনটির পূর্বাংশ ব্যাতীত সবটুকুই সামরিক হাসপাতালে এবং দেশবিভাগের পূর্বে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের উত্তর দিকে প্রবাহিত রাজপথের পাশে ছিলো দুটি কি তিনটি বিরাট লাল ইটের দোতলা বাংলো, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরাই বাস করতেন। এ বাংলোগুলোর পেছনে রমনা রেসকোর্সের দিকে মুখ করে বর্ধমান হাউস ও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক নিবাস। দেশবিভাগের পরে যা হয়েছিলো, পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী প্রথমে খাজা নাজিমউদ্দিন এবং পরে নূরুল আমীনের বাসভবন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভের পর ১৯৫৭ সালে একুশ দফার এক দফা অনুযায়ী বর্ধমান হাউস বাংলা একডেমীতে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের ভেতরে সে কালে একটি পুকুর (উত্তর পূর্বকোণে) ছাড়াও একটি জঙ্গলাকীর্ণ পুরাতন কবরস্থান ছিলো, যা এখন নেই।
আবাসিক পরিবেশ:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো শুধু ছাত্রাবাস রুপেই নয় সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের শিক্ষা, সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ও অনুশীলন কেন্দ্ররূপেও পরিকল্পিত হয়েছিল। পরিকল্পনায় ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক কোন না কোন হলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, ছাত্রদের উপদেষ্টারুপে এবং অনুশীলনী ক্লাস নিবেন। প্রত্যেকটি হলকে চারটি হাউসে বিভক্ত করা হয়েছিল চারশত ছাত্রের জন্য আর প্রতি পঁচাত্তরজন ছাত্রের তত্ত্ববধানের জন্য একজন করে আবাসিক শিক্ষক বা হাউস টিউটরের ব্যবস্থা ছিল। হিন্দু ছাত্রদের জন্য জগন্নাথ হল, মুসলমান ছাত্রদের জন্য সলিমুল্লাহ মুসলিম হল আর সবধর্মের ছাত্রদের জন্য ঢাকা হল স্থাপিত হয়েছিল।
ঢাকা হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এফ. সি. সি. টার্নার। শুরুতে একমাত্র ঢাকা হলেরই নিজস্ব ভবনে ছিল; কার্জন হল মিলনায়তনটি তার অধিকারভুক্ত ছিল সে কারণে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষা বহির্ভূত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ঢাকা হল ছাত্র সংসদের ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। দেশ বিভাগের পর ঢাকা হলই ছিল প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন মহান গণঅভ্যুত্থানে পরিনত হয়েছিল ঢাকা হলের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের শাহাদাতের বিনিময়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম হল “সলিমুল্লাহ মুসলিম হল”। এ হলের প্রথম প্রোভস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এ এফ রাহমান। ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলার গভর্ণর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন ঢাকার প্রয়াত নবাব বাহাদুর স্যার সলিমুল্লাহ্র নামানুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের’ এর ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষে এর ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় ঢাকার বলিয়াদির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর দানে তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামেই ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলের আইন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উৎসাহে জগন্নাথ হলের প্রথম বার্ষিক সাহিত্যপত্র ‘বাসন্তিকা’ ১৯২৩ সালের প্রথম প্রকাশিত হয়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের পর প্রভোস্ট হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।
প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাকা সমাজের রক্ষণশীলতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে খুব দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু কলকাতা বেথুন কলেজের গ্রাজুয়েট লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে ছিলেন নাছোড়বান্দা। ১৯২১ সালে লীলা নাগ ইংরেজিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী হিসেবে বের হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী সুষমা সেনগুপ্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ছিলেন গণিত বিভাগের ফজিলতুন্নেসা। ধীরে ধীরে ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ছাত্রী হোস্টেলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই উদ্দেশে ১৯২৬ সালের ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ নং বাংলো ‘চামেরি হাউস’-এ (বর্তমানে সিরডাপ ভবন) প্রথম উইমেনস হাউস প্রতিষ্ঠা করা হয়। উইমেনস হাউস মাত্র তিন জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। মিসেস পি. নাগ এই হাউসের হাউস টিউটর নিযুক্ত হন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উইমেনস হাউস চামেরি হাউসে ছিল পরে ১৯২৮ সালে তা ১০ নং বাংলোতে (বর্তমানে এস্থানে বিজ্ঞান গ্রন্থাগার অবস্থিত) স্থানান্তরিত হয়। ঐ সময় চামেরি বাংলোটিকে মুসলিম হলের এক্সটেনশন করা হয়। পরবর্তীকালে যে কোন বাংলোতেই হোক না কেন তাকে “চামেরি হাউস” বলে ডাকা হত। ১৯৩৮ সালে মেয়েদের হোস্টেল পুনরায় চামেরি হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৪০ সালের ১ জুলাই অবিভক্ত বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুক হকের নামানুসারে “ফজলুল হক মুসলিম হল” প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভবনের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ) যে অংশে সলিমুল্লাহ হলের বর্ধিতাংশ ছিল সেখানে ফজলুল হক হল যাত্রা শুরু করে। ১৯৪২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ভবনে সামরিক হাসপাতাল স্থাপিত হলে ১৯৪৩ সালে ফজলুল হক হল বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়, পূর্বে যা ছিল ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজ হোস্টেল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ফজলুল হক হলের প্রথম প্রভোস্ট আর প্রথম দুইজন হাউস টিউটর কাজী মোতাহার হোসেন এবং আব্দুস সামাদ।
ঃ বাহ্ অনেক কিছু জানলাম স্যার !(খুশী মনে বলল মোস্তাহিদ)
ঃ আবাসিক, হওয়াতে তো খুব উপকার হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। (আমি বললাম)
একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ডঃ জামান
ঃ হ্যাঁ, উপকারের জন্যই তো আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু রাজনীতিবিদরা এটাকেই আবার তাদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করল। এখন তো আমরা তাদের হাতে জিম্মী!
আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। এমন একজন হাইলি কোয়ালিফাইড, জ্ঞানের প্রতিভূ ব্যাক্তিকে অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত চোঙা ফোকানো রাজনীতিবিদদের কাছে খুব অসহায় মনে হলো।
ঃ স্যার, শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় অনেক প্রতিবন্ধকতা হয়েছিল। (ইমতিয়াজ)
ঃ খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নাকি বিরোধিতা করেছিলেন? (মোস্তাহিদ)
ঃ হ্যাঁ, অনেক প্রতিবন্ধকতা হয়েছিল। সে সময় পূর্ব বঙ্গে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। পূর্ব বঙ্গ মুসলমান অধ্যূষিত বলে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের জন্য উচ্চ শিক্ষার দরোজা খুলে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের অন্যান্য ধর্মের লোকজনের জন্যও এটা বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়। সকলেই এই প্রস্তাবটি স্বাগত জানায়। সকলেই সহযোগিতার হাত বাড়ায়।
এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাও সে সময় কিছু লোকজন করেছিলেন। এই বিরোধিতাকারীদের মধ্য ছিলেন মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন তিন ধরনের লোকজন–
এক. পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান–তারা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে। তাদের জন্য ঢাকায় নয় পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটাই লাভজনক।
দুই. পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান–তারা মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ১০০০০ জনের মধ্যে ১ জন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে।
পূর্ববঙ্গে প্রাইমারী এবং হাইস্কুল হলে সেখানে পড়াশুনা করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়বে। আগে সেটা দরকার। এবং যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মুসলমানদের জন্য যে সরকারী বাজেট বরাদ্দ আছে তা বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যয় হয়ে যাবে। নতুন করে প্রাইমারী বা হাইস্কুল হবে না। যেগুলো আছে সেগুলোও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় চান নি।
তিন. পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে? এই ভয়েই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তাছাড়া উগ্রপন্থী হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে যাবে বলে। তারা যেয়েছিল এই উপমহাদেশে উচ্চ বর্ণীয় হিন্দুদের চিরস্থায়ী ডোমিনেশন প্রতিষ্ঠা করতে।
মৌলানা আকরাম খান আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করলে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দানের ক্ষেত্রে অর্থের ব্যবস্থা করবেন না। মুসলমানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অপেক্ষা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি গুরুত্ত্ব আরোপ করেন। আবদুর রসুল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের পক্ষে ‘বিলাসিতা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তার মতে কয়েকজন ভাগ্যবানের জন্য অর্থ ব্যয় না করে বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা ব্যয় করা উচিৎ। মুসলমানদের মতে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান, ফলে বাংলার মুসলমানদের বিশেষ কিছু লাভ হবে না। বরং গরীব অথবা যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা এবং দু-একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ স্থাপন ইত্যাদি করলে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার সম্ভব হবে। চব্বিশ পরগণার জেলা মহামেডান এসোসিয়েশন ১৯১২-র ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যায় স্থাপনের বিরোধিতা করে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন সে সময়ে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তার ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন? শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তার আত্মস্মৃতিতে লিখেছিলেন ১৯১৯ সালের নতুন আইন অনুসারে বাংলার শিক্ষামন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্র শিক্ষকদের বেতন কমানোর নির্দেশ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠার সময় রিজার্ভ ফান্ডে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ছিল। বাংলা সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদত্ত সরকারী ভবন বাবদ সেগুলো কেটে নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতিবছর মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। ফলে শিক্ষকদের বেতন কমিয়ে দিতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদ নানাপ্রকার প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্দ্যেগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।
ঃ স্যার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এ কথা কি সত্য?
ঃ দেখ, আমি ইতিহাসের অধ্যাপক তথ্য উপাত্ত ছাড়া কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর কোন শিক্ষিত মানুষেরই উচিৎ হবে না সেটা করা। আমি নিজে যেহেতু সেই সময়টায় ছিলাম না তাই শুধু বলব বইপত্রে কি পেয়েছি।
ঃ স্যার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’-তে লেখা আছে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। (ইমতিয়াজ বলল)
ঃ ‘প্রথম আলো’ ইতিহাস বই নয় উপন্যাস, আর সুনীলও কোন ইতিহাসবিদ নন। (ইমতিয়াজকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল আমীন)
ঃ তুই থাম না। স্যার বলুক। (বিরক্ত হয়ে বলল মোস্তাহিদ)
ঃ আচ্ছা শোন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ধরনের একটি অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। অনেকে বলেন যে, ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।” অনেকে আবার এই অভিযোগটির বিরোধিতা করেন। তারা বলেন ঐ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতায়ই উপস্থিত ছিলেন না এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেন নাই। করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হত না। ১৯৩৬ সালে তাকে ডিলিট উপাধী প্রদানের বিষয়েও বিরোধিতা হত। বরং তাঁকে দুবারই মুসলমান-হিন্দু সকল শ্রেণীর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান আন্তরিকভাবে সম্মাননা প্রদান করেছে। সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার সংবাদাদি সে সময়কার পত্রিপত্রিকায় পাওয়া যায়। কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর নামে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় না। আবার অনেকে বলেন ”রবীন্দ্রনাথ একসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরোধী ছিলেন….কিন্তু….চারপাঁচ বছর পর তার পুরানো পজিশন পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। ….অবশ্যই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননায় এসেছিলেন।
আবার অনেকে বলছেন, ‘১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিস্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। কারণ তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে করতেন লাইভ স্টক বা গৃহপালিত পশু’( শ্রী নীরদ চৌধুরী, দি অটোবায়োগ্রাফী অব এ্যান আননোন ইন্ডিয়ান)।
১৯১২ সালে ১৬ই ফেব্রুয়ারী বড় লাটের সাথে বর্ধমানের স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিমন্ডলী সাক্ষাত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিস্ঠা না করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।( রিপোর্ট অব দি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি কমিশন) এছাড়া রমেশ চন্দ্র মজুমদার-এর ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ গ্রন্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা সম্পর্কে বলা আছে।
ঃ এখান থেকে আমরা কি সিদ্ধান্ত নিতে পারি স্যার?
ঃ বলা মুশকিল, বইপত্রে দুরকমই তো পাচ্ছি।
ঃ স্যার মহান মুক্তিযুদ্ধে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অবদান তাইনা?
ঃ অবশ্যই, (আমি বললাম)
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। একাত্তরে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী বাঙালি সৈনিক, বৈমানিক ও ছাত্রছাত্রীগনকে একই পর্যায়ভুক্ত করে আক্রমণ চালিয়েছিল। এই অপারেশনের নাম ছিল “অপারেশন সার্চ লাইট”। এইচ আওয়ার নির্ধারিত হয়েছিল ২৬ মার্চ রাত ১ টা। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটি বিশাল গাছ বাহিনীর গতিরোধ করে, রাস্তার পাশের এলাকা পুরানো গাড়ি আর স্টিম রোলার দিয়ে বন্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের ছাত্ররা হলের সামনে একটি বড় গাছের গুড়ি ফেলে রেখে সেনাবাহিনীকে বাধাঁ দেয়। সকাল ৪টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন গুলো দখল করে নেয় তারা। ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটেলিয়ন নিয়ে গঠিত বিশেষ মোবাইল বাহিনী লেফটেনেন্ট কর্ণেল তাজের নেতৃত্বে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ট্যাংক বিধ্বংসী বিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লাঞ্চার, মর্টার, ভারি ও হাল্কা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘেরাও করে আক্রমন, পাইকারি হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। ঐ রাতে দৈবক্রমে পাকিস্তানী আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া অধ্যাপক ড. মফিজুল্লাহ্ কবির তার ১৯৭১-৭২ সালের বার্ষিক রিপোর্টে লেখেন, ঐ রাতে ছাত্র সহ প্রায় ৩০০ ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিহত হয়। সেই সাথে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক ও ২৬ জন অন্যান্য কর্মচারী। নিহত শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন, ড. ফজলুর রহমান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ), অধ্যাপক এ. আর. খান খাদিম (গণিত বিভাগ), অধ্যাপক শরাফত আলী, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (প্রাক্তন প্রোভস্ট জগন্নাথ হল), অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (প্রোভস্ট জগন্নাথ হল), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মুহম্মদ মুকতাদির (ভূতত্ত্ব) প্রমুখ। সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে জগন্নাথ হলে, সেই রাতে ৩৪ জন ছাত্র শুধু সেই হলেই নিহত হয়। ২৬ মার্চ রমনা কালীবাড়িও আক্রান্ত হয়। সেস্থলে নিহত হয় জগন্নাথ হলের ৫/৬ জন ছাত্র। হানাদার বাহিনী হত্যা করে মধুর ক্যান্টিন খ্যাত মধুসূদন দে’কেও (মধুদা)। মুক্তিযুদ্ধ কালীন পাকিস্তানী সৈন্যরা মুধুর ক্যান্টিন ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে শুরু করলে উর্দু বিভাগের শিক্ষক আফতাব আহমদ সিদ্দিকী খবর পেয়ে তাদের বাধাঁ দেন এবং জানান যে এই ভবনেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১০ নভেম্বর সশস্ত্র সৈন্যরা রোকেয়া হলে প্রবেশ করে এবং ত্রিশজন ছাত্রীর উপর নির্যাতন করে। তারা প্রোভোস্ট বাংলোও অবরোধ করে রাখে।
একাত্তরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান। সেখানে জেনেভার একটি পত্রিকায় দু’জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন, “আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম”। ফলে মার্চের সেই কালরাত্রীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্য বিহীন। পরে মুজিবনগর সরকার বিচারপতি সাঈদকে “প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি” হিসেবে নিয়োগ দেয়। পাকিস্তান বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে তাদের কনভয়ে করে ঢাকায় নিয়ে এসে ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে বসান। তাকে সহায়তা করেন ড. হাসান জামান, ড. মেহের আলি। স্বাধীনতার পর তিনজনই গ্রেফতার হন এবং মুক্তির পর দেশ ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এদের অনেকেই পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর যান এবং প্রবাসী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার পরে টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগীয় প্রধানদের ২১ এপ্রিল ও সকল শিক্ষকদের ১ জুন কাজে যোগ দিতে বলেন। টিক্কা খান ২ আগস্ট থেকে সকল ক্লাস চালু করারও আদেশ জারি করেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করা হয় এবং ইন্টারোগেশনের মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন ড. আবুল খায়ের, ড. রফিকুল ইসলাম, কে এ এম সাদউদ্দিন, আহসানুল হক এবং এম শহীদুল্লাহ। টিক্কা খান অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. এনামুল হককে লিখিত ভাবে সতর্ক করে দেন। ড. আবু মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে পদচ্যুত করা হয়।
ঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের কোটি-কোটি মানুষের অবদান রয়েছে। যেই সৈনিক বিদ্রোহ করে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এলেন তার যেমন অবদান আছে, আবার যেই ছাত্র বা কিষাণের ছেলে গভীর রাতে মায়ের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিল তারও অবদান আছে, যেই রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবিরা অর্গানাইজার হিসাবে কাজ করেছেন তারাও কৃতিত্বের দাবীদার, যেই গৃহবধু ভাত রেধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে তিনিও কম কৃতিত্ব দেখাননি। আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন একটা স্মৃতি মনে পড়ে। একটি গ্রামে গিয়েছি আমরা অপারেশনে। গভীর রাতে এক কৃষকের বাড়ীতে আমাদের আশ্রয় হলো। তার আট বছরের ছোট শিশুটি মায়ের পাশে পাশে আমাদের থালা এগিয়ে দিচ্ছে, পানির গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে, মাকে বলছে, “মা উনারে আরেকটু ভাত দাও”। তারপর আমার পাশঘেষে বসে আমার অস্ত্রটিতে হাত দিয়ে বলে, “অনেক ভার উডাইতে পারমু না। আমি যদি বড় থাকতাম এইডা লইয়া আপনেগো লগে যুদ্ধে যাইতাম।”
তোমরাই বল, এই শিশুটি কি মুক্তিযোদ্ধা নয়?
ঃ স্যার আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? (মোস্তাহিদ)
ঃ ছিলাম তো। ঘটা করে বলতে ভালো লাগেনা। আমি দেশের প্রতি আমার দায়িত্ব পালন করেছিলাম মাত্র। এই নিয়ে অহংকার করতে চাইনা।
আমরা লক্ষ্য করলাম স্যারের চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করছে।
ঃ আঙ্কেল ঐ শিশুটিকে আর দেখেছিলেন? (আমি প্রশ্ন করলাম)
ঃ হ্যাঁ, দেখেছি। ওদের সাথে আমি যোগাযোগ রেখেছিলাম। ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তো পাশ করল রিসেন্টলি। খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। আমাকে প্রায়ই বলত, “স্যার, বয়সের কারণে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারিনাই, কিন্তু স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে উজাড় করে দেব।”
এই কথা ও কাহিনী শুনে আমাদের সবার মধ্যে গভীর আবেগের সঞ্চার হলো।
ডঃ জামানের রুম থেকে যখন বেরিয়ে আসছিলাম। আমাদের সবার মনে মনে একটি কথাই ভাসছিল, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো’।
ঃ চল বাড়ী চলে যাই। (আমীন)
ঃ না ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে এসে একটা জায়গায় না গেলে, বেড়ানোটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। (আমি)
ঃ কোথায়?
ঃ কাজী নজরুল ইসলামের মাজারটা জেয়ারত করা উচিৎ।
ঃ গুড আইডিয়া, গুড প্রপোজাল। (মোস্তাহিদ)
ঃ ঠিক রোমান এখানে এসে জাতীয় কবির মাজারটা অবশ্যই জেয়ারত করা প্রয়োজন। (ইমতিয়াজ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়নাভিরাম বিশাল মসজিদের পাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম বিদ্রোহী কবির মাজারের দিকে। যেতে যেতে মনে মনে আমাদের কানে বাজছিল কবির গান, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জীনের আযান শুনতে পাই।’ ধর্মভীরু পরহেজগার পিতার সন্তান দুঃখু মিয়ার অনুরোধ দেশের মানুষ রেখেছে। ঢাকার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে।
ছোট্ট ছিমছাম কবরস্থানে শিল্পাচার্য জয়নূল আবেদীনসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যাক্তিই শায়িত আছেন। ঠিক মাঝামাঝি লাল সিরামিকের ইট দিয়ে বাধানো বেশ কয়েকটি ধাপে উঁচু হয়ে যাওয়া কবরটির ভিতর শায়িত আছেন আমাদের প্রানের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মনে হয় যেন এই কবরগাহের হেলাল তিনি, আর তাকে ঘিরে ফুটে আছেন অনেক উজ্জ্বল সিতারা।
কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মোস্তাহিদের নেতৃত্বে আমরা দোয়া পড়লাম। দোয়ার এক পর্যায়ে মোস্তাহিদ কবিরই একটি কবিতার লাইন পড়ল, ‘হে আল্লাহ্ করোনা বিচার, আল্লাহ্ করোনা বিচার, বিচার চাইনা, চাই আল্লাহ্ করুনা তোমার।’ দোয়া শেষে মোস্তাহিদ বলল, ” বীর সৈনিক, অকুতোভয় দেশপ্রেমিক, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথিকৃত ও অনন্যসাধারণ প্রতিভা আমাদের প্রানের কবি তোমায় সালাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রিদের জন্য এই কবির কবরটি সব চাইতে বড় অনুপ্রেরনা।”
আমাদের সকলের মনে তখন বাজছিল কবির লেখা কবিতার লাইন,
‘বল বীর, চির উন্নত মম শীর’।
(এই পর্বটি লিখতে গিয়ে আমি উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ইন্টারনেট সোর্সের সাহায্য নিয়েছি। এছাড়া আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রখ্যাত সাহিত্য গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক রফিক কায়সারের কাছ থেকেও অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। স্যারকে ও অন্যান্য সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।)
উৎসর্গঃ আজ ১৪ই ডিসেম্বর ২০১২ শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস। আমার শ্রদ্ধেয় চাচা শহীদ বুদ্ধিজীবি ডঃ ফজলুর রহমান সহ সকল শহীদ বুদ্ধিজীবিদেরকে এই পর্বটি উৎসর্গ করলাম।